• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

অপরাধ

নিত্যনতুন মাদকে বাড়ছে উদ্বেগ

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৮ জুন ২০২১

সম্প্রতি নিত্যনতুন মাদকের সন্ধান পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। ইয়াবা, ফেন্সিডিলের পাশাপাশি নতুন নতুন মাদকে জড়িয়ে পড়ছে তরুণসমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা। শুধু আসক্তি নয়, এক শ্রেণির ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান মাদক কেনাবেচাতেও জড়িয়ে পড়ছে। অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপস, আবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন গ্রুপ করেও মাদক কেনাবেচা করছে। 

জানা যায়, লাইসার্জিক এসিড ডাইথ্যালামাইড বা এলএসডির পরে এবার দেশে প্রথমবারের মতো উদ্ধার হয়েছে ডায়েমেথিল ট্রাইপ্টেমিন বা ডিএমটি নামে ভয়ংকর এক মাদক। দীর্ঘ গোয়েন্দা নজরদারি ও তদন্তের ভিত্তিতে রাজধানীর তেজগাঁও এলাকা থেকে নিষিদ্ধ মাদক এলএসডি ও ডিএমটিসহ চার মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তারের পর এ তথ্য জানিয়েছে পুলিশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন।

গ্রেপ্তাকৃতররা হলেন-সৈয়দ মঈন উদ্দিন আহমেদ ওরফে শাদাব (২৯), মো. আব্রাহাম জোনায়েদ তাহের (২৫), স্বপ্নীল হোসেন (২২) ও সিমিয়ন খন্দকার (২৩)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ৪০ ব্লট আলোচিত মাদক এলএসডি, নতুন মাদক ডিএমটি ৬০০ মিলিগ্রাম, আমেরিকান ক্যানাবিজ ৬২ গ্রাম এবং মাদক সেবনের বিভিন্ন সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

গতকাল রোববার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-২-এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম। তিনি বলেন, ‘বিদেশে পড়ালেখা করার জন্য অবস্থানকালেই সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানরা জড়িয়ে পড়ছে ভয়ংকর সব নতুন মাদকে। কেউ থাইল্যান্ডে গিয়ে নতুন মাদক ডিএমটিতে আসক্ত হচ্ছে, কেউ আবার লন্ডনে গিয়ে এলএসডি সেবনে আসক্ত হচ্ছে। পড়াশোনা শেষে দেশে ফিরলেও আসক্তি থেকে পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে দেশে আমদানি করছে এলএসডি ও ডিএমটি।’

এই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সম্প্রতি মাদক চোরাকারবারি ও মাদকসেবীরা প্রতিনিয়ত নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করছে। বিশেষ করে সম্প্রতি বাংলাদেশে প্রচলিত নয়; কিন্তু বিভিন্ন উন্নত দেশে প্রচলিত এমন কিছু মাদকের ব্যবহার বাংলাদেশে পরিলক্ষিত হচ্ছে এবং ধীরে ধীরে আমাদের যুবসমাজ আসক্ত হচ্ছে।’

তিনি জানান, ‘গোয়েন্দা নজরদারি ও ছায়া তদন্তের ভিত্তিতে শনিবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-২-এর একটি বিশেষ আভিযানিক দল রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানাধীন লাভ রোড এলাকা হতে ওই চার যুবককে করে।’

র্যাব-২-এর অধিনায়ক বলেন, ‘এলএসডি সম্পর্কে ইতোমধ্যে আমরা জেনেছি। এটি মূলত বিদেশ থেকে পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে বাংলাদেশে আনা হয় এবং উচ্চমূল্য হওয়ায় মূলত এর ব্যবহারকারী উচ্চবিত্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ‘অপরদিকে উদ্ধার করা নতুন মাদক ডিএমটি। এটি একটি হ্যালুসিনোজেনিক ’ট্রিপটামাইন’ ড্রাগ। এটি মুখ দিয়ে এলএসডি সেবনের মতো, যা ধোঁয়ার মাধ্যমে শ্বাস নিয়ে বা ইনজেকশনের সঙ্গে নেওয়া যায়। এটি সেবনের পর ৩০ থেকে ৪০ মিনিট গভীর হ্যালুসিনেশন তৈরি করে এবং কল্পনার জগতে প্রবেশ করে। এ থেকে মারাত্মক দুর্ঘটনা হতে পারে, এমনকি জীবননাশও হতে পারে।’

লেফটেন্যান্ট কর্নেল খন্দকার সাইফুল আলম বলেন, ‘গ্রেপ্তার সৈয়দ মঈন উদ্দিন আহমেদহ শাদাব রাজধানীর উত্তরায় স্থানীয় এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল হতে ‘এ’ লেভেল শেষ করার পর ভারতের দার্জিলিংয়ে ২০১৩ সালে ‘ও’ লেভেল পড়াশোনা করে। এরপর সে ২০১৫ সালে বিবিএ পড়ার জন্য থাইল্যান্ডে যায়।’

‘এরপর এক বছর সে থাইল্যান্ডে বিবিএ পড়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের বন্ধুদের সঙ্গে এলএসডি ও ডিএমটি মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বাংলাদেশে এসেও ওই মাদক গ্রহণ ও সংগ্রহ অব্যাহত রাখে। শাদাব মূলত এই ড্রাগ বিদেশ থেকে বিভিন্ন পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে নিয়ে আসে এবং বাংলাদেশে নিজে গ্রহণ ও বিক্রি করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘অপরদিকে আব্রাহাম জোনায়েদ তাহের রাজধানীর এক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল থেকে ‘এ’ লেভেল শেষ করে মালেয়েশিয়া গমন করে। ২০১৫-১৬ সাল পর্যন্ত পড়ালেখার জন্য অবস্থান করে। পরবর্তীতে সে উচ্চশিক্ষার জন্য ইংল্যান্ডে গমন করে। সেখানে সে নিয়মিত এলএসডি ও ডিএমটি গ্রহণ করত। সেখান থেকে এমবিএ শেষ করে ২০২০ সালে বাংলাদেশে ফেরত আসে এবং বাংলাদেশে নিয়মিত এলএসডি ডিএমটি গ্রহণ ও বিক্রি করে। এ ছাড়া গ্রেপ্তার স্বপ্নীল হোসেন এবং সিমিয়ন খন্দকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত রয়েছে।’

র্যাব কর্মকর্তা সাইফুল আলম আরো বলেন, ‘ব্যবহারকারী সমুদ্রসৈকতে, পাহাড়ি রিসোর্টে বা কোনো বিনোদন কেন্দ্রে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এই মাদকের ব্যবহার করে থাকে বলে জানিয়েছে।’ এসব নতুন নতুন মাদক ছড়িয়ে পড়েছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে এর আগে এলএসডি মাদক জব্দ হয়েছে। সেবনকারী ও ব্যবহারকারী গ্রেপ্তার হয়েছে। তবে ডিএমটি মাদক এর আগে আগে কখনো জব্দ হয়েছে বলে জানা যায়নি। প্রকৌশল বা রাসায়নিক গবেষণাগারেও এই মাদক তৈরি করা সম্ভব।’

‘এখন পর্যন্ত এই দুই ধরনের মাদক বিশেষ শ্রেণির হাতেই রয়েছে। তারা নিজেরা পরিচিতদের মাধ্যমে ডিএমটি ও এলএসডি আমদানি করে। কখনো নিজেরা গিয়েও নিয়ে আসে। কুরিয়ার বা পোস্টাল সার্ভিসের মাধ্যমে চিঠি বা বইয়ের মাধ্যমে এগুলো সহজে নিয়ে আসা সম্ভব। এসব মাদক সহজলভ্য বা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে র্যাব নজরদারি বৃদ্ধি করেছে।’

র্যাব-২-এর অধিনায়ক আরো বলেন, ‘গ্রেপ্তাররা নিজেরাই মাদক সেবন করে, বিক্রি করে এবং নতুন নতুন মাদক গ্রহীতা তৈরি করে, যা সমাজের জন্য খুবই আশঙ্কাজনক। এসব মাদকের উৎস এবং এর সরবরাহকারীদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে র্যাবের অভিযান অব্যাহত থাকবে।’

এলএসডি : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হাফিজুর রহমানের রহস্যজনক মৃত্যুর তদন্ত করতে গিয়ে এলএসডির সন্ধান পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। এরপর রাজধানীতে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে। হাফিজুরের মৃত্যুর রহস্য তদন্ত করতে গিয়ে তার কয়েকজন বন্ধুকে আটক করে এলএসডি উদ্ধার হয়। এরপর খিলগাঁও এলাকায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ শিক্ষার্থীতে এলএসডিসহ আটক করা হয়। র্যাব ও অভিযান চালিয়ে এলএসডি জব্দ করেছে।

যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর বলছে আরো প্রায় ১০/১৫ বছর আগে রাজধানীতে একবার এলএসডি জব্দ করা হয়েছিল।

এস্কাফ : ফেন্সিডিলের ন্যায় এস্কাফ নামের নতুন মাদক জব্দ করা হয় শনিবার। রাজধানীর খিলগাঁও থেকে এ মাদক জব্দ করে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। ডিবি পুলিশ জানায়, ফেন্সিডিলের বোতলের ন্যায় এ বোতলগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ এড়িয়ে বাজারজাতের চেষ্টা করা হচ্ছিল।

আইস : এটিও নতুন এক ধরনের মাদক। গত বছরের শেষের দিকে এর সন্ধান মেলে। সর্বশেষ রাজধানীর উত্তরায় গোপনে গড়ে তোলা হয়েছে ভয়ঙ্কর মাদক ‘আইস’ তৈরির ল্যাবরেটরি। এ ল্যাবে বিভিন্ন ওষুধ, রাসায়নিক, রং ও মাদকের সংমিশ্রণে আইস তৈরি করা হতো। মাদক তৈরি সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা তৌফিকসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানায় র্যাব।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান কমান্ডার খন্দকার মঈন আলী জানান, গোয়েন্দা সংবাদের ভিত্তিতে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার ভোর পর্যন্ত অভিযান চালিয়ে উত্তরা থেকে মো. তৌফিক হোসাইন, মো. জামিরুল চৌধুরী ওরফে জুবেইন, মো. আরাফাত আবেদীন ওরফে রুদ্র, মো. রাকিব বাসার খান, মো. সাইফুল ইসলাম ওরফে সবুজ, মো. খালেদ ইকবালকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-৩-এর আভিযানিক দল।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার হারুনুর রশিদ বলেন, দেশে নতুন নতুন মাদকের সন্ধান মেলায় আমরা উদ্বিগ্ন। এতদিন ইয়াবা, ফেন্সিডিল, গাঁজার পেছনে ছুটতে হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে আলোচিত মাদকের পেছনেও ছুটতে হচ্ছে। তিনি বলেন, মাদকের বিস্তাররোধে আমরা সচেষ্ট। কারবারীদের বিরুদ্ধে আমাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপত ড. কুদরাত ই খুদা বলেন, নতুন নতুন মাদকের সন্ধান মেলায় আমরা খুবই উদ্বিগ্ন। এক শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এতে জড়িয়ে পড়ার ঘটনা দুঃখজনক। তিনি বলেন, এগুলোকে এখনই প্রতিরোধ করতে হবে। তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা এসব মাদকের ব্যাপক ঠেকাতে আরো জোর পদক্ষেপ নেওয়া হবে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads