• বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪২৯
মুখোশধারীদের গ্রেপ্তারে ত্রিমুখী অভিযান

সংগৃহীত ছবি

অপরাধ

কুমিল্লায় মন্দিরে হামলা ভাঙচুর

মুখোশধারীদের গ্রেপ্তারে ত্রিমুখী অভিযান

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৭ অক্টোবর ২০২১

কুমিল্লায় মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুরে জড়িতদের পাশাপাশি নেপথ্যে মদতদাতাদের গ্রেপ্তারে ত্রিমুখী অভিযানে মাঠে নেমেছে পুলিশ, র‍্যাব, পিবিআইসহ গোয়েন্দা সংস্থা।

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক সংস্থার দাবি, সংঘবদ্ধ একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা করছে। তারা প্রথমে কুমিল্লায় এবং পরে এর জের ধরে আরো কয়েকটি জেলায় পূজামণ্ডপে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে। অপ্রীতিকর এসব ঘটনায় নেপথ্যে থেকে যারা মূল ভূমিকা পালন করেছে তাদের মধ্যে কয়েকজনের ব্যাপারে স্পষ্ট তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে জানিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, একটি মহল সনাতন ধর্মালম্বীদের দুর্গাপূজাকে টার্গেট করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর গভীর ষড়যন্ত্র নামে। এর অংশ হিসেবে তারা কুমিল্লায় মন্দিরে হামলা ভাঙচুর করে। এ ঘটনার জের সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

গতকাল শনিবারও বরিশালের গৌরনদীতেও মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটে। আগের দিন শুক্রবার নোয়াখালীতে নজীরবিহীন তাণ্ডব চালানো হয়। মূর্তি বিসর্জনের আগ মুহূর্তে বেশ কয়েকটি মন্দিরে তাণ্ডব চালায় ষড়যন্ত্রকারীরা।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার দাবি, প্রাথমিক প্রাপ্ত তথ্যে তারা ধারণা করছেন, কুমিল্লায় হামলার মধ্য দিয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকা অশান্ত করার প্লট যারা সাজিয়েছেন তার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনের ধর্মভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। এসব তথ্য আরো যাচাই-বাছাই চলছে। হামলাকারীরা স্থানীয় নন বলেও প্রাথমিক তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। পরিচয় গোপন করতেই বাইরে থেকে এসে মুখোশ পরিহিত অবস্থায় হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা।

কর্মকর্তারা বলছেন, শুধু কুমিল্লা নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা ভাঙচুরে বহিরাগতরা জড়িত। বহিরাগতরা গিয়ে উসকে দিয়ে স্থানীয় কিছু উগ্রবাদীদের একত্রে করে হামলা ভাঙচুর চালায়। এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের ধরতে একযোগে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশের বেশ কয়েকটি ইউনিট।

পুলিশ জানায়, গত বুধবার থেকেই কুমিল্লায় অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিটের একটি দল কাজ করছে। শিগগিরই ধরা পড়বে ঘটনায় জড়িতরা।

কোরআন অবমাননার অভিযোগ ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ ও র্যাবের অভিযানে চার মামলায় এখন পর্যন্ত ৪০ জনকে পাঠানো হয়েছে কারাগারে।

সহিংসতার ঘটনার সঙ্গে জড়িত অন্যদের ধরতে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), র্যাব, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অভিযান চলছে।

কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনওয়ারুল আজিম বলেন, পবিত্র কোরআন অবমাননা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে চারটি মামলা করেছে। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা হয়েছে। অন্য দুটি মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইনে।

তিনি আরো বলেন, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ফয়েজ আহমেদ নামের এক ব্যক্তিকে। তিনি মোবাইলে ভিডিও ধারণ ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে লাইভ শেয়ার করেন, যা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। পরে এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে দুটি মামলার একটিতে ১৭ জন ও আরেকটি মামলায় ২১ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মোট ৪১ জনকে আটক করা হলেও যাচাই-বাছাই শেষে দুজনকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

ওসি জানান, ফেসবুকে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাতে গোলাম মাওলা নামের এক যুবককে গ্রেপ্তার করে র্যাব। ওই যুবক সংঘর্ষস্থলে এসে ছবি সংগ্রহ করেন। পরে ছবিগুলো এডিট করে ফেসবুকে শেয়ার করেন। গ্রেপ্তার ওই যুবককেও কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয় আদালত।

 কুমিল্লা জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) ফারুক আহমেদ বলেন, পুলিশের বেশ কয়েকটি ইউনিট একযোগে কাজ করছে। অভিযান চলছে। আমরা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হবেই।

কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (ডিসি) কামরুল হাসান বলেন, বুধবারের ঘটনার তিন সদস্যের একটি তদন্ত টিম গঠন করা হয়েছে। তারা আগামী সোমবার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন। আমরা প্রতিটা বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছি।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বলছেন, দু-এক দিনের তদন্তের অগ্রগতি সামনে আসতে পারে। র্যাব বলছে, মূল হোতাদের কয়েকজন নজরদারির মধ্যে আছে। দেশের বাইরে পালানোর পথও বন্ধ করা হয়েছে। জড়িতরা গা-ঢাকা দিলেও তাদের গ্রেপ্তার করে দ্রুত আইনের আওতায় আনতে একাধিক সংস্থা তৎপর রয়েছে।

একজন কর্মকর্তা জানান, ফেসবুক ও ইউটিউবে ভুল তথ্য দিয়ে ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর মধ্যে উত্তেজনা ছড়ানো তিন শতাধিক আইডি বন্ধ করতে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) চিঠি দিয়েছে পুলিশসহ একাধিক সংস্থা। কুমিল্লার ঘটনার পর বুধবার থেকে গতকাল শুক্রবার পর্যন্ত এসব আইডি শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে ফেসবুক ও ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে গতকাল পর্যন্ত দুইশ আইডি বন্ধ করেছে বিটিআরসি।

র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল কে এম আজাদ বলেন, ‘যারা নেপথ্যে থেকে ভূমিকা রেখেছিল তাদের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। এখনই এর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না। বড় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই পরিকল্পিতভাবে এসব ঘটনায় জড়িয়েছে একটি চক্র। জড়িতদের মধ্যে কেউ কেউ আছে যারা অতীতেও একই ধরনের ঘটনায় জড়িত ছিল। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেব। দ্রুত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করতে পারব বলে বিশ্বাস রয়েছে।’

বিটিআরসির ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মিত্র সাংবাদিকদের বলেন, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে তিনশর মতো আইডি বন্ধের অনুরোধ আমরা পেয়েছি। এর মধ্যে দুইশ বন্ধ করা হয়েছে। এসব ঘটনার শিকড়ে হাত দিতে হবে। যারা মূল হোতা তাদের শনাক্ত করা জরুরি। সেটা না হলে এর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা থাকবে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আফম আল কিবরিয়া বলেন, সিআইডিসহ আরো বেশ কিছু সংস্থা কাজ করছে। শুধু আইডি বন্ধ নয়, যারা এসব পরিচালনা করছে এমন অনেকের নাম তালিকাভুক্ত করে গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে তাদের ব্যাপারে তথ্য-প্রমাণ সরবরাহ করে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

অন্যদিকে কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে সারা দেশে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে পুলিশ-র্যাব ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বৃহস্পতিবার ২২ জেলায় বিজিবি মোতায়েন করা হয়। গত শুক্রবার আরো ১৩টি জেলায় বিজিবি নামানো হয়। সব মিলিয়ে ৩৫টি জেলায় বিজিবি মোতায়েন রয়েছে।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশন) লে. কর্নেল ফয়জুর রহমান বলেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের চাহিদা থাকলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিজিবি মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে যে কয়েকটি এলাকায় এখন পর্যন্ত অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব বেশি। ছদ্মবেশে যারা ধর্মভিত্তিক দলগুলোর হয়ে কাজ করছে, অনেকের সঙ্গে তাদেরও সন্দেহের তালিকায় রেখে তদন্ত চলছে। এ ছাড়া ‘৯৯৯’-এ ফোন করে যে ব্যক্তি প্রথম কুমিল্লায় সাজানো ওই ঘটনা পুলিশকে জানিয়েছিলেন তাকেও নজরদারিতে রাখা হয়েছে। এমনকি সেখানে প্রশাসনের উপস্থিতিতে প্রথম দিন সকালে অনেকে উগ্র আচরণ করেছিল। অপ্রীতিকর ঘটনার নেপথ্যে তাদের ভূমিকা নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। উত্তেজনা ছড়িয়ে তারা কুমিল্লার পরিস্থিতি ভিন্ন দিকে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। খুব দ্রুত এটি পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেই লক্ষ্যেই তারা তদন্ত এগিয়ে নিচ্ছেন।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads