• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

অপরাধ

চাঁদাবাজি সিন্ডিকেটে জিম্মি ফুটপাত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০৩ জানুয়ারি ২০২২

রাজধানীর ফুটপাতগুলো চাঁদাবাজি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি। যার কারণে বার বার উচ্ছেদ অভিযান চালিয়েও দখল মুক্ত করা যাচ্ছে না। সকালে উচ্ছেদে করলে সন্ধ্যায় আবার চলে যায় সিন্ডিকেটের দখলে। সিটি করপোরেশন ও সরকারের প্রচেষ্টাতেও দখলমুক্ত হচ্ছে না। সম্প্রতি রাজধানীর ফুটপাতের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। গত শনিবার রাতে অভিযান চালিয়ে ২ চাঁদাবাজকে টাকাসহ আটক করে র্যাব। এর আগে মিরপুরের ভাষানটেক এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪ জনকে আটক করা হয়। র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, তালিকা ধরে রাজধানীজুড়ে ফুটপাতের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হবে।

ফার্মগেটের ফুটপাত : তেজগাঁও কলেজ, ইন্দ্রিরা রোড ও ফার্মগেট মোড়ের এসব ফুটপাত দীর্ঘদিন ধরেই দখল হয়ে আছে। তবে স্থানীয়রা বলছেন, ফুটপাতে হকাররা ব্যবসা করলেও এর নেপথ্যে শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। হকারদের জিম্মি করে এসব সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রতিদিনই আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের চাঁদা। ব্যবসায়ী ও হকারদের দেওয়া তথ্যে অনুযায়ী, তেজগাঁও কলেজ, ইন্দ্রিরা রোড, আনন্দ সিনেমা হল সড়ক, গ্রিন রোড, খামারবাড়ি, হলিক্রস রোডসহ গোটা এলাকার ফুটপাতের দোকানগুলো থেকে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৬০০ টাকা পর্যন্ত চাঁদা আদায় হয়। তিন শতাধিক দোকান থেকে গড়ে প্রতিদিন এক লাখ টাকা তোলা হয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চায়ের দোকানি বলেন, ‘টাকা দিয়ে দোকান বসাইছি, আবার প্রতিদিন চাঁদাও দিতে হয়। এহানে বহার লাইগা প্রতিদিন টেকা দেওন লাগে। ৭০ বছর বয়সী একজন ডাব বিক্রেতা বলেন, আমার মতো বুড়রা মানুষের থেকে ২০০ টাকা লইয়া যায়।

তবে বেশিরভাগ দোকানিরা বলছেন, চাঁদা দিয়ে দোকান করতে হলেও আমাদের ব্যবসা তো হয়। ছেলে-সন্তান নিয়ে দুইমুঠো ডালভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি। মানুষও হাঁটুক, আমাদেরও ব্যবসা হোক।

নিউমার্কেট : রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকা ফুটপাতের চাঁদাবাজির অন্যতম বড় স্পট। রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রতিদিন ১০ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে একটি চক্র।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় এক ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতার নেতৃত্বে পুরো নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাতে বসা ব্যবসায়ীদের থেকে ১১ ভাগে চাঁদা আদায় করছেন লাইনম্যানরা (চাঁদা আদায়কারী)। দোকানভেদে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৪০০ টাকা নেওয়া হয়। স্থায়ী-অস্থায়ী প্রায় ৪ হাজার হকার রয়েছেন এ এলাকায়। প্রতিদিন ১০ লাখ টাকার বেশি চাঁদা তোলা হয় এসব ব্যবসায়ীর কাছ থেকে।

জানা যায়, দীর্ঘদিন ধরে পুরো নিউমার্কেট এলাকার ফুটপাত থেকে চাঁদা আদায় করে এ সিন্ডিকেট। হকারদের কাছ থেকে চাঁদা তুলতে জোনভিত্তিক দায়িত্ব দেওয়া আছে লাইনম্যানদের। টাকা আদায়ে এসব লাইনম্যানেরও রয়েছে সহযোগী। এর মধ্যে নীলক্ষেত বইপট্টি এলাকা থেকে চাঁদা তোলেন শাহিন ও তার সহযোগী শহিদ চাচা। বলাকা সিনেমা হলের সামনে (বলাকা সিনেমা হল থেকে রাফিন প্লাজা) লাইনম্যান সেলিম ও আরিফ। তাদের সহযোগী লাইনম্যান হকার বসির।

চাঁদনী চক মার্কেট ও গাউসিয়ায় প্রতিদিন এখানকার হকারের কাছ থেকে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা (দোকানভেদে) চাঁদা তোলা হয়। গাউসিয়ার সামনের ফুটওভার ব্রিজে হকারদের থেকে চাঁদা আদায় করেন লাইনম্যান কালাম। নিউমার্কেটের পূর্ব পাশে (২ ও ৩ নম্বর গেট) চাঁদা তোলেন আনিস ও মিজান। এ এলাকার একজন হকার আবদুল্লাহ বলেন, ‘আমি বিকাল পর্যন্ত তিনটি জামা বিক্রি করেছি। এতে আমার ৯০ টাকা লাভ হয়েছে। অথচ একটু পর লাইনম্যান মিজান এলে ২০০ টাকা দিতে হবে। একটু দেরি করলেই গালাগাল করে।’ নিউ সুপার মার্কেটের সামনে জুতাপট্টি এলাকায় চাঁদা তোলেন জলিলের নাতি জনি। মিরপুর রোডের পশ্চিম পাশের পুরো ফুটপাত দেখভাল করেন সাত্তার মোল্লা।

মিরপুর : মিরপুরের বেশিরভাগ ফুটপাতসহ মূল সড়কের এক-তৃতীয়াংশই রয়েছে চিহ্নিত চাঁদাবাজদের দখলে। ফুটপাত দখল করে অবৈধ স্থায়ী-অস্থায়ী বাজার বসিয়ে বিভিন্ন অঙ্কে চাঁদা আদায়ের মাধ্যমে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে এই চিহ্নিত চাঁদাবাজচক্র।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মুক্তবাংলা শপিং সেন্টারের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট, শাহ আলী মার্কেট, কো-অপারেটিভ মার্কেটের সামনে ফুটপাতসহ মূল সড়ক দখল করে বসে শত শত দোকান। ফলে এখান দিয়ে পায়ে হেঁটে চলাই দুষ্কর হয়ে পড়ছে। যানজট তো নিত্যনৈমিত্যিক চিরচেনা রূপেই লেগে থাকে।

মিরপুর ১ নম্বর সেকশনের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক চিড়িয়াখানা রোডের সনি সিনেমা হল থেকে শুরু করে ঈদগাহ মাঠ পর্যন্ত ফুটপাত ও সড়ক দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ বাজার। বাজারে কয়েক-শ দোকান বসিয়ে চলছে নিয়মিত চাঁদাবাজির মহোৎসব। থানা পুলিশ ও বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে প্রতিটি দোকান থেকে দৈনিক ২০০-২৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলা হচ্ছে বলে দোকানদারেরা অভিযোগ করেছেন। এছাড়াও মিরপুর ১০ থেকে শুরু করে পল্লবী, ভাষানটেক, রূপনগরের বিভিন্ন এলাকায় ফুটপাতে দোকান বসিয়ে চাঁদাবাজি হচ্ছে।

গুলিস্তান-মতিঝিল : গুলিস্তান, পল্টন, মতিঝিল থেকে শুরু করে একেবারে সদরঘাট পর্যন্ত ফুটপাতে গণহারে চাঁদাবাজি হয়। চাঁদা দিতে রাজি না হলে  ফুটপাতের ব্যবসায়ীদের মারপিট এবং হুমকি দিয়ে দোকান তুলে দেওয়া হয়। বায়তুল মোকাররম জিপিও লিংক রোডে হলিডে মার্কেটে খোকন মজুমদার, আবুল হাসেম, মজিবর, পোটল, নসু, হারুন ও তার সহযোগীরা চাঁদা আদায় করে। উত্তরগেট এলাকায় দুম্বা রহিম, সাজু চাঁদা তোলে। শাপলা চত্বরে আরিফ; পল্টনে দুলাল ও তার সহযোগী; গুলিস্তানে আহাদ পুলিশ বক্স ও রাস্তায় আমিন, সাহিদ ও লম্বা হারুন; জুতাপট্টিতে সালেহ; গোলাপ শাহ মাজারের পূর্ব-দক্ষিণ অংশে ঘাউড়া বাবুল ও শাহীন টাকা তোলে। এ ছাড়া ওসমানী উদ্যানের পূর্ব ও উত্তর অংশে লম্বা শাজাহান; গুলিস্তান খদ্দর মার্কেটের পশ্চিমে কাদের ও উত্তরে হান্নান, পূর্বে সালাম, আক্তার ও জাহাঙ্গীর; গুলিস্তান হল মার্কেটের সামনের রাস্তায় লাইনম্যান সর্দার বাবুল; সুন্দরবন স্কয়ার মার্কেটের উত্তর পাশের রাস্তায় জজ মিয়া, পূর্ব পাশের রাস্তায় সেলিম মিয়া; মওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে মো. আলী, আবদুল গফুর ও বাবুল।

উত্তরা : উত্তরায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ফুটপাতে অবৈধ দোকান বসিয়ে চলছে চাঁদাবাজি। উত্তর সিটি করপোরেশনের শেষ সীমানা টঙ্গী সেতুর ঢাল থেকে দক্ষিণ দিকে খন্দকার পেট্রোল পাম্প পর্যন্ত মহাসড়কের ফুটপাতে এসব অবৈধ স্থায়ী-অস্থায়ী দোকান বসানো হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, উত্তরার প্রভাবশালী নেতাদের মাসোয়ারা দিয়ে চলে এই চাঁদাবাজি। মতিয়ার রহমান মতি ও আইয়ুব আলী নামের দুই সহোদর প্রতিদিন ওই স্পট থেকে চাঁদা তোলেন।  মাছ, মাংস, মুরগি, মুদিসামগ্রী, কাপড়, ফল, সবজিসহ হরেকরকম মালামালের দোকান বসানো হয়েছে ওই এলাকার ফুটপাতে। দোকান বসানো, ঠিকমতো চাঁদা না দিলে উচ্ছেদ এসব নিয়ন্ত্রণ করেন মতি ও আইয়ুব। এ এলাকার ফুটপাতে অবৈধ দোকান বসানো হয়েছে ২০০। প্রতিদিন প্রকারভেদে দোকানপ্রতি চাঁদা নেওয়া হয় ২০০ থেকে ৭০০ টাকা। গড়ে ৪০০ টাকা হারে প্রতিদিন এসব দোকান থেকে চাঁদা তোলা হয় ৮০ হাজার টাকা।

একাধিক দোকানি জানায়, তাদের কাছ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় চাঁদার টাকা সংগ্রহ করেন আইয়ুব। আগে চাঁদার টাকা সংগ্রহ করতেন মতি। তবে চাঁদার টাকার নিয়ন্ত্রণ মতির হাতেই। মতি-আইয়ুব সহোদর মহাসড়কের ওই ফুটপাতে স্থায়ী কাঠামোয় একটি বিরিয়ানির দোকান দিয়েছেন।

এদিকে ফুটপাতের চাঁদাবাজির ব্যাপারে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছে র্যাব। তালিকা ধরে ধরে অভিযান শুরু হয়েছে। গত শনিবার মতিঝিল এলাকায় চাঁদাবাজির সময় হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দু-জনকে। এরা হলো সাইফুল ও মাসুদ। এ সময় তাদের নিকট থেকে চাঁদাবাজির ১ লাখ ৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়।

এর আগে বুধবার রাতে ভাষানটেক এলাকায় ফুটপাতে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি করার সময় তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন দেলোয়ার হোসেন (২৯), মো. হেলাল (৩৩), সোহেল রানা (২৮) ও মো. শাহীন।

র‍্যাব ৪ এর সহকারী পুলিশ সুপার সাজেদুল ইসলাম বলেন, গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে চাঁদাবাজির ১৪ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে মিরপুর ও ভাষানটেক থানায় মামলা করা হয়েছে।

র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে ফুটপাতের চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads