• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯
কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে বিপথে শিক্ষার্থীরা

প্রতীকী ছবি

অপরাধ

কিশোর গ্যাংয়ে জড়িয়ে বিপথে শিক্ষার্থীরা

  • আশুলিয়া প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ৩০ জুন ২০২২

দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে ‘কিশোর গ্যাং’। উদ্ভট সব নামে এলাকাভিত্তিক নতুন সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তুলছে তারা। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও এসব বাহিনীতে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের হাতে হাতে এখন দেশি অস্ত্রের ছড়াছড়ি। রয়েছে অত্যাধুনিক বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্রও।

এসব কিশোর অপরাধীর বেশিরভাগই মাদকসেবী। তুচ্ছ ঘটনায় যখন তখন অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে হামলা করছে প্রতিপক্ষের ওপর। এছাড়া ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক বিক্রি, ইভটিজিং, অপহরণ, ধর্ষণসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এদের একাংশের আছে মোটরসাইকেলও। মুঠোফোনের সহজলভ্যতা ও ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে তারা ব্যবহার করছে অস্ত্র হিসেবে। তথ্য ও ছবি আদান-প্রদানের পাশাপাশি হামলার নির্দেশনা দিচ্ছে অনলাইনে। নিজেদের শক্তি দেখাতে খুন পর্যন্ত করতে দ্বিধা করছে না ভয়ঙ্কর এই অপরাধীরা।

বিভিন্ন সময় দেখা গেছে, স্কুল ফাঁকি দিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন গ্রুপ নিয়ে ঘুরছে। সেখানে তথাকথিত বড় ভাইরা তাদের নানা অপরাধের অপকৌশল শিখিয়ে দিচ্ছে। এসব তথ্য প্রশাসনের হাতে আসার পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা হতবাক হয়ে পড়ছেন, অপরাধের সঙ্গে স্কুল ছাত্রদের জড়িত থাকার তথ্যে চমকে উঠেন। এ নিয়ে মা-বাবা, অভিভাবক, আত্মীয়-স্বজন চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছেন।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামাজিক এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে কিশোর অপরাধসহ সব ধরনের অপরাধ থেকে মুক্ত রাখতে সচেষ্ট হতে হবে। অনেক সময় রাজনৈতিক আশ্রয়-প্রশ্রয়ও কিশোর অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আমাদের নেতাদের উচিত হবে না কোন অপরাধীকে প্রশ্রয় দেওয়া। সমাজের সচেতন ব্যক্তিবর্গকেও এগিয়ে আসতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো পরিবারের ইতিবাচক ভূমিকা। মা-বাবা, অভিভাবকদের নিজেদের সন্তানদের ব্যাপারে নিয়মিত খবরাখবর রাখতে হবে। কার কার সঙ্গে সে বন্ধুত্ব করছে, কোথায় কখন কী করছে, কোথায় যাচ্ছে ইত্যাদির ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। সন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে তাদের চেষ্টার কমতি থাকতে পারবে না। ছোটবেলা থেকে শিশুদের সুশিক্ষা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে। দিতে হবে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা। আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোতেও শিক্ষামূলক, নৈতিক বিষয়বস্তু সংযোজন করতে হবে। নীতিহীন শিক্ষা থেকে শিশু-কিশোরদের বাঁচাতে এর কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি আইনের আওতায় এনে অপরাধীর কঠোর শাস্তির নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধের সঙ্গে জড়িত সংশ্লিষ্টদের মানসিক অবস্থার উন্নয়নের জন্য কাউন্সেলিং করা যেতে পারে। কিশোর অপরাধকে কোনোভাবেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। গোড়াতেই নির্মূল করতে হবে কিশোর গ্যাং।

পুলিশ বলছে, কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা আগের তুলনায় এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। সমপ্রতি মাদক সহজলভ্য না হওয়ায় চুরি-ছিনতাইয়ে নামছে তারা। গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, সারাদেশেই গ্যাং কালচারের অস্তিত্ব রয়েছে। প্রতিটি গ্রুপে রয়েছে ২০ থেকে ৩০ জন সদস্য। এদের অধিকাংশ সদস্যেরই বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। মূলত এ গ্যাং কালচারের সদস্যরা কিশোর বলে গণ্য হওয়ায় দণ্ডবিধিতে পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। কারণ অপরাধ ঘটিয়ে ফেললেও তাদের আটক করে শিশু-কিশোর সংশোধনাগারে পাঠানোর নিয়ম। এ সুযোগই কাজে লাগাচ্ছে অনেকে। তারাই অর্থ ও ক্ষমতার লোভ দেখিয়ে বিভ্রান্ত কিশোরদের দিয়ে নানা অপরাধমূলক কার্যক্রম করিয়ে নিচ্ছে। অথচ ঢাকার শিশু আদালতের বিচারিক কার্যক্রমের নথি অনুযায়ী, গত ১৫ বছরে রাজধানীতে কিশোর গ্যাং কালচার ও সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্বে ৯০টিরও বেশি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক হত্যায় অভিযুক্ত ছাত্র সেই ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু ওরফে ‘জিতু দাদা’ কিশোর গ্যাং লিডার ছিল। ঘটনাটি ২৪ জুনের। শনিবার মেয়েদের ক্রিকেট খেলা চলছিলো। এ সময় প্রতিষ্ঠানের দুই তলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছেলেরা খেলা দেখছিলো। অভিযুক্ত শিক্ষার্থীও দুই তলায় খেলা দেখছিল। সকাল থেকেই তার হাতে স্ট্যাম্পটি ছিলো। হঠাৎ সে দুই তলা থেকে নেমে মাঠের এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শিক্ষক উৎপলকে স্ট্যাম্প দিয়ে এলোপাতাড়ি আঘাত করে। পরে আহতাবস্থায় তাকে উদ্ধার করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই টানা দুই দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে সোমবার ভোরের দিকে মৃত্যু হয় ওই শিক্ষকের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জিতুর সহপাঠিরা জানায়, আমরা জিতুর বিভাগেই পড়ি। জিতু ভালো ছাত্র ছিল না। তার আচরণও অনেকটা অন্যরকম। মনে হয় যেকোনো সময় যে কাউকে মারধর করবে। তার খুব প্রভাব ছিল, কোনো ছাত্র যদি তার কথা না শুনতো তাহলে তাদের ধরে শাস্তি দিতো। উৎপল স্যার এগুলো দেখে তাকে ধরে প্রিন্সিপালের কাছে অনেকবার নিয়ে গেছেন। কিন্তু কোনো লাভ হয়নি।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, জিতু আসলে অনেকটাই বেপরোয়া। তার সঙ্গে স্কুলের ছেলেদের চেয়ে বাইরের ছেলেদের চলাচল বেশি ছিল। অনেক রাত পর্যন্ত সে বাইরে থাকতো। তার নেতৃত্বে একটি গ্রুপ চলতো। সবার বসয় প্রায় ১৭ থেকে ১৮ এর ভেতর। কিশোর গ্যাংয়ের লিডারের মতই জিতুর চলাফেরা ছিল। জিতুকে সবাই ‘জিতু দাদা’ বলেই চিনে। তার ফেসবুকেও জিতু দাদা নাম রয়েছে।

এ বিষয়ে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এইচ এম কামরুজ্জামান জানান, উৎপল কুমার সরকার হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গত রোববার (২৬ জুন) আশুলিয়া থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন তার বড় ভাই আসীম কুমার সরকার। এই হত্যা মামলার আসামি ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতুর বাবা উজ্জ্বল হোসেনকে কুষ্টিয়ার কুমারখালী থেকে গতকাল বুধবার ভোরে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

সকালে ১০ দিনের রিমান্ড চেয়ে তাকে ঢাকার মুখ্য বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়েছে। মামলার প্রধান আসামি জিতুকেও গ্রেপ্তারে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে।’ এছাড়া মঙ্গলবার হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত স্ট্যাম্পটি জব্দ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads