• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আতঙ্ক জঙ্গি সংগঠন ‘ইয়াকিন’

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০১ অক্টোবর ২০২১

রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংঘটিত হচ্ছে জঙ্গিগোষ্ঠী ‘ইয়াকিন’। হত্যাকাণ্ডের মধ্যে দিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে ক্যাম্পে একক আধিপত্য বিস্তার করছে আবদুল হাকিম ডাকাতের নেতৃত্বে এ সংগঠনটি। যে তাদের কথা শোনেনি তাদেরই হত্যা করেছে সশস্ত্র এ সংগঠনটি। সর্বশেষ হত্যার শিকার হয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা মহিবুল্লাহ। প্রকাশ্যে অফিসে ঢুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাকে। মহিবুল্লাহ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্সনের পক্ষে ছিলেন।

এদিকে মহিবুল্লাহর হত্যার পর ক্যাম্পগুলো ঘিরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে স্থানীয় প্রশাসন। তবে পরিস্থিতি এখনো থমথমে বলে জানিয়েছেন বাসিন্দারা।  বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, রোহিঙ্গা শিবিরে চলছে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি। একের পর এক সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হচ্ছে। পরস্পর বিরোধী গ্রুপগুলো এখন মুখোমুখি। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই এসব শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। খুনোখুনি, অপহরণ, গুম, লুটপাটসহ নানা অপরাধজনক ঘটনা ঘটছে। গত ৮ মাসে টেকনাফ ও উখিয়ার  ক্যাম্পগুলোয় ইয়াকিনের হাতে খুন হয়েছে অন্তত ৩০ জন। সর্বশেষ মহিবুল্লাহকেও হত্যা করতে ছাড়েনি তারা।

সূত্র জানায়, গত মাসের কোনো এক রাতে উখিয়ার কুতুপালং ই-২ শিবিরে রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের একটি বড় হামলা নস্যাৎ করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। শিবিরের কয়েকটি মসজিদের মাইকের ঘোষণায় দ্রুত ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছুটে যাওয়ায় বড় ধরনের হামলার ঘটনা থেকে রক্ষা পায়।

জানা যায়, বর্তমানে শিবিরগুলোতে আল ইয়াকিন রোহিঙ্গা জঙ্গিগ্রুপ অনেক বেশি সংগঠিত। সংগঠনটির বেশির ভাগ রোহিঙ্গা আগে আরএসও সংগঠনে ছিল। আল ইয়াকিন সংগঠনকে রোহিঙ্গাদের অনেকেই আরসা হিসেবেও বলে থাকে। সংগঠনটিতে রয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবক সদস্য। সাধারণ রোহিঙ্গাদের কাছে আল ইয়াকিন বা আরসা নামের সশস্ত্র সংগঠনটি একটি আতঙ্কের নাম।

সূত্র জানায়, টেকনাফে সর্বত্র বিরাজ করছে আল-ইয়াকিনের নেতা হাকিম ডাকাত আতঙ্ক। গত বছর তার আস্তানায় হানা দিয়ে ১৫টি ওয়ান শ্যুটারগান ও দুটি রিভলবার এবং ৪৪২ রাউন্ড গুলিসহ দুই সহযোগীকে আটক করে র্যাব-৭। এরপর আরো বেপরোয়া হয়ে সে একের পর এক অপহরণ, গুম হত্যা চালাতে থাকে।

তার ভয়ে পল্লান পাড়া ও উপজেলা কমপ্লেক্স সংলগ্ন এলাকার অনেক পরিবার এখনো ঘর ছাড়া। তার হাতে অপহূত পল্লান পাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হাফেজসহ অন্তত অর্ধডজন মানুষের এখনো খোঁজ নেই বলে জানা গেছে। রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা শুরু হলে সে নিজেকে রোহিঙ্গা বিদ্রোহী সংগঠন আল ইয়াকিন-২ এর নেতা দাবি করে ইউটিউবে বেশ কয়েকটি ভিডিও আপলোড করে। এর থেকেই আলোচনায় আসে সংগঠনটি।

স্থানীয়দের অভিযোগ, মতবিরোধ হলেই অপহরণ করে খুন করেছে আল-ইয়াকিন। কুতুপালং অনিবন্ধিত ক্যাম্পে হানা দিয়ে ই-১ ব্লকের নেতা আয়ুব মাঝি, কুতুপালং নিবন্ধিত ক্যাম্পের শরণার্থী আলী আহমদের ছেলে মো. সেলিমকে তাদের ঘর লুটপাট করে অপহরণ করে নিয়ে যায়। পরে তাদের লাশ উখিয়া থানা পুলিশ উদ্ধার করে।

একইভাবে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা গত ২৩ মে কুতুপালং নিবন্ধিত শরণার্থী ক্যাম্পের মালয়েশিয়াফেরৎ মৃত ইমাম হোসেনের ছেলে মো. শফি (২৬) রাতের অন্ধকরে শিবির থেকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। মুক্তিপণ না দেওয়ায় অপহরণের তিনদিনের মাথায় ২৫ মে সকালে পার্শ্ববর্তী মধুরছড়া জঙ্গল থেকে লাশ উদ্ধার করে উখিয়া থানা পুলিশ।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, শালবন ও কুতুপালং ক্যাম্পে এ বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের অবস্থান। ক্যাম্পের অধিকাংশ মানুষই শান্তি চান। তারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্দেশনা অনুযায়ী চলাফেরা করেন। চলতি বছরের মার্চে উখিয়ার বালুখালি ক্যাম্পে ভয়াবহ যে আগুনের ঘটনা ঘটে তা ছিল আল-ইয়াকিনের কাজ। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে তারা রোহিঙ্গাদের ঘর পুড়িয়ে দেয়। অনেকে বলছেন, এর পেছনে আল-ইয়াকিনের হাত রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, অপহরণ করে টেকনাফের শালবাগান, শামলাপুর পাহাড়, জিমংখালি পাহাড়, পালংখালি, কুতুপালং ক্যাম্প ও মিনা বাজার সংলগ্ন নির্জন পাহাড়ে নিয়ে যাওয়া হতো। এসব পাহাড় অন্যান্য এলাকার চেয়ে বেশ নির্জন, বন্যহাতি চলাফেরা করে। এ কারণে ভয়ে ওদিকে কেউ যায় না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সচরাচর এসব এলাকায় অভিযান চালাতে সাহস দেখায় না। গত পাঁচ বছরে র‍্যাব-পুলিশ মাত্র দু-একবার সেখানে যৌথ অভিযান চালায়। আর এখানেই আস্তানা গড়েছে ইয়াকিন।

স্থানীয়রা বলছেন, তারা কক্সবাজার ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অত্যাধুনিক অস্ত্র দেখেছেন। এগুলো অবৈধভাবে মিয়ানমার থেকে আনা। বিভিন্ন সময় পুলিশ ও আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন টেকনাফ ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অভিযান চালিয়ে এসবিবিএল (একনলা বন্দুক), নাইন এমএম পিস্তল, থ্রি নট থ্রি রাইফেল, ওয়ান শুটারগান, এমনকি একে-৪৭ এর মতো আগ্নেয়াস্ত্রের সন্ধান পেয়েছে। মাঝেমধ্যে কিছু অস্ত্র ধরাও পড়ে।

টেকনাফ থানার ওসি হাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তাদের সঙ্গে প্রায়ই রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটে। এছাড়া সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে প্রায়ই পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে এসব অস্ত্র উদ্ধার করে।

কে এই হাকিম ডাকাত : দুর্ধর্ষ রোহিঙ্গা ডাকাত আবদুল হাকিম। গরু চোরাকারবারির মাধ্যমে তার বেড়ে ওঠা। মিয়ানমার থেকে গরুর চালান আনতেন বাংলাদেশে। মিয়ানমারে ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়ালেখা করেন। পরে জড়িয়ে পড়েন ইয়াবা ও অস্ত্রকারবারে। কক্সবাজার অঞ্চলের বিশেষ মহলের আশীর্বাদে এক সময় বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে গড়ে তোলেন ডাকাত বাহিনী। কক্সবাজারের সীমান্ত জনপদ টেকনাফের পাহাড়ি অঞ্চল ও মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার বাসিন্দাদের কাছে মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হাকিম।

কক্সবাজারবাসীর দাবি, সশস্ত্র সংগঠন আল-ইয়াকিন পরিচালনা করছেন তিনি। মিয়ানমারের রাশিদং থানার বড়ছড়া গ্রামের জানি আলীর ছেলে তিনি। দুই যুগ আগে হাকিম মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক কর্মকর্তাকে খুন করে দেশ ছাড়েন, পালিয়ে আশ্রয় নেন টেকনাফে। সঙ্গে নিয়ে আসেন স্ত্রী-সন্তান ও পাঁচ ভাইকে। অভিযোগ আছে, কুতুবদিয়া দ্বীপে মিথ্যা তথ্য দিয়ে জন্মনিবন্ধনসহ ভোটার আইডি তৈরি করে নেন হাকিম ও তার পরিবারের সদস্যরা। টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের মিস্ত্রিপাড়ার জহির আহমদ ওরফে গাছ জহিরের মেয়ে ইসমত আরা বেগমকে বিয়ে করেন হাকিম। এছাড়া একাধিক বউ রয়েছে তার।

গত বছরের ২৬ জুন পুলিশ তাদের আস্তানায় অভিযান চালালে হাকিম ডাকাত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। ওই সময় বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন তার দুই ভাই বশির আহমেদ ও আবদুল হামিদসহ চারজন। এর আগে তার আরেক ভাই, শ্যালক ও স্ত্রী পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান।

টেকনাফ পৌর এলাকার পুরাতন পল্লান পাড়ায় বনভূমি দখল করে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে গড়েন বিশাল অট্টালিকা। এখন তা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দখলে। অভিযোগ রয়েছে, ডাকাত হাকিম ২০১৫ সালের ১২ জুন সেলিম ওরফে মুন্ডি সেলিমকে হত্যা করেন। নুরুল কবির নামে একজনকেও খুন করেন তার বাহিনীর সদস্যরা। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা নুরুল হকের ছেলে নুর হাফেজ ও নাইট্যংপাড়ার মৃত মোহাম্মদ কাশিমের ছেলে তোফায়েলকেও অপহরণের পর হত্যার অভিযোগ রয়েছে এ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে। রয়েছে অসংখ্য ধর্ষণের অভিযোগও।

চট্রগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন বলেন, ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপশি সাদাপোশাকে নজরদারি করা হচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ইয়াকিনের ব্যাপারে আমরা ওয়াকিবহল। আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিচ্ছি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads