• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

অপরাধ

রঙিন স্বপ্নে সর্বস্বান্ত

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ১৮ এপ্রিল ২০২২

রাজবাড়ী সদরের তোতা মিয়ার ৪ ছেলে মেয়ের মধ্যে ছোট ও একমাত্র ছেলে মিলন। পরিবারের অভাব অনটন দূর করতেই ছেলেকে বিদেশ পাঠানোর ইচ্ছে তার। বিদেশ যাওয়ার খবরে খুশি মিলনও। মিলনের মামাতো ভাই আলামিন থাকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। মিলন তার সঙ্গে যোগাযোগও করে। দুবাইয়ের যেহেতু ওয়ার্কিং ভিসা নাই সেহেতু ট্যুরিস্ট ভিসা যাওয়ার বন্দোবস্ত হয়। মামাতো ভাই আলামিনকে মিলন প্রায় দুই লাখ টাকা দেয়। সবকিছু ব্যবস্থা করে মিলনকে বিমানবন্দরেও নেওয়া হয়। কিন্তু সেখান থেকে অফলোড হয়ে ফিরে আসে।

এরপর থেকে মিলন ঢাকায় তার মামাতো ভাইয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগও করে যাচ্ছে কিন্তু এখনো তার যাওয়া হয়নি। ট্যুরিস্ট ভিসার এ ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে বহু মানুষ, তারপরও কেন যাওয়ার ইচ্ছে এমন প্রশ্নে মিলন বলে, ভাই আছে বিশ্বাস করা যায়।

প্রকৃতপক্ষে মিলনকে দালালচক্র এখনো ঘোরের মধ্যেই রেখেছে। মিলনের মতো হাজার হাজার বিদেশ যেতে ইচ্ছুকদের সঙ্গে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করছে একটি চক্র।

বিশেষ করে মধ্যেপ্রাচ্যের দেশ দুবাইয়ে নিয়ে যাওয়ার নাম করে লুটে নেওয়া হচ্ছে টাকা। আবার দুবাই নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে লিবিয়ায় নিয়ে জিম্মি করে মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। এরা গ্রামের সহজ সরল লোকদের টার্গেট করে তাদের ফাঁদে ফেলে টাকা আত্মসাৎ করে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর ভাটারার বিভিন্ন এলাকায় অফিস নিয়ে শত শত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে যাচ্ছে একটি গ্রুপ। আর এ গ্রুপের প্রধান ফয়সাল ও রহিম নামের দুই ব্যক্তি। ট্যুরিস্ট ভিসার ফাঁদ পেতে বিমানবন্দর কন্ট্রাক্টের নাম করে শত শত ব্যক্তির নিকট থেকে কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করে যাচ্ছে। ঘন ঘন অফিস পাল্টিয়ে নিজেদের আড়াল করার চেষ্টায় রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে দালাল ধরলেও এখন পর্যন্ত তারা বহাল তবিয়তে রয়েছে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাদের পাওনা টাকা ফেরত চাইতে গেলে নানা হুমকি দেয় এবং ঘন ঘন অফিস পরিবর্তন করে ফেলে। এমনকি ফোন নম্বরও বন্ধ করে দেয়। ভুক্তভোগীরা এ প্রতারকদের গ্রেপ্তার দাবি করেছেন।

এদিকে ফয়সালের মতোই কামরুলের পাতা ফাঁদে নিঃস্ব হয়েছে অন্তত ৫ শতাধিক পরিবার। বিদেশ পাঠানোর নাম করে ভ্রমণ ভিসা দিয়ে প্রতারণা করে আত্মসাৎ করেছেন অন্তত ৩০ কোটি টাকার ওপরে। নির্দিষ্ট কোনো পেশা না থাকলেও প্রতারণা এবং মানবপাচার তার নেশা। ২০১৯ সালে ভ্রমণ ভিসায় দুবাই যান। মানবপাচারের অর্থে দুবাইয়ের রেসিডেন্স ভিসা লাভ করেন। পরে প্রাইভেটকার চালিয়ে অর্থ উপার্জন করতেন।

করোনার সংকট শুরু হলে গাড়িটি বিক্রি করে ২০২১ সালে দেশে ফেরেন। পুনরায় জড়িয়ে পড়েন প্রতারণা এবং মানবপাচারে।

র‍্যাব বলছে, জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই কামরুলের। বিভিন্ন ট্যুর ও ট্রাভেলস এজেন্সির সাথে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে লোক পাঠান তিনি। এজন্য জনপ্রতি হাতিয়ে নেন ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। এভাবে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোকের কাছ থেকে প্রায় ৩০ কোটি টাকা হাতিয়েছেন।

সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ও গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সংঘবদ্ধ মানবপাচার ও প্রতারকচক্রের মূলহোতা কামরুলসহ চারজনকে গ্রেপ্তারের পর এসব তথ্য জানিয়েছে র‍্যাব-৩। চক্রের বাকিরা হলেন-খালেদ মাসুদ হেলাল (৩৬), তোফায়েল আহম্মেদ (৩৮) ও মো. জামাল (৪২)।

র‍্যাব ৩ অধিনায়ক (সিও) লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, প্রতারিত কয়েকজন ভুক্তভোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে র‍্যাব-৩ জানতে পারে, রামপুরা এলাকায় একটি মানবপাচার ও প্রতারকচক্র মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে ভুয়া ভিসা ও টিকিট সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক বেকার যুবক যুবতীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছে।

সহজ সরল বিদেশ গমনে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা বিমানবন্দরে প্রদর্শনের পর ভিসা ও টিকিট জাল হওয়ায় ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ তাদের বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দেয়।

এমন কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে র‍্যাব-৩ এর একটি দল গোয়েন্দা নজরদারি ও ছায়া তদন্ত শুরু করে। গত ১২ এপ্রিল মৌলভীবাজারের এক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে কামরুল রামপুরায় চক্রের সদস্য কামরুলের বাসায় নিয়ে আসেন। ওই বাসায় ভুক্তভোগী নারীকে আটক করা হয়। পরে চক্রের সদস্য তোফায়েল জোরপূর্বক ওই নারীকে ধর্ষণ করে। খবর পেয়ে র‍্যাবের একটি দল ১৩ এপ্রিল রাত পৌনে ৩টার দিকে ওই নারীকে উদ্ধার করে।

উদ্ধার হওয়া নারী জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তোফায়েল গৃহকর্মী হিসেবে তাকে সৌদি আরব পাঠানোর প্রলোভন দেখায়। এরপর সৌদিআরব যেতে হলে আরবি ভাষার ট্রেনিং করতে হবে, এ কথা বলে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসে ও কামরুলের বাসায় আটক রেখে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে।

র‍্যাব-৩ এর সিও বলেন, ঘটনার পর ওই নারী বাদী হয়ে রামপুরা থানায় নারী শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা দায়ের করেন।

ভুক্তভোগী নারীর দেওয়া তথ্য ও প্রযুক্তির সহায়তায় গত শুক্রবার দিবাগত রাতে রামপুরা ও হাতিরঝিল এলাকায় অভিযান চালিয়ে মানবপাচার ও প্রতারকচক্রের মূলহোতা কামরুল, সহযোগী খালেদ মাসুদ হেলাল, তোফায়েল ও জামালকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাদের কাছ থেকে ২৭টি পাসপোর্ট, ১টি কম্পিউটার, ১০০টি ভিসার কপি, ১২৫টি টিকিট, ৪টি মোবাইল ফোন ও প্রিন্টার উদ্ধার করা হয়।

অনুসন্ধান ও গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া তথ্যের বরাতে র‍্যাব-৩ সিও বলেন, কামরুল এ গ্রুপের মানবপাচারকারীচক্রের মূলহোতা। তাদের জনশক্তি রপ্তানির কোনো লাইসেন্স নেই। কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক পাঠিয়ে আসছিল। চক্রটি মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে জনশক্তি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ গমনে ইচ্ছুক বেকার যুবক যুবতীদের নিকট থেকে ৫-৭ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে জাল ভিসা ও টিকিট ভুক্তভোগীদের হাতে ধরিয়ে দেয়।

এ বিষয়ে প্রতিকার চাইলে চক্রের গ্রেপ্তার সদস্যরা যোগাযোগ বন্ধ করে বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে ফেলে। এভাবে গত ২ বছরে অন্তত আটবার ঠিকানা পরিবর্তন করেছে চক্রটি।

গত ৫ বছরে চক্রটি অবৈধভাবে শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়েছে। যারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে এই চক্র শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে জনপ্রতি ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিয়ে জাল ভিসা ও টিকিট সরবরাহ করে প্রায় ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।

চক্রের মূলহোতা কামরুল সম্পর্কে র‍্যাব-৩ সিও বলেন, জনশক্তি রপ্তানি লাইসেন্স না থাকায় বিভিন্ন ট্যুরস ও ট্রাভেলসের সাথে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে লোক পাঠিয়ে আসছিল কামরুল। তার নামে চট্টগ্রাম কোর্টে একটি চেক জালিয়াতির মামলা এবং মৌলভীবাজার কোর্টে ডাচ-বাংলা ব্যাংকে ১৮ লাখ টাকার একটি মামলা রয়েছে। তার বিভিন্ন ব্যাংক একাউন্টে ৩৮ লাখ টাকার ওপরে আছে বলে জানিয়েছে কামরুল।

এদিকে ট্যুরিস্ট ভিসার ফাঁদে পড়ে লিবিয়ায় আটক হয়ে জেলে থাকা ৭৪ জন দেশে  ফেরেন ২০ মার্চ। এর গত ১৪ মার্চ ১১৪ জন ফিরেছিলেন। সপ্তাহের ব্যবধানে সেই দেশের জেলে থাকা মোট ১৮৮ জন দেশে আসেন।  আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ও লিবিয়ায় অবস্থিত বাংলাদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে জেলে থাকা বাংলাদেশিরা দেশে আসলেন।

এদিকে মানবপাচার প্রতিরোধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গ্রামের দালাল থেকে শুরু করে শহরের ট্রাভেল এজেন্সির বিরুদ্ধে ত্রিমুখী অভিযানে নামছে। বিশেষ করে সিআইডি, র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ একযোগে এ অভিযান পরিচালনা করবে। লিবিয়া থেকে ফেরত ১১৪ জন বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই এ অভিযান শুরু হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।

র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক খন্দকার আল মঈন বলেন, র্যাব মানবপাচার প্রতিরোধে এর আগেও কাজ করেছে। লিবিয়াফেরত বাংলাদেশিরা যে তথ্য দিয়েছে তারই আলোকে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরালো করেছে। দ্রুত মানবপাচারকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হবে।

তিনি বলেন, যারা রঙিন স্বপ্নের ফাঁদে ফেলে দেশের মানুষকে বিপদে ফেলছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট করছে এদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।

সূত্র মতে, গত ২০২০ সালের ২৮ মে লিবিয়ার ত্রিপোলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ২৬ বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করে একদল মানবপাচারকারী। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন।

মানবপাচারকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশের মহাপরিদর্শক বেনজীর আহমেদের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনার পর মাঠ পর্যায়ে ব্যাপক তৎপরতা চালিয়ে ৫২ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads