• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
৪০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ‘শেয়ার মিশন’

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

৪০০ কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা ‘শেয়ার মিশন’

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৬ জানুয়ারি ২০২২

সরকারি কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন। অবসরের পর একটু ভালোভাবে চলার আশা নিয়ে শেয়ার মিশন নামের অনলাইন মাল্টি লেভেল কোম্পানি (এমএলএম) এ বিনিয়োগ করেছিলেন ১১ লাখ টাকা। কোম্পানিতে বিনিয়োগ করলে ১০০ দিনে তা দ্বিগুণ হবে এমনটাই প্রচার করে আসছিলেন। কিন্তু বিনিয়োগের পর লাভ তো দূরের কথা এখন মূল টাকাই তার হারিয়ে গেছে। কোম্পানিই উধাও হয়ে গেছে। শেষ বয়সে এসে পেনশনের এই টাকা হারিয়ে এখন তিনি পাগল প্রায়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শাহাদাৎ হোসেনের মতো হাজার হাজার গ্রাহক বিনিয়োগ করেছিলেন শেয়ার মিশন নামের এ এমএলএম কোম্পানিতে। সাত আগে গড়ে উঠা এ কোম্পানিটি গ্রাহকের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা নিয়ে উধাও হয়ে গেছে। রাজধানীর ভাটারা থানায় কোম্পানির মালিক শুভ চৌধুরীসহ ৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়। মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে। ফাঁদ পেতে শুভ চৌধুরীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করলেও সিআইডির জাল থেকে বেরিয়ে যায়। তবে গ্রেপ্তার হয় কোম্পানির আরেক কর্মকর্তা সাইদুর রহমান।

শাহাদাত হোসেন বলেন, এই বয়সে একটু ভালো থাকার আশা নিয়ে এ বিনিয়োগ করেন। তাদের কথাবার্তা ভালো লেগেছিল এ কারণে টাকা বিনিয়োগ করি। কিন্তু এতবড় প্রতারণার মধ্যে পড়বো বুঝতে পারিনি। এখন আমার আমার একুলও গেল ওকুলও গেল। সামনে আমার ভবিষ্যৎ কি হবে এটি নিয়ে দিন কাটছে। কখনো এ টাকা ফেরত পাব কি না তা নিয়েও চিন্তায় আছি। তিনি প্রশাসনের নিকট প্রতারককে গ্রেপ্তার করে টাকা ফেরতের ব্যবস্থার জন্য অনুরোধ করেন। 

সিআইডি সূত্র জানায়, প্রায় সাত মাস আগে শেয়ার মিশন নামের এমএলএম কোম্পানি তৈরি হয়। রাজধানী ঢাকায় তাদের কয়েকটি অফিসও গড়ে তোলে। কয়েকজন কর্মীর মাধ্যমে তারা অনলাইন কেন্দ্রিক যাত্রা শুরু করে। প্রতিটি শেয়ারের মূল্য রাখে তারা ১ হাজার টাকা। বিনিয়োগে প্রথম দিন থেকে ১০০ দিন পর তা দ্বিগুণ হবে। এর পাশাপাশি সেন্টার কেন্দ্রিক বা বিনিয়োগকারী যদি কাউকে বিনিয়োগ করাতে পারে সেক্ষেত্রেও তাকে কমিশন হিসেবে টাকা দেওয়ার অফার দেয়।

সিআইডি বলছে, এটি মূলত একটি ফাঁদ ছিল। আর এ ফাঁদটি তারা অনলাইনে ব্যাপকভাবে ক্যাম্পেইন করে। মাত্র সাত মাসেই এ ফাঁদে পা দিয়ে দেশি ও প্রবাসীদের মিলে প্রায় ৪০ লাখ শেয়ার বিক্রি হয়। প্রতি শেয়ারের মূল্য ১ হাজার টাকা হিসেবে প্রায় ৪০০ কোটি হাতিয়ে নেয়।

সূত্র জানায়, বিনিয়োগকারীদের টাকা দেওয়ার সময় হতে না হতেই তারা টালবাহনা শুরু করে। পরে কয়েকজন ভুক্তভোগী ভাটারা থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলাটি এখন সিআইডি তদন্ত করছে।

সিআইডির ডিআইজি ইমাম হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আমাদের অনুসন্ধানে জানতে পাওয়ার পর কৌশলে বিনিয়োগকারী সেজে তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা করি। কিন্তু আমাদের জাল থেকে কোম্পানির পরিচালক শুভ চৌধুরী বেরিয়ে যায়। তবে আমরা সাইদুর রহমান নামের এক কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করি।

সাইদুরকে জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে সিআইডির এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, এমএলএমের শেয়ার বিক্রি, ডিলার নিয়োগ এমনকি চাকরি দেওয়ার নাম করেও টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন পরিচালক শুভ চৌধুরী। কোম্পানির শেয়ার বিক্রি নাম করেই ৪০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। 

তাকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে জানিয়ে ডিআইজি ইমাম হোসেন বলেন, সে যেন দেশ ছেড়ে পালাতে না পারে সে জন্য আমরা সার্বিক ব্যবস্থা নিয়েছি। বিমানবন্দর, স্থল বন্দরগুলোতে ম্যাসেজ পাঠানো হয়েছে। সিআইডির একাধিক টিম এ প্রতারককে গ্রেপ্তারে কাজ করছে।

বিনিয়োগকারী ভুক্তভোগী মামুনুর রশিদ বলেন, অফারটি দেখে প্রথমে ভালো লাগে। পরে পারিবারিক আরো স্বাচ্ছল্য আনার জন্য ২ লাখ ১১ হাজার টাকা বিনিয়োগ করি। এর মধ্যে একবার ৯ হাজার টাকাও পাই। কিন্তু পরে আর পাইনি।

তিনি বলেন, তাদের অফিস এবং সফট্যায়ারিং সিস্টেম দিয়ে তারা বোঝাতো। এতে করে অনেকে বিনিয়োগ করেন। তাদের একটি শেয়ার ১ হাজার টাকা হওয়ায় অনেকে আগ্রহীও ছিল। যার যা সাধ্য ছিল তাই বিনিয়োগ করেছে।

মামুনুর রশিদ বলেন, আমি নিজে ২শ শেয়ার কেনার পাশাপাশি কয়েক বন্ধুও মিলেও শেয়ার কিনেছি। কিন্তু এখন আমরা সবাই প্রতারণার শিকার হয়েছি।  

প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিভিন্ন এমএলএম, অনলাইন ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো নানা প্রলোভন দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অন্তত ৪০ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এরই মধ্যে। গ্রাহকরা তাদের বিনিয়োগের এই পুঁজি ফেরত পাবেন কিনা তা অনিশ্চিত। এমন প্রেক্ষাপটে প্রতারিত লাখ লাখ মানুষ পথে বসে গেছে।

অতি মুনাফার ফাঁদে ফেলে গ্রাহকদের টাকা লুটের সবচেয়ে বড় দুটি উদাহরণ ডেসটিনি ও যুবক। এ দুটি প্রতিষ্ঠান সাধারণ গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণা করে প্রায় ৭ হাজার ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। ৪ হাজার ১১৯ কোটি ২৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে বিচার চলছে ডেসটিনি গ্রুপের চেয়ারম্যান, ব্যবস্থাপনা পরিচালক, পরিচালকসহ ২২ জনের।

অতি মুনাফার লোভ দেখিয়ে গ্রাহকদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে যুব কর্মসংস্থান সোসাইটি বা যুবক। ১৯৯৬ সালে যুবকের নিবন্ধন দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মগুলোর নিবন্ধকের কার্যালয় (রেজসকো)।

কথিত মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি (এমএলএম) ইউনিপেটুইউতে ১০ মাসে দ্বিগুণ লাভের আশায় ৬ লাখ বিনিয়োগকারীর বিনিয়োগ করা ৬ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় চেয়ারম্যান শহীদুজ্জামান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনতাসির হোসেন। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১১ সালের ইউনিপেটুইউর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিনিয়োগকারীদের অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে মামলা করে। বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিষ্ঠানটির ওপর তদন্ত করেও এসব তথ্যের প্রমাণ পায়।

অতিরিক্ত মুনাফার লোভ দেখিয়ে ২০১৩ সালে প্রায় পাঁচ লাখ গ্রাহকের কাছ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয় আইসিএল গ্রুপ। পরবর্তীকালে নামসর্বস্ব ১৩টি প্রতিষ্ঠান ফেলে উধাও হয়ে যায় গ্রুপটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও মূল উদ্যোক্তা শফিকুর রহমানসহ পরিচালকরা। যদিও পরে গ্রুপটির মূল উদ্যেক্তা শফিকুর রহমান ও তার স্ত্রী আইসিএল গ্রুপের পরিচালক কাজী সামসুন নাহার মিনা র্যাবের হাতে আটক হন। তবে এখনো প্রতারিত গ্রাহকরা টাকা ফিরে পায়নি।

১৭ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ‘এহসান গ্রুপ পিরোজপুর-বাংলাদেশ’ নামের এক কোম্পানির চেয়ারম্যান রাগীব আহসান এবং তার এক সহযোগীকে সম্প্রতি গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। এহসান মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড, এহসান রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড বিল্ডার্স লিমিটেডসহ কয়েকটি মাদ্রাসা খুলে ওই কোম্পানি ব্যবসা চালিয়ে আসছিল।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads