• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

তিন ধাপে ইউরোপে মানবপাচার

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১২ জুলাই ২০২১

ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে মানবপাচার চলে তিন ধাপে। এজন্য রয়েছে শক্তিশালী সিন্ডিকেট। এরকম মানবপাচারের আন্তর্জাতিক চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ধরা পড়েছেন সিন্ডিকেটের সমন্বয়ক ইউরো আশিক।

গতকাল রোববার দুপুরে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন মানবপাচারকারী চক্রের কৌশল ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরেন। র্যাব জানায়, গত শনিবার রাত ১০টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত র্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৮ যৌথ অভিযান চালায়। টানা অভিযানে মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মোহাম্মদ আশিক, আজিজুল হক, মিজানুর রহমান মিজান, নাজমুল হুদা, সিমা আক্তার, হেলেনা বেগম ও পলি আক্তারকে।

তাদের কাছে পাওয়া গেছে ১৭টি পাসপোর্ট, বিভিন্ন ব্যাংকের ১৪টি চেক বই, দুটি এটিএম কার্ড, বিভিন্ন ব্যাংকে টাকা জমা দেওয়ার ১৫টি বই, দুটি হিসাব নথি, দুটি এনআইডি, ১০টি মোবাইল ফোন এবং নগদ ৫৬ হাজার ৬৭০ টাকা। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের মধ্যে ইউরোপে মানবপাচারকারী চক্রের বাংলাদেশি এজেন্ট রুবেল সিন্ডিকেটের প্রধান সমন্বয়ক ইউরো আশিক রয়েছেন। তারা বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে অবৈধভাবে ইউরোপে মানবপাচার করে আসছেন। চক্রের সদস্যরা তিন ধাপে কাজ করেন।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখান চক্রের সদস্যরা। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেন। এরপর বিদেশ গমনেচ্ছুকদের পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকিট ক্রয়সহ বিভিন্ন কাজ চলে সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে।

পাসপোর্ট ও অন্যান্য নথি চক্রের সদস্যরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেন। প্রার্থীদের সামর্থ্য অনুযায়ী আর্থিক লেনদেনের কিস্তি ঠিক করা হয়। ইউরোপ যেতে ৭-৮ লাখ টাকার বেশি নিয়ে থাকেন চক্রের সদস্যরা। এর মধ্যে ৪-৫ লাখ টাকা দিতে হয় লিবিয়ায় যাওয়ার আগে। এরপর বাকি টাকা আদায় হয় আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে। গ্রেপ্তার করা ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পেরেছে, মানব পাচারে বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্য হয়ে লিবিয়ায় পাঠানো হয় লোকজনকে। মধ্যপ্রাচ্যে তাদের বিদেশি এজেন্টদের মাধ্যমে রাখা হয় ৭-৮ দিন। এরপর বেনগাজিতে (লিবিয়া) পাঠাতে চলে প্রক্রিয়া। ‘মারাকাপা’ নামের একটি ডকুমেন্ট দুবাইতে পাঠান চক্রের সদস্যরা, যা ইউরোপ গমনেচ্ছুকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এজেন্টদের সহায়তায় তাদের বেনগাজি পাঠানো হয়। এরপর তাদের ত্রিপলিতে স্থানান্তর করেন। যারা লিবিয়া পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করেছেন তাদের স্বল্প সময়েই মধ্যপ্রাচ্যে ট্রানজিট করিয়ে সরাসরি লিবিয়ায় পাঠানো হয়। এই চক্রের বাংলাদেশি সিন্ডিকেটের ‘রুবেল’ দুবাইতে অবস্থান করেন এবং সিন্ডিকেটের সব কাজ মনিটরিং করেন।

ত্রিপলিতে পৌঁছানোর পর লোকজনকে লিবিয়ার এজেন্টদের সহায়তায় গ্রহণ করেন গাজী, কাজী ও বাবুল নামের তিনজন। ইউরোপে গমনেচ্ছুদের ত্রিপলিতে রেখেই বাংলাদেশে অবস্থানরত প্রতিনিধির মাধ্যমে সংগ্রহ করা হয় টাকা। এরপর ইউরোপে পাচারের উদ্দেশে তাদের হস্তান্তর করা হয়।

ইউরোপ যেতে লোকজনকে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেয়া হয় সমুদ্রপথ অতিক্রমের প্রশিক্ষণ। নৌযান চালনা, দিক নির্ণয়যন্ত্র পরিচালনাসহ অনেক কিছু শেখানো হয়। এরপর নির্দিষ্ট দিনে ভোররাতে একসঙ্গে কয়েকটি নৌযান লিবিয়া হয়ে তিউনিসিয়া উপকূলীয় চ্যানেল হয়ে ইউরোপের পথে রওনা দেয়।

এভাবে ঝুঁকিপূর্ণ পথে ইউরোপ যেতে ভিকটিমরা ভূমধ্যসাগরে মাঝেমধ্যেই দুর্ঘটনার শিকার হন। সেখানে জীবনাবসানের ঘটনা ঘটে থাকে। ভূমধ্যসাগরে নৌকায় ওঠাকে তারা ‘গেম’ বলে অবহিত করে থাকেন। এই চক্রের মাধ্যমে অনেকে অবৈধ পথে ইউরোপে গেছেন। আবার অনেকেই প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

র্যাবের হাতে ধরা পড়া চক্রটি ‘রুবেল সিন্ডিকেট’ নামে পরিচিত। তাদের নেতা রুবেল দুবাইতে অবস্থান করেন। রুবেল ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত লিবিয়ায় ছিলেন। তখন একটি মানব পাচারকারী চক্রে জড়িয়ে যান। লিবিয়ায় অনেক অভিযোগ থাকায় রুবেল দুবাইয়ে অবস্থান করে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে নেটওয়ার্ক চালান।

গ্রেপ্তার করা আসামিদের মধ্যে রুবেলের স্ত্রী সীমা, ভাগনে আশিক ও দুই বোন হেলেনা ও পলি রয়েছেন। তারা সিন্ডিকেটের হয়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। দেশে অবস্থান করে সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন আশিক। তিনি এসএসসি পাস করার পর দুই বছর মধ্যপ্রাচ্যে ছিলেন। এরপর ২০১৯ সাল থেকে ঢাকার কেরানীগঞ্জে অবস্থান করে অবৈধ মানব পাচারের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে আসছেন। এই চক্রের বাংলাদেশি সিন্ডিকেটে ২০-২৫ জন সদস্য রয়েছেন।

র্যাব জানায়, চক্রটি প্রায় দুই বছর ধরে মানব পাচার কাজ করে আসছে। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জ ও ফরিদপুর এলাকায় তারা বিশেষভাবে সক্রিয়। এ ছাড়া সিলেট, সুনামগঞ্জ, নোয়াখালী ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে এজেন্ট আছে।

গ্রেপ্তার করা সদস্যদের মধ্যে আজিজ মোবাইল ব্যাংকিং ও ইলেকট্রনিকস ব্যবসায় জড়িত। তিনি মাদারীপুরের মাঠপর্যায়ের বিদেশে গমনেচ্ছুকদের নির্বাচন করে থাকেন। গ্রেপ্তার মিজান এসএসসি পাস, তার ওয়ার্কশপ ব্যবসা আছে। তিনি মাঠপর্যায়ে এজেন্টের সঙ্গে আঞ্চলিক এজেন্টদের যোগাযোগ করিয়ে দেন। আরেক আসামি নাজমুলের সঙ্গে সমন্বয় করে তিনি কাজ করেন।

গ্রেপ্তার নাজমুল হুদা বিএ পাস, তিনি মোবাইল ব্যাংকিং ও কসমেটিকস ব্যবসায় জড়িত। তিনি মাদারীপুর, শরীয়তপুর, মুকসুদপুর ও আশপাশের এলাকায় চক্রের কাজ তদারকি করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads