• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

কুশীলবদের গ্রেপ্তারে চলছে চেষ্টা

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০২২

রাজধানীর শাহজাহানপুরে আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের গ্রেপ্তারে বিভিন্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। হত্যায় সরাসরি অংশ নেওয়া শুটার মাসুম গ্রেপ্তার হলেও কি কারণে বা কারা তাকে এ হত্যার মিশনে পাঠিয়েছিল সে সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেনি। গোয়েন্দারা বলছেন, জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলাম বেশ কয়েক বছর আগে যে টার্গেট কিলিংয়ে নেমেছিল সেখানে কাটআউট পদ্ধতি ব্যবহার করেছিল এই হত্যায় কুশীলবরা সেই পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। অর্থাৎ কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীরা কাউকে চিনে না। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, নেপথ্যের কুশীলবরা যতই পরিকল্পনা করুক না কেন তাদের ধরা পড়তেই হবে। সে লক্ষ্যে তারা কাজও করে যাচ্ছেন। এদিকে ভাড়াটে কিলার মাসুমকে গতকাল হাজির করা হলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কর্মকর্তারা বলছেন, হত্যার প্রাথমিক যে মোটিভ সেটি আসলে আধিপত্য বিস্তারের জেরে। টেন্ডার, ফুটপাতসহ নানা খাতের টাকা পয়সা নিয়ে কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটতে পারে। এমন বিষয়গুলোই সামনে রেখে তদন্তকাজ এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। যেহেতু মূল কিলার গ্রেপ্তার হয়েছে সেহেতু তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলে এ সংক্রান্ত আরো তথ্য বেরিয়ে আসবে। পাশাপাশি হত্যায় অংশ নেওয়া আরো একজনকে গ্রেপ্তারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, শুটার মাসুমকে পুরানো মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার লোভ দেখিয়ে এ কাজে ব্যবহার করা হয়েছে। তার সঙ্গে যে বন্ধুটি ছিল সে তাকে অস্ত্র দিয়েছে। কিন্তু এর বাইরে সে আর কারো নাম বলতে পারছে না। এক্ষেত্রে পরিকল্পনাকারী কাটআউট পদ্ধতি ব্যবহার করেছে। মাসুম ধরা পড়লেও এর নেপথ্যের কারিগররা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে।

ডিবির সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডে জড়িতরা যেন দেশের সীমানা অতিক্রম না করতে পারে এ কারণে দেশের কয়েকটি সীমান্ত এলাকায় নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাসুম জয়পুরহাট সীমান্ত দিয়ে দেশের বাইরে চলে যেতে চেয়েছিল। গোয়েন্দারা ধারণা করছেন অন্যরাও সীমান্ত অতিক্রম করতে পারে। 

এদিকে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের বলেন, হত্যার নেপথ্যে যারাই থাকুক সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। এ লক্ষ্যে পুলিশ ও র্যাব কাজ করছে। তিনি বলেন, তদন্তের স্বার্থে এখন অনেক কিছুই বলা যাচ্ছে না। সবাই গ্রেপ্তার হলে খুনের মোটিভ আপনাদের জানানো হবে। 

এদিকে স্থানীয় সূত্র বলছে, গত দুই বছর ধরে কমলাপুর রেল কলোনি ও শাজাহানপুর গরুর হাট নিয়ে মতিঝিল ছাত্রলীগের সাবেক এক নেতার সঙ্গে বিরোধে জড়ান টিপু। এর আগে তিনি বিদেশে ছিলেন। ক্যাসিনোকাণ্ডে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ জেলে যাওয়ার পর ওই ছাত্রলীগ নেতা কয়েক বছর আগে দেশে ফিরে এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে মরিয়া হয়ে উঠেন। এক পর্যায়ে খালেদের শাজাহানপুর এলাকার ডিশ ও ইন্টানেটের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে নেন। এ নিয়ে খালেদের নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এসব বিষয়ে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনী তৎপর হলে সেই নেতা কিছুদিন আত্মগোপনে যান। এই সুযোগে খালেদের বাগিচা এলাকার ক্যাডারদের নিয়ে টিপু ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা নিজের আয়ত্তে নেন। সমপ্রতি ওইসব ব্যবসা থেকে টাকার ভাগ পাচ্ছিল না খালেদ ও তার নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে খালেদের সঙ্গে টিপুর দূরত্ব বাড়তে থাকে। একই সময়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তিবাণিজ্যের একক নিয়ন্ত্রণ চলে যায় টিপুর হাতে। সমপ্রতি সেখানে ভাগ বসান মহানগর আওয়ামী লীগের এক প্রভাবশালী নেতা। সম্প্রতি রেলের একটি বড় ধরনের টেন্ডার নিয়ে মহানগর ওই নেতার সঙ্গেও বিরোধ সৃষ্টি হয় টিপুর। সব বিষয় নিয়ে টিপুবিরোধী পক্ষগুলো এক হয়ে খুনের পরিকল্পনা করে বলে স্থানীয় সূত্র দাবি করেছে।

সূত্র জানায়, পুরো ঘটনা সমন্বয় করা হয়েছে দেশের বাইরে থেকে। দেশের বাইরে থেকে কারা কাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছে পাশাপাশি মাসুমের কল লিস্টে কাদের যোগাযোগ ছিল সব তদন্ত করা হচ্ছে। দু-একদিনের মধ্যেই পুরো বিষয়টি সামনে চলে আসবে বলেও জানা গেছে।

সাত দিনের রিমান্ডে মাসুম : গ্রেপ্তার শুটার মো. মাসুম ওরফে আকাশের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল সোমবার তাকে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করে পুলিশ। এরপর মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাকে ১৫ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন তদন্ত কর্মকর্তা। শুনানি শেষে ঢাকার অতিরিক্ত মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট তোফাজ্জল হোসেন ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

সতর্ক করা হয় ফোনে : টিপু হত্যার পরদিন মামলা করেন তার স্ত্রী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর ফারহানা ইসলাম ডলি। ওই মামলার সূত্রে জানা যায়, হত্যার আগে ফোনে টিপুকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। বিষয়টির তদন্ত করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক ইউনিট। তবে টিপুর ঘনিষ্ঠ একজনের দাবি, হুমকি নয়, নিজের পরিচয় গোপন করে টিপুকে সতর্ক করেছিলেন তার এক শুভাকাঙ্ক্ষী।

ডলি মামলায় উল্লেখ করেন, ঘটনার ৪/৫ দিন আগে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারী তার স্বামীকে ফোনে হত্যার হুমকি দেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে, ডলি বলেন, ‘ঘটনার দুই দিন আগে সকালে বাসা থেকে বের হবার সময় উনি (টিপু) আমাকে বলেন, তার কাছে অপরিচিত নম্বর থেকে একটি ফোন এসেছে। ফোন দেওয়া ব্যক্তি বলেছেন, তার নাকি বিপদ, তাকে মেরে ফেলবে।’

আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম নম্বরটা রেখেছে কিনা। উত্তরে আমাকে বলল নম্বরটা বন্ধ বলছে। এর পরদিন এক অনুষ্ঠানে বিষয়টি মেয়রকে জানাতে চেয়েছিলাম, কিন্তু সুযোগ পাইনি। পরে ভাবলাম ২৬ মার্চের অনুষ্ঠানের পর বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি প্রশাসনের সহযোগিতা নেব। কিন্তু সেই সুযোগটা আর হল না।

টিপুর আস্থাভাজন ও মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সাবেক নেতা মো. মাহবুবুল হক হীরক বলেন, আমিও হুমকির বিষয়টি শুনেছি। তবে সরাসরি টিপু ভাইয়ের কাছে না। উনি খুব চাপা স্বভাবের ছিলেন, যেকোনো বিষয় নিজের মধ্যেই রাখতে পছন্দ করতেন। আর ভাই এগুলোকে গুরুত্বও দিতেন না। এমন হুমকি তো কতই আসে।

তবে টিপুর একটি বিশ্বস্ত সূত্রের দাবি, শবে বরাতের একদিন পর অপরিচিত নম্বর থেকে যে ফোনকলটি এসেছিল, তা হুমকি দিতে নয়, বরং সতর্ক করতে। ওই ফোনে তাকে সাবধানে থাকতে বলা হয়েছিল বলেও জানিয়েছেন নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক টিপুর ওই ঘনিষ্ঠজন।

টিপু ফোন কলটি পাওয়ার পরপরই ওই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তির সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। এই ব্যক্তি বলেন, ফোনে এক ব্যক্তি তার পরিচয় গোপন রেখে বলে, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, আমাকে চিনবেন না। আপনার সামনে বিপদ, আপনাকে মেরে ফেলবে, একটু সাবধানে থাকেন।’ এ কথা বলেই ওই ব্যক্তি ফোন কেটে দেয়।

এরপর টিপু ফোন ব্যাক করলে নম্বরটিতে আর সংযোগ পাওয়া যায়নি। তবে ওই ফোনে কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি। টিপুকে পছন্দ করে এমন কেউ তাকে হত্যার পরিকল্পনা জানিয়ে টিপুকে সতর্ক করতে চেয়েছিল। ওই ফোন পাওয়ার চার দিনের মাথায় টিপু খুন হয়। এখন তো মনে হচ্ছে হত্যার পরিকল্পনার সময় আশপাশেই টিপুর শুভাকাঙ্ক্ষী ব্যক্তিটি ছিল। ওই ব্যক্তি টিপুর ভালো চেয়েই সতর্ক করার চেষ্টা করেছে।

মামলায় হুমকির বিষয়টি উল্লেখ থাকায় শাহজাহানপুর থানা পুলিশসহ একাধিক বাহিনী তা যাচাইয়ে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এখন পর্যন্ত হুমকির বিষয়টি নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেনি কোনো বাহিনী।

ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, উনি (ডলি) একজন কাউন্সিলর, সেই সঙ্গে টিপু সাহেবেরও প্রশাসনের সঙ্গে খুবই ভালো সম্পর্ক। সুবিধা-অসুবিধা সব কিছুই তো আমাদের জানান, তাহলে হুমকি পেলে আমাদের জানালেন না কেন।

একই বিষয়ে জানতে চাইলে র্যাবের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, সত্যি বলতে কি, আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। তবে হুমকির বিষয়টি বিশ্বাসযোগ্য না। মেরে ফেলতে চাইলে হুমকি কেন দেবে, হুমকি দেওয়া হয় তো ভয় দেখাতে।

গত ২৪ মার্চ রাত ১০টা ২০ মিনিটের দিকে মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে বাসায় যাওয়ার পথে শাহজাহানপুর থানার আমতলা এলাকায় জাহিদুল ইসলাম টিপু, তার ড্রাইভার ও রিকশা আরোহী সামিয়া আফরান প্রীতি নামের এক তরুণীর ওপর গুলি চালান মো. মাসুম ওরফে আকাশ। 

তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও রিকশা আরোহী প্রীতিকে মৃত ঘোষণা করেন। ওই ঘটনায় শাহজাহানপুর থানায় একটি মামলা দায়ের করা হয়।

গোয়েন্দা মতিঝিল বিভাগ এ ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে। গত রোববার সকালে ডিবি জানায় শুটার মাসুমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বগুড়া জেলা পুলিশের সহযোগিতায় ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার মতিঝিল বিভাগের খিলগাঁও জোনাল টিম বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে বগুড়া থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads