• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

অপরাধ

তিন কারণে মুহিবুল্লাহ খুন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৯ অক্টোবর ২০২১

বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে ফেরাতে তৎপর ছিলেন রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহ। নিজ দেশে ফিরে যেতে তিনি ছিলেন রোহিঙ্গাদের স্বপ্নদ্রষ্টা। তার জোরালো ভূমিকার কারণে বিদেশেও পরিচিতি পান তিনি। তাই তাকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যায় সরব হয়েছে গোটা বিশ্ব। হত্যাকারীদের কঠোর শাস্তির দাবি করেছেন বিশ্বের বড় বড় দেশের কূটনীতিকরাও।

এদিকে, মুহিবুল্লাহকে কেন হত্যা করা হয়েছে তা নিয়ে দেশে-বিদেশে চলছে নানা বিশ্লেষণ। তবে অধিকাংশই তিনটি কারণের বিষয়ে একমত হয়েছেন। তা হলো, যারা মিয়ানমারে ফেরানোর প্রক্রিয়ায় রাজি নয় তারাই খুন করতে পারে মুহিবুল্লাহকে। অর্থাৎ এই হত্যায় মিয়ানমার জান্তা সরকারের হাত থাকতে পারে। এছাড়া রোহিঙ্গারা বেশ কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশে অবস্থান করলেও মুহিবুল্লাহই একমাত্র ব্যক্তি যার যোগাযোগ ও যাতায়াত ছিল বিশ্ব দরবারে। মুহিবুল্লাহর মতো নেতাকে সরিয়ে রোহিঙ্গাদের মধ্যে ঐক্য ও নেতৃত্বশূন্য করার কূটচালের অংশ এ হত্যাকাণ্ড। আবার অনেকে মনে করছেন, মিয়ানমার সরকার, আল ইয়াকিন বা আরসার সহযোগিতায় নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধের বলি হতে পারেন মুহিবুল্লাহ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, মুহিবুল্লাহ খুনে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাত থাকতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হোক সেটা মিয়ানমার কখনো চায়নি। আমরা কোনো নেতার নাম জানি না। মিয়ানমারে যখন তারা ছিলেন তাদের নাম জানতাম না। এখনো যে সাত লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমারে অবস্থান করছে তাদের নেতা কে? সেটা কিন্তু আমরা জানি না। যে দুই চারজনের নাম শোনা যায়, তারা কেউ মিয়ানমারে বা বাংলাদেশে অবস্থান করছে না। যুক্তরাজ্য বা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান নিয়ে কাজ করছে। এই ক্ষেত্রে একটা প্যাটার্ন আমরা দেখতে পাচ্ছি যদিও তা তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষ, তা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে নেতৃত্ব তৈরি হোক তা কখনো চায়নি মিয়ানমার। আবার নেতৃত্বের দ্বন্ধের কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে বলে মনে করেন তিনি। কারণ এটাই প্রথম কোনো রোহিঙ্গা নেতা খুনের ঘটনা নয়। ২০১৮ ও ২০১৯ সালেও রোহিঙ্গা নেতা খুন হয়েছে। তবে মুহিবুল্লাহর মৃত্যুর সঙ্গে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন দীর্ঘ হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন এই বিশ্লেষক।

তিনি বলেন, নিজেদের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে থাকতে পারে দ্বন্ধ। কারণ যারা মুহিবুল্লাহকে খুন করেছে তারা খুব কাছে গিয়েছিল। কাছ থেকে তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। হইচই হয়নি। কেউ বাধাও দেয়নি। হয়তো খুনিদের চিনতেন মুহিবুল্লাহ। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যেই অনেকে ফেরার পক্ষে ছিলেন না। তাদের সঙ্গে মিয়ানমার মিলিটারির যোগাযোগও থাকতে পারে। এই তিন কারণ অনুসন্ধানে তদন্ত সংশ্লিষ্টদের খতিয়ে দেখা উচিত।

সাবেক পররাষ্ট্র সচিব মো. তৌহিদ হোসেনও এইসব কারণকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবে তার জোর ধারণা এই খুনের সঙ্গে আল ইয়াকিন (আরসা) জড়িত থাকতে পারে। কারণ আল ইয়াকিন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মিয়ানমার জান্তা সরকারের এজেন্ডাই বাস্তবায়ন করছে।

তিনি বলেন, মুহিবুল্লাহ খুনের পরপরই আল ইয়াকিন বা আরসার কথা উঠে এসেছে। এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আল ইয়াকিন যে জড়িত থাকতে পারে তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তিনি বলেন, যে দিন (১৭ আগস্ট) আরাকানে হত্যাযজ্ঞ শুরু হলো তখন আরসা আগের দিন অনেকগুলো ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়েছিল। এরপর আমরা আরসার নাম শুনিনি। কিন্তু যখন রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে বাংলাদেশে আসা শুরু করল তখন কিন্তু আরসা সহযোগিতা করেনি। তবে এর তিন সপ্তাহ আগে ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী উত্তর রাখাইনে মিয়ানমার সৈন্যদের আনা হয়। তারা কীভাবে জেনেছিল যে ঠিক এই সময়ে আরসা সেখানে হামলা চালাবে। অর্থাৎ যেভাবেই হোক জেনে না জেনে আরসা মিয়ানমার মিলিটারির পক্ষে কাজ করছিল। কারণ প্রত্যেক বিপক্ষ বাহিনীতে সরকারের এজেন্ট থাকে। এটা আমার অনুমান যে আরসাতেও মিয়ানমার মিলিটারির লোকজন এজেন্ট হিসেবে কাজ করছে।

তিনি আরো বলেন, প্রত্যাবাসন কখনো চায়নি মিয়ানমার। কিন্তু মুহিবুল্লাহ প্রত্যাবাসনের পক্ষে। সেজন্য তাকে সরিয়ে দেওয়া অনেকে দরকার মনে করেছিল। অভ্যন্তরীণ দ্বন্ধের বিষয়টিও থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি। একইসঙ্গে তিনি মনে করেন, মুহিবুল্লাহকে বাংলাদেশ সরকারের স্পন্সর করা উচিত ছিল। তাকে লাইনে রাখা উচিত ছিল। যাতে মুহিবুল্লাহ বাংলাদেশ সরকারকে সহযোগিতা করতে পারেন।

মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, মুহিবুল্লাহর মৃত্যুতে কিন্তু নেতৃত্বশূন্য থাকবে না। কেউ না কেউ তা দখল করবে। এক্ষেত্রে আমার মনে হয় ক্রিমিনাল নেতৃত্বই গড়ে উঠবে তাতে লাভ হবে না বাংলাদেশের। স্থানীয় ক্রিমিনালরা এ ক্ষেত্রে সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। এসব বিষয় ভাবনায় আনা উচিত।

গত ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার ১-ইস্ট নম্বর লম্বাশিয়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ডি-৭ ব্লকে রোহিঙ্গা নেতা মোহাম্মদ মুহিবুল্লাহকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে অজ্ঞাতনামা ২০-২৫ জনকে আসামি করে উখিয়া থানায় মামলা করেন নিহত মুহিবুল্লাহর ছোট ভাই মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ। ১ অক্টোবর দুপুরে উখিয়ার কুতুপালং ক্যাম্প-৬ থেকে হত্যায় জড়িত সন্দেহে মোহম্মদ সলিম নামে একজনকে আটক করে ১৪ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন। পরে তাকে উখিয়া থানায় হস্তান্তর করা হয়। এরপর আরো চারজনকে আটক করে একই থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে। এদের মধ্যে দুজনকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তিনদিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads