• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

সীমান্তে কার্যক্রম বাড়াচ্ছে জঙ্গিরা

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৭ জুলাই ২০২১

দেশের সীমান্ত এলাকায় কার্যক্রম বাড়িয়েছে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বা আনসারুল্লা বাংলা টিম। প্রাথমিকভাবে ‘কাট আউট সিস্টেমে’ সদস্য বাড়াচ্ছে। এভাবে সদস্য বাড়ানোর মাধ্যমে প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছে। মায়ানমার সীমান্ত সংলগ্ন তিন পার্বত্য এলাকার গহিন জঙ্গলে দলে নতুন যোগ দেওয়া সদস্যদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হচ্ছে। এরইমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এসব এলাকায় গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়েছে। সম্প্রতি আটক হওয়া জঙ্গিদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করা অন্তত ২৫ বক্তাকে নজরদারির মধ্যে রাখা হয়েছে। যে কোনো সময় তাদের আইনের আওতায় আনা হবে। কর্মকর্তারা মনে করছেন, আনসার আল ইসলাম আফগানিস্তানের তালেবান জঙ্গিদের মতো প্রকাশ্যে ‘দাওয়াতি’ কাজ শুরু করলে তা হবে উদ্বেগজনক। ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম বলেন, ‘আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের পুনরুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডের যে অপতৎপরতা দেখা দিয়েছে তা উদ্বেগজনক।’ ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট (সিটিটিসির) উপকমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘সম্প্রতি গ্রেপ্তারকৃত গুনবি জিজ্ঞাসাবাদে সবকিছু স্বীকার করেছেন। সম্প্রতি আদালতেও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারপর তাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবির অনেক অনুসারীকে উগ্রবাদী হিসেবে শনাক্ত করে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’

সূত্র জানায়, প্রকাশ্যে ‘দাওয়াতি’ কাজের প্রস্তুতি নিয়ে এগুচ্ছে নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম। সংগঠনটি ইতিমধ্যে দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় কার্যক্রম জোরদার করেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলে যাওয়ার পর তালেবান যে তৎপরতা শুরু করেছে তাতে উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা চালাচ্ছে সংগঠনটি। এর অংশ হিসেবেই কওমি মাদরাসার শিক্ষক এবং হেফাজতে ইসলাম ও সমমনা সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছে জঙ্গি সংগঠনটি। তাদের মধ্যে আছেন গুনবিসহ তার মতো ২৫ উগ্রবাদী বক্তা, যাদের বেশিরভাগই হেফাজতে ইসলামের নেতা। তবে হেফাজতে ইসলাম বলছে, আনসার আল ইসলামের সঙ্গে তাদের কোনো নেতার সম্পর্ক নেই। জানা যায়, আনসার আল ইসলাম পরিচিত আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি) নামেও। জঙ্গি সংগঠনটির সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার ‘আদর্শিক মিল’ রয়েছে। আনসার আল ইসলাম যে উগ্রবাদীদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে তাদের শনাক্ত করে ব্যবস্থা নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলার পর বিভিন্ন অভিযানে কোণঠাসা হয়ে পড়ে জঙ্গি সংগঠনগুলো। এসব নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কৌশলী ও গুছিয়ে কাজ করে আনসার আল ইসলাম। কোণঠাসায় আত্মগোপনে থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। যখন কাউকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন এদের সম্পর্কে অনেক তথ্য চলে আসে।

কর্মকর্তারা জানান, হেফাজতে ইসলামসহ সমমনা ইসলামী দলগুলোর ‘অপারেশনাল উইং’ হিসেবে কাজ করার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আনসার আল ইসলাম। তাদের উদ্দেশ্য ‘বৈশ্বিক জিহাদে’ অংশ নেওয়া, যার মাধ্যমে দূরবর্তী শত্রুপক্ষকে ঘায়েল করে স্থানীয়ভাবে ক্ষমতা দখল করা। যে বিষয়টিকে তারা ইসলামী খেলাফত বলে প্রচার করে।

আটককৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে কর্মকর্তারা বলছেন, আফগানিস্তানে তালেবান জঙ্গিদের উত্থানের খবরে তৎপরতা বাড়িয়েছে আনসার আল ইসলাম, চেষ্টা চালাচ্ছে প্রকাশ্যে দাওয়াতি কাজ করতে। তবে আফগানিস্তানের জঙ্গিদের নেতৃত্বে

 

সীমান্তে কার্যক্রম বাড়াচ্ছে

 

রয়েছে সালাফি মতাদর্শীরা। আর বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনগুলো ‘রিসোর্স’ হিসেবে ব্যবহারের জন্য টার্গেট করেছে বিভিন্ন কওমি মাদরাসার উগ্রপন্থি শিক্ষক ও আলেমদের। তাদের সংগঠনের সদস্য হিসেবে ‘রিক্রুট’ করে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সক্রিয় করতে চায় তারা।

এ ক্ষেত্রে কিছুটা সফলতাও পেয়েছে জঙ্গি সংগঠনটি। গ্রেপ্তার হওয়া মাওলানা মাহমুদ হাসান গুনবি, হারুন ইজাহার, রফিকুল ইসলাম মাদানি ও আলী হোসেন ওসামা তাদের হয়ে যুবসমাজের ‘মগজধোলাই’ করছিলেন। আরেক আলোচিত মাওলানা আবু ত্ব-হা আদনানও তাদেরই অনুসারী।

কর্মকর্তারা মনে করছেন, সাধারণত যে ঘটনা নিয়ে বিশ্ব সরগরম থাকে সে ঘটনাকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদীরা। সবশেষ আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর সেখানকার জঙ্গিরা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে, যার প্রভাব থাকতে পারে বাংলাদেশি উগ্রবাদীদের মধ্যে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, জঙ্গিদের মোকাবিলায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের পাশাপাশি জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করাও জরুরি। জনগণকে সচেতন করে এ বিষয়ে পদক্ষেপ না নিতে পারলে দেশে বাড়তে পারে জঙ্গিবাদী তৎপরতা।

কাট আউট সিস্টেম : জঙ্গি সংগঠনটি এমনভাবে তাদের কাজ করে যে দাওয়া শাখার সদস্যরা একে অপরের পরিচয় জানতে পারেন না। এক তৈয়ফার কোনো সদস্যই (মামুর) অন্য তৈয়ফা বা সেই তৈয়ফার সদস্য কারা, তারা কী কাজ করছেন-এর কোনো কিছুই জানতে পারেন না। তাদের সব কাজই চলে কঠোর গোপনীয়তার সঙ্গে। তাদের পরিচয় ও কাজ সম্পর্কে জানেন কেবল ‘মাশুল’ ও ‘মাজমাহ মাশুল’ শ্রেণির নেতারা। আবার এক মাশুলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারেন না অন্য কোনো মাশুল। শুধু মাজমাহ মাশুলদের কাছেই সব মাশুলের কর্মকাণ্ডের খবর থাকে। বিষয়টা পরিচিত ‘কাট আউট সিস্টেম’ হিসেবে।

জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী পুলিশ কর্মকর্তারা জানান, কোনো অপারেশন, হামলার ঘটনার পর জড়িত নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও সংগঠনটির অন্যান্য পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের বিষয়ে তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। মূলত কাট-আউট পদ্ধতিতে কার্যক্রম পরিচালনার কারণেই তাদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে।

আধ্যাত্মিক নেতা গুনবি, আমির মেজর জিয়া : পুলিশ জানায়, ১৫ জুলাই রাজধানীর শাহ আলী থানার বেড়িবাঁধ এলাকা থেকে গুনবিকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এ সময় তার কাছ থেকে উগ্রবাদী কিছু বই ও প্রচারপত্র উদ্ধার করা হয়।

র‍্যাবের ভাষ্য, মাহমুদুল হাসান গুনবি প্রকাশ্যে ওয়াজ করে পরিচিতি লাভ করেন। গোপনে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের হয়ে কাজ করেন তিনি। বর্তমানে সংগঠনটির আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবেও তিনি পরিচিত।

পুলিশ সদর দপ্তরের জঙ্গিবিষয়ক এক কর্মকর্তা জানান, আনসার আল ইসলামের ফতোয়া বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে জসিমউদ্দিন রাহমানী ছিলেন, তিনিই আধ্যাত্মিক নেতা হিসেবে পরিচিতি পান। তবে আনসার আল ইসলামের আধ্যাত্মিক নেতা বলে কোনো পদ নেই। জসিমউদ্দিন রাহমানী কারাগারে থাকায় তার পক্ষে ফতোয়া বোর্ডের সিদ্ধান্ত দেওয়া সম্ভব নয়। বোর্ডের অন্য সদস্যরা মিলে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন।

সিটিটিসি কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে সংগঠনটির সর্বোচ্চ নেতা আমিরের দায়িত্ব পালন করছেন আত্মগোপনে থাকা ‘মেজর জিয়া’ বা অন্য কেউ। সংগঠনটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নেতা তামিম আল আদনানী মালয়েশিয়া আছেন। এই আদনানীই মিডিয়াসহ একাধিক শাখার দায়িত্ব পালন করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, মেজর জিয়া আত্মগোপনে থাকায় আদনানীই দেশের বাইরে বসে নিষিদ্ধ সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

আনসার আল ইসলামের উত্থান : ২০১০ সালে আনসারুল্লাহ ফাউন্ডেশন নামে পাকিস্তানভিত্তিক একটি ওয়েবপেজ চালু করেন বাব-উল-ইসলাম নামে এক পাকিস্তানি। যেখানে উর্দু, পশতু, হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা ভাষায় ব্লগ লেখা হতো। ২০১২ সালে আনসারুল্লাহ ফাউন্ডেশন থেকে পৃথক হন বাংলা ভাষাভাষী ব্লগার গ্রুপটি; যাদের বলা হয় আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা এবিটি।

তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের জঙ্গি কর্মকাণ্ড অনুসরণকারী কর্মকর্তাদের কাছে এবিটি আর আনসার আল ইসলাম অভিন্ন সংগঠন হিসেবেই পরিচিত। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে এই সংগঠনের মাধ্যমে বেশকিছু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে আল-কায়েদা নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি এক ভিডিও বার্তার মাধ্যমে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা (একিউআইএস) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। এরপর আনসার আল ইসলাম তাদের টুইটার পেজে নিজেদের একিউআইএসের বাংলাদেশ শাখা দাবি করে।

আনসার আল ইসলাম ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ১৩টি হামলার দায় স্বীকার করে। এসব ঘটনায় নিহত হন ১১ জন, যাদের অধিকাংশ ছিলেন ব্লগার। নিহতদের মধ্যে আরো ছিলেন প্রকাশক, শিক্ষক ও সমকামী অধিকারকর্মী।

বর্তমানে একিউআইএসের প্রধান হিসেবে রয়েছেন এক পাকিস্তানি নাগরিক, যিনি ওস্তাদ ফারুক নামে পরিচিত। তবে তার অবস্থান কোথায় সে বিষয়ে নিশ্চিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সিটিটিসির উপকমিশনার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘উগ্রবাদী এ সংগঠনটি উগ্রবাদীদের ব্যবহারের চেষ্টা করছে। আমরাও উগ্রবাদী বক্তাদের শনাক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।’

পুলিশের অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) অপারেশন উইংয়ের এসপি মোহাম্মদ ছানোয়ার হোসেন বলেন, ‘এক্সট্রিম জঙ্গিবাদের নেতৃত্বে যারা থাকে তারা সব সময় ইস্যু খোঁজে। দাওয়াতি কার্যক্রমে সফলতা নির্ভর করে ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল ইস্যুর ওপর। যে ঘটনা নিয়ে বিশ্ব সরগরম থাকে সে ঘটনাকে পুঁজি করে জঙ্গিবাদীরা। সর্বশেষ আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ার পর সেখানকার জঙ্গিরা নতুন স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। যার একটা প্রভাব থাকতে পারে বাংলাদেশি উগ্রবাদীদের মধ্যে।’

তিনি বলেন, ‘জঙ্গিরা সব সময়ই বিশ্বের যে কোনো জায়গায় একটা ফ্রি ল্যান্ড চায়, যেখান থেকে তারা অবাধে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারবে। থিওরেটিক্যাল অ্যানালাইসিস অব টেররিজম অনুসারে এটা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। সমপ্রতি আফগানিস্তানের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে অনলাইন ও অফলাইনে কার্যক্রম জোরদার করেছে আনসার আল ইসলাম।’

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads