• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
তুরাগপাড়ের বেড়িবাঁধে কোটি টাকার চাঁদাবাজি

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

 তৈরি করা হয়েছে অবৈধ ল্যান্ড স্টেশনও

তুরাগপাড়ের বেড়িবাঁধে কোটি টাকার চাঁদাবাজি

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৮ জুলাই ২০২১

রাজধানীর মিরপুরের দারুসসালাম এলাকার ছোটদিয়াবাড়ী বেঁড়িবাধে অবৈধভাবে ঘাট বসিয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি হচ্ছে। সরকারি কোনো প্রকার ইজারা ছাড়াই বছরের পর বছর ধরে স্থানীয় একটি চক্র এ চাঁদাবাজি করে আসছে। চক্রটি শুধু বাঁধ নির্মাণ করেই ক্ষান্ত হননি কার্গো জাহাজ ভেড়ানোর জন্য তৈরি করেছে ল্যান্ড স্টেশনও। সেখানে মালবাহী ট্রাক লোড-আনলোডের ক্ষেত্রেও ইচ্ছেমতো চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) ল্যান্ড স্টেশন থাকলেও অদৃশ্য কারণে এ চক্রটির তৈরি ল্যান্ড স্টেশনই ব্যবহূত হচ্ছে।

স্থানীয়দের অভিযোগ, রাস্তার উপরের দুপাশে বিভিন্ন দোকান, লেগুনা স্ট্যান্ড বসিয়েও চাঁদাবাজি করে আসছে প্রভাবশালী এ চক্রটি। তাদের বিরুদ্ধে স্থানীয় লোকজন মুখ খুলতে সাহস পায় না। বছরের পর বছর এ এলাকার লোকজনকে এক প্রকার জিম্মি করেই সব অবৈধ কর্মকাণ্ড করে আসছে তারা।

সরেজিমনে দেখা যায়, রাজধানীর গাবতলী মাজার রোড হয়ে দারুসসালাম থানা রোড। থানার সামনেই দিয়ে ছোট সরু রাস্তা দিয়ে কিছু দূর গেলেই তুরাগ নদীর পাড়। এলাকাটির নাম ছোট দিয়াবাড়ী। তুরাগ নদীর এপারের অংশ ছোট দিয়াবাড়ী উপরের অংশ কাউন্দিয়া। এপারের অংশের বাম দিকে গাবতলী আর ডান দিকে বেড়িবাঁধ রাস্তা। যা আশুলিয়া ও উত্তরার দিকে চলে গেছে। তুরাগের বাঁধঘেষা ছোট দিয়াবাড়ী মোড়টিকে পুঁজি করেই চক্রটি মূলত বিশাল চাঁদাবাজির ক্ষেত্র গড়ে তুলেছে।

দেখা যায়, বাঁধসংলগ্ন রাস্তাটি বেশ চওড়াই কিন্তু দুপার্শ্বে দখলের কারণে এটি ছোট হয়ে এসেছে। দুপার্শ্বে অবৈধভাবে গড়ে তোলা হয়েছে ছোট-বড় দোকান। দারুসসালাম রোড থেকে বাঁধে উঠার সংযোগ সড়কের দুপার্শ্বে রাস্তা দখল করে বাঁশের আড়ৎ দেওয়া হয়েছে। এককালীন লাখ টাকা পরে মাসিক ১৫/২০ হাজার টাকার বিনিময়ে এটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দোকানিরা বলেন, তারা জায়গাটি ভাড়া নিয়েছেন হাজি জহিরের কাছ থেকে। তারা বলেন, এককালীন হিসেবে প্রায় লাখ খানেকের মতো টাকা দিয়েছেন আর প্রতিমাসে ১০ হাজারের মতো টাকা ভাড়া দেন।

দোকানিরা বলেন, এখানে যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হয় সেটি অবৈধ। প্রতিমাসে ৮ থেকে এক হাজার টাকা বিদ্যুৎ বিল নেয় তারা।

সংযোগ সড়ক পেরিয়ে মূল রাস্তায় উঠলেই দেখা মিলবে লাখ টাকার চাঁদাবাজির প্রকাশ্য দৃশ্য। বাঁধের সাথে করা হয়েছে ঘাট। কাউন্দিয়া অধিবাসীরা নৌকা করে তুরাগ পেরিয়ে এ রাস্তায় দিয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করে। তারা মিরপুর, গাবতলীসহ রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করে থাকেন।

আর এ ঘাটে আসা-যাওয়াতে প্রতি ব্যক্তি ২ টাকা দিতে হয়। আর পণ্য থাকলে কখনো ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। আর যে সকল নৌকা পারাপার করে তাদের প্রতিদিন ১০ টাকা করে দিতে হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিন এ ঘাট দিয়ে হাজার হাজার লোকজন আসা যাওয়া করে। তাদের আসা-যাওয়াতে শতাধিক নৌকা রয়েছে সেখানে। তাদের হিসেব মতে, প্রতিদিন এ ঘাট দিয়ে কয়েক লাখ টাকা উঠানো হয়। আর মাসে প্রায় কোটি টাকা।

তাদের অভিযোগ, ঘাটের এ টাকা উঠায় হাজি জহিরের সহযোগী হাসান। আর হাসানেরও কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। শিফট করে তারা টাকা উঠায়।

ঘাটের পাশাপাশি কার্গো জাহাজের জন্য অবৈধভাবে তৈরি করা হয়েছে ল্যান্ডিং স্টেশন। এছাড়াও পণ্য লোড-আনলোডের জন্য ট্রাক উঠানামায় আলাদা লেন তারা তৈরি করেছেন। মূল সড়ক কেটে অবৈধভাবে তৈরি করা লেন দিয়েই স্টেশনে আসা জাহাজ থেকে মালামাল লোড-আনলোড করা হয়।

দেখা যায়, পাশেই সরকারিভাবে ল্যান্ডিং স্টেশন। কিন্তু সেখানে জাহাজের সংখ্যা খুব কম। আর অবৈধভাবে তৈরিটাতেই বেশি। এখানে জাহাজ ল্যান্ডিংয়ের জন্য আলাদা টাকা আর ট্রাক ঢুকলে দিতে হয় ৫০ টাকা। অবৈধভাবে তৈরি এ ল্যান্ডিং স্টেশন থেকেও প্রতিদিন কয়েক লাখ টাকা উঠানো হয়। এক্ষেত্রে অবৈধ ল্যান্ডিং স্টেশন থেকে মাসে প্রায় কোটি টাকা।

এদিকে দেখা যায়, সরকারি ভেকু দিয়ে নদীর ভেতর থেকে মাটি কাটা হচ্ছে। কেন মাটি কাটা হচ্ছে এর উত্তর দিতে না পারলেও এ মাটি বিক্রি করেন জহির। অর্থাৎ সরকারি ভেকু দিয়ে অবৈধভাবে মাটি কেটে সেগুলোও বিক্রি করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলেন, যদি সরকারিভাবেই মাটি উত্তোলন করা হবে তবে সেগুলো এক জায়গায় জমা করে টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রি হবে। কিন্তু এখানে কোন নিয়মনীতি মানা হয় না। মাটি তুলে হয় ট্রলারে নতুবা ট্রাক ভিড়িয়ে তুলে নিয়ে যায়। কে নিয়ে যায়, কোথায় নিয়ে যায়, কারা বিক্রি করল, কেউ কোনো প্রশ্ন করতে পারেনা। এ মাটি বিক্রি করেও মাসে কোটি টাকা পকেট ভরেন হাজি জহির।

দুধারে অবৈধভাবে দোকানপাটের কারণে এমনিতেই সরু হয়ে আসছে সড়ক। এর ওপর সেখানে লেগুনা স্ট্যান্ড দেওয়া হয়েছে। আর এ স্ট্যান্ড থেকেও মাসে কয়েক লাখ টাকা চাঁদা উঠে।

স্থানীয়রা বলছেন, তুরাগপাড়ের ছোট দিয়াবাড়ীতে অনেকে বেড়াতে আসতেন আগে। ছুটির দিন ও ছুটির দিনের বাইরে বেড়িবাঁধের রাস্তা দেখতে অনেকেই বেড়াতে আসেন। কিন্তু বর্তমানে এখানে আর কেউ বেড়াতে আসেন না। ছোট এ মোড়টাকে টাকার খনি করে ফেলেছেন জহির হাজি। অদৃশ্য প্রভাবের কারণে সরকারি রাস্তা কেটে ঘাট তৈরি, ল্যান্ড স্টেশন তৈরি, মাটি বিক্রি, রাস্তার দুপাশ ভাড়া দিয়ে মাসে এখান থেকে ৩/৪ কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেন। বছরের পর বছর ধরে এ কাজ করে আসলেও কখনো তাকে বাধার সন্মুখীন হতে হয়নি।

কে এই জহির হাজি : স্থানীয়রা বলছেন, জহির নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। হজ করে আসার পর নামের পরে হাজি লাগান। সেই থেকেই জহির হাজি নামে পরিচিত। হাজি জহিরের তেমন কোনো রাজনৈতিক পদপদবি নাই। তবে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে তার উঠাবসা রয়েছে। দারুসসালাম সংযোগ সড়কের সাথে একটি ভবনের দ্বিতীয়তলায় বেশ পরিপাটি অফিস রয়েছে তার। তিনি সেখানেই বসেন।

স্থানীয়রা বলছেন, মাঠে থেকে জহির হাজির হয়ে যারা টাকা উঠান তাদের মধ্যে শওকত ও হাসান অন্যতম। এ দুজনেই মূলত সামনে থেকে টাকা উঠানোর কাজ করে। তাদের বেশকিছু সহযোগীও রয়েছে।

এবিষয়ে জানতে চাইলে জহির হাজি মোবাইল ফোনে বলেন, তিনি এখন অসুস্থ। এখন এ বিষয়ে  কথা বলতে পারবেন না।

এবিষয়ে নৌপরিবহনমন্ত্রী খালেদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বিষয়টি নজরে আসেনি আমাদের। আমরা দ্রুত এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেব। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads