• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

অপরাধ

বেপরোয়া হচ্ছে মজুতদাররা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ৩০ মে ২০২২

খাদ্যশস্য, তেলসহ নিত্যপণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দেশে এখন দরিদ্র ও হতদরিদ্রদের বেঁচে থাকা কষ্টসাধ্য। এসব মানুষের নিয়মিত আয় ও বাড়তি পরিশ্রমের উপার্জন এবং অতি কষ্টের সঞ্চয়ের অর্থ খেয়ে ফেলছে একশ্রেণির মুনাফাখোর আর মজুতদার সিন্ডিকেট। আইনে মুনাফাখোর, মজুতদার ও কালোবাজারি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকলেও তার বাস্তবায়ন নেই। ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের নাভিশ্বাস চলছে এসব সিন্ডিকেটের অযৌক্তিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির দুর্গতিতে।

আইনবিদদের মতে, ক্রেতাসাধারণকে ঠকিয়ে এভাবে ব্ল্যাকমেইলিং করে কালোবাজারি করা গুরুতর অপরাধ। এ ধরনের মুনাফাখোরদের আইনে সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু সরকারি বিভিন্ন সংস্থা মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালিয়ে কালোবাজারি ও মুনাফাখোরদের চিহ্নত করে শুধু জরিমানা করে ছেড়ে দেয়। এতে পার পেয়ে যাচ্ছে মজুতদার ও অসাধু ব্যবসায়ীরা। অভিযানে গিয়ে আর্থিক জরিমানা করাকে দায়সারা শাস্তি বলছেন তারা।

এদিকে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের আইনে মামলা করার সুযোগ না থাকায় বাধ্য হয়েই জরিমানা করতে হচ্ছে। তবে পুলিশ ও অন্য কোনো সংস্থা চাইলে বিশেষ ক্ষমতা আইনে ফৌজদারি মামলা করতে পারে মজুতদারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু এসব সংস্থা কোনো ব্যবস্থা না নিলে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর আইনে বড় ধরনের শাস্তি দেওয়ার সুযোগ নেই।

ভোজ্যতেল নিয়ে এদেশের অসৎ ও অতি মুনাফালোভী ব্যবসায়ীরা যা করেছে তাতে তাদের প্রকৃত চরিত্র ফুটে উঠেছে। চলতি বছরের শুরু থেকেই হঠাৎ ধাপে ধাপে ভোজ্যতেলের দাম বেড়ে যায়। কয়েকগুণ বেশি দামে সয়াবিন ও পাম অয়েল কিনতে ভোক্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে। দাম কমানোর জন্য শুল্ক কমানোসহ সরকার বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে। কিন্তু কিছুতেই এর দাম কমছে না। ভোক্তাদের জিম্মি করে এর আগে তারা পেঁয়াজ নিয়েও একই কাণ্ড করেছিল। এখন নতুন করে গত দুই সপ্তাহ ধরে যুক্ত হয়েছে গম বা আটা-ময়দার লাগামহীন দাম বৃদ্ধি। বাড়ছে চালের দামও।

মজুতদার মাফিয়া সিন্ডিকেটদের সরকারি কোনো সংস্থাই থামাতে পারছে না। টানা রমরমা ব্যবসা কালোবাজারি, মুনাফাখোর ও মজুতদারদের। মাঝেমধ্যে শাকসবজি বা পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ বা মরিচ ইত্যাদির আবার কখনোবা চাল-গমের দাম দেশি কৃষকদের ক্ষেতের উৎপাদনের নতুন ফসল ঘরে ওঠার সময়কালে দুই-তিন মাস সাময়িকভাবে কমে আসে। কিন্তু অচিরেই তা আবার বেড়ে যায়। এসব নিয়ন্ত্রণে সরকারের একটা মন্ত্রণালয় রয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নামের মন্ত্রণালয়ে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী থাকার পরেও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের ব্ল্যাকমেইলিং প্রক্রিয়া এমনই কঠিন যে, তাদের শাস্তিদানের মাধ্যমে বাজারদর নিয়ন্ত্রণে রাখা একেবারেই অসম্ভব। ব্যবসায়ীদের কাউকে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অতি মুনাফার শাস্তিদানের লক্ষ্যে জেল-জরিমানা করতে গেলে অথবা আদালতে নিয়ে বিচারের লক্ষ্যে গ্রেপ্তার করতে গেলে অসাধু সিন্ডিকেট সক্রিয় হয়। সরবরাহ ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টির চক্রান্ত চালায়। ফলে কৃত্রিম সংকট আরও বেড়ে গিয়ে বাজার পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে। এমনকি চাল, ডালের সরবরাহ একেবারে বন্ধ করে দিয়ে সংকট সৃষ্টি করতে পারে এ মুনাফাখোর সিন্ডিকেট- সে আতঙ্ক সরকার ও প্রশাসনকে তটস্থ করে রাখে।

রমজানের শুরুতে অর্থাৎ গত দুই মাস থেকে ভোজ্যতেল নিয়ে নৈরাজ্য সৃষ্টি হলে সরকার নড়েচড়ে বসে। বিভিন্ন পর্যায়ে শুল্ক কমিয়েছে। তারপরও এর সুফল পাচ্ছে না ভোক্তারা। মিল মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে তেলের লিটারে ১৬০ থেকে এক লাফে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা লিটার করা হয়েছে। তারপরও বাজার বাজারে তেলের সংকট রয়েছে। বিভিন্ন গুদাম ও বাজারে অভিযান পরিচালনা করলেই ধরা পড়ছে মজুত করা তেল। গত ১৫ মে চট্টগ্রামে ইপিজেড এলাকার একটি বাজারে মেসার্স বিসমিল্লাহ এন্টারপ্রাইজে অভিযানে তেলের দাম বাড়ানোর আগেই কেনা ৬ হাজার ১২০ লিটার সয়াবিন তেল মজুতের অভিযোগে আড়াই লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এর আগে ১২ মে জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রাজধানীর কয়েকটি বাজারে অভিযান চালায়। এ সময় রাজধানীর ওয়ারী থানার কাপ্তান বাজারে মেসার্স জনতা এন্টারপ্রাইজ থেকে অবৈধভাবে মজুত করা ৭ হাজার ৯৫৬ লিটার ভোজ্যতেল উদ্ধার করা হয়েছে, যা দাম বাড়ানোর অনেক আগে থেকে মজুত করা ছিল।

এসব বিষয়ে এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, মজুত না করলে কীভাবে লাখ লাখ লিটার তেল উদ্ধার হচ্ছে। দাম আরো বাড়ার সুযোগ নিতে তেল লুকাচ্ছেন কিছু ব্যবসায়ী। এভাবে ৯৯ শতাংশ প্রকৃত ব্যবসায়ীকে এক শতাংশও হেয় করতে পারে না। এদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনার দাবি করেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের এই নেতা।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইন গবেষক অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক বলেন, প্রচলিত আইনে বলা হয়েছে একজন পাইকারি বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৩০ মেট্রিক টন পরিমাণ পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুত রাখতে পারবেন। আর একজন খুচরা বিক্রেতা সর্বোচ্চ ৫ টন পরিমাণের পাম ও সয়াবিন তেল সর্বোচ্চ ২০ দিন মজুত করতে পারবেন। একইভাবে একজন আমদানিকারকও তার মোট আমদানিকৃত পাম বা সয়াবিন তেলের ২৫ ভাগ সর্বোচ্চ ৬০ দিন পর্যন্ত মজুত রাখতে পারবেন। শুধু ভোজ্যতেল নয়, কন্ট্রোল অব কমোডিটিজ অ্যাক্ট ১৯৫৬-এর সেকশন ৩ অনুযায়ী, ‘সরকার বা সরকার কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ প্রদত্ত লাইসেন্স ব্যতিরেকে কোনো ব্যবসায়ী এক মেট্রিক টনের অধিক খাদ্যশস্য বা খাদ্যসামগ্রী তার অধিকারে বা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন না।’ খাদ্যশস্য বলতে এখানে ধান ও চালকে বোঝানো হয়েছে। অপরদিকে চাল ও গমের ক্ষেত্রে সরকারের মজুত আইনের নীতিমালায় এর ভিন্নতা রয়েছে।

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ১৫ দিনে একটি রাইস মিল যে পরিমাণ ধান থেকে চাল প্রসেসিং করতে সক্ষম, ওই সময়ে মধ্যে উৎপাদন ক্ষমতার পাঁচগুণ ধান এবং দুইগুণ চাল মিল মালিকরা মজুত রাখতে পারবেন। এই পরিমাণ ধান-চাল সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে।

বিশেষ ক্ষমতা আইন : ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে মজুতদারি নিষিদ্ধ করে এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ২৫ (১) ধারার বলা হয়েছে, ‘কেউ মজুতদারি বা কালোবাজারে লেনদেনের অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে তার মৃত্যুদণ্ড, আজীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। যদি প্রমাণ হয় যে, মজুতদার কোনো লাভের জন্য পণ্য মজুত করেনি, তাহলে ৩ মাসের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হতে হবে।’ একই আইনের ২৫-ঘ ধারায় বলা আছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে যেসব কাজকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে, সেসব কাজ করার চেষ্টা করা বা কাজ করার সহযোগিতা করাও অপরাধ হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইনে মৃত্যুদণ্ডের সাজা হলে দোষী ব্যক্তিকে ৩৪(ক) ধারা অনুসারে ফাঁসি দিয়ে বা নির্ধারিত পদ্ধতি অনুসারে গুলি করে দণ্ড কার্যকর করারও বিধান রয়েছে। মজুতদারের অপরাধে বাংলাদেশে কারও মৃত্যুদণ্ড, আজীবন কারাদণ্ড বা ১৪ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে এমন নজির বিরল। তাহলে আমরা কি বলতে পারি যে, বাংলাদেশে কোন কালোবাজারি, মজুতদার নেই।

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে কোনো পণ্য গুদামজাত করার অপরাধে কারখানা, দোকান, গুদাম সাময়িক বন্ধ করার; পণ্য যথাযথভাবে বিক্রি ও সরবরাহ না করলে সর্বোচ্চ এক বছরের শাস্তি ও জরিমানার বিধান রয়েছে। কিন্তু এই আইনে মজুতদার ও কালোবাজারি বিষয়ে কিছুই বলা নেই। আবার প্রাইস কন্ট্রোল অ্যান্ড এন্টি হোর্ডিং অ্যাক্ট, ১৯৫৩-এর ৩ ধারায় বলা হয়েছে, ‘ব্যবসায়ীরা সুবিধাজনক জায়গায় বা নিজেদের দোকান ও গুদামের সামনে পণ্যের সর্বোচ্চ মূল্য তালিকা প্রদর্শণের ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য থাকবে। নির্ধারিত সর্বোচ্চ মূল্যে বিক্রয়ের তারিখ ও মেয়াদ সরকার নির্ধারণ করে দিতে পারবে।’ ধারা ৮-এ বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যবসায়ী সরকারের দেওয়া পূর্ব-কর্তৃত্ব ছাড়া কোনও ব্যক্তির কাছে কোনও অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের বিক্রি আটকে রাখতে পারবে না বা বিক্রি করতে অস্বীকার করতে পারবে না। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তি সর্বোচ্চ ৩ বছরের কারাদণ্ড বা ১ হাজার টাকা জরিমানা কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ পণ্যে অতিরিক্ত মূল্যে ক্রয়ের মাধ্যমে আপনি যদি ক্ষতির শিকার হন কিংবা পণ্য বা সেবা ক্রয়ে প্রতারিত হন তাহলে ৩০ দিনের মধ্যে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আবেদন করতে পারেন। অভিযোগের সঙ্গে প্রমাণাদি থাকলে যেমন যে প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সেটার প্রদত্ত বিল বা পণ্য সেবার ক্যাশ মেমো এবং যদি দৃশ্যমান জিনিস হয় তার ছবি থাকলে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। অপরাধটি সম্পর্কে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কিংবা অধিদপ্তরের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করতে হবে।

 

এতে অভিযোগকারির নাম, মা ও বাবার নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর, ফ্যাক্স ও ই-মেইল (যদি থাকে) উল্লেখ করতে হবে। অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে অভিযোগের ফর্মটি ডাউনলোড করা যায়। যেসব জেলায় অধিদপ্তরের শাখা নেই, সেসব জেলায় জেলা ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর আবেদন করতে হবে। সরাসরি বা ডাকযোগে পাঠাতে পারবেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে। তবে, ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে আবেদন না করলে অভিযোগ গ্রহণযোগ্য হবে না। অভিযোগের ভিত্তিতে ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায় আদায়কৃত জরিমানার ২৫ শতাংশ অভিযোগকারিকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রদান করা হয়। এ আইনের অধীনে সর্বনিম্ন পঞ্চাশ হাজার টাকা থেকে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হয়। জরিমানা ছাড়াও ব্যবসার লাইসেন্স বাতিল, ব্যবসায়িক কার্যক্রম সাময়িক বা স্থায়ীভাবে স্থগিতও করতে পারে অধিদপ্তর।

জাতীয় জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পরিচালক মনজুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, ভোক্তা সংরক্ষণ-২০০৯ আইন অনুযায়ী ভোক্তা স্বার্থ রক্ষা করতে সারা দেশে অভিযান পরিচালনা হচ্ছে। প্রায় দিন বিভিন্ন বাজারে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অনেকে সর্তক হলেও অনেকে অতি মুনাফার লোভ সামলাতে পারছে না। তাই সুযোগ পেলেই মজুত করছে বিভিন্ন পণ্য। তবে ভোক্তা আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আরো কঠোর আইন প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন হলে তখন হয়ত অনেকটা খাদ্যপণ্য মজুতের পরিমাণ কমে যেতে পারে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads