• মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যবসার খবর

মোবাইল ব্যাংকিং

এক মাসে লেনদেন ৯০ হাজার কোটি টাকা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ জানুয়ারি ২০২২

করোনাভাইরাসের কারণে মোবাইল ব্যাংকিং‌য়ে আগে বছরগুলোর তুলনায় কয়েকগুণ বেড়েছে। শুধু এক মাসের হিসেবের দিকে তাকালেই তা চোখে পড়ে। গেল বছর নভেম্বর মাসে বিভিন্ন মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে ৯০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন করেছেন গ্রাহকরা।

সরাসরি ব্যাংকিং সেবায় ভিড় ও ঝামেলা এড়াতে বিকাশ, রকেট, নগদের মতো মোবাইলে আর্থিক সেবাদাতা-এমএফএস প্রতিষ্ঠানের লেনদেন বাড়াচ্ছেন সংশ্লিষ্ট সুবিধা ব্যবহারকারীরা। যাতে করে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-সবার ক্ষেত্রেই বাড়ছে মোবাইলে লেনদেন।

খুবই দ্রুত শহর কিংবা গ্রামে সর্বত্রই টাকা পাঠানোর সুবিধার ফলে সারা দেশে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

এখন মোবাইল ব্যাংকিং শুধু টাকা পাঠানোর মাধ্যম নয়। এর ব্যবহার হচ্ছে সব ধরনের ছোট ছোট লেনদেনে। বিশেষ করে পরিষেবা বিল পরিশোধ, স্কুলের বেতন পরিশোধ, কেনাকাটা, সরকারি ভাতা গ্রহণ, টিকিট ক্রয়, বীমার প্রিমিয়াম পরিশোধ, মোবাইল রিচার্জ ও অনুদান প্রদানের অন্যতম মাধ্যম এমএফএস। আর মোবাইল ব্যাংকিংয়ে টাকা জমা করতে এখন আর এজেন্টদের কাছেও যেতে হচ্ছে না। ব্যাংক বা কার্ড থেকে সহজেই টাকা আনা যাচ্ছে এসব হিসাবে। আবার এসব হিসাব থেকে ব্যাংকেও টাকা জমা শুরু হয়েছে, ক্রেডিট কার্ড বা সঞ্চয়ী আমানতের কিস্তিও জমা দেওয়া যাচ্ছে। একটি মুঠোফোনই যেন একেকজনের কাছে নিজের ব্যাংক হয়ে উঠেছে। যার কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে গ্রাহক ও লেনদেনের পরিমাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মোবাইল আর্থিক সেবার (এমএফএস) হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, গত বছরের নভেম্বর মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে গ্রাহকরা প্রায় ৬৮ হাজার কোটি টাকা লেনদেন করেছেন। প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হয় ২ হাজার ২৬৬ কোটি টাকা। তবে ডাক বিভাগের সেবা নগদের তথ্য এখানে হিসাব করা হয়নি। নগদে লেনদেন হয়েছে প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা। সে হিসেবে গত বছরের নভেম্বরে মোট লেনদেন হয়েছে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা। আর দৈনিক লেনদেন হয়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা।

সং‌শ্লিষ্টরা জানান, তাৎক্ষণিকভা‌বে দ্রুত শহর থেকে গ্রামে; গ্রাম থেকে শহরে-সর্বত্র টাকা পাঠানোর সুবিধার কারণে দেশে মোবাইল ব্যাংকিং সেবায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ফলে গ্রাহক সংখ্যার স‌ঙ্গে বাড়‌ছে লেনদেনের পরিমাণ। এছাড়া করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে মানুষ সরাসরি ও নগদ লেনদেনের চেয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে ক্যাশলেস লেনদেনে বেশি নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। পাশাপাশি এখন শ্রমিকদের বেতন-বোনাস, সরকারের সামাজিক সুরক্ষার বিভিন্ন ভাতা ও অনুদান মোবাইল ব্যাংকিংয়ে পাঠানো হয়।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এমএফএস এ গত বছরের নভেম্বরে মোট ৩২ কোটি ৩৭ লাখ ৫০ হাজার ৬৭২টি লেনদেনের মাধ্যমে ৬৭ হাজার ৯৬৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা লেনদেন হয়েছে।

বর্তমানে মোট ১৩টি ব্যাংক মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে জড়িত আছে। ২০২১ সালের নভেম্বর মাস শেষে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে নিবন্ধিত গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ কোটি ৯৬ লাখ ৫৪ হাজারে। এর মধ্যে গ্রামে ৬ কোটি ১৭ লাখ এবং শহরের গ্রাহক সংখ্যা ৪ কোটি ৭৯ লাখ। এছাড়া নিবন্ধিতদের মধ্যে পুরুষ ৬ কোটি এবং মহিলা গ্রাহক প্রায় ৫ কোটি রয়েছে। আর আলোচিত সময়ে মোবাইল ব্যাংকিং এজেন্টের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ লাখ ৬ হাজার ৮৫৪ জনে।

গত অক্টোবরে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে লেনদেন হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। ৪৩ শতাংশ লেনদেন হয়েছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে ও ৫৭ শতাংশ নগদে। এখন যাদের হাতে রয়েছে মুঠোফোন বা মোবাইল, তাদের বেশির ভাগেরই রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাবও। কারণ, হিসাব খুলতে কোনো খরচ নেই, আবার মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ায় এখন একজন গ্রাহকের একাধিক হিসাবও রয়েছে। গ্রাহকের মধ্যে এখন ডিজিটাল লেনদেনের আগ্রহ বাড়ছে।

গত অক্টোবরের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের ৪৩ শতাংশই এখন ডিজিটাল লেনদেন। আর প্রায় ৫৭ শতাংশ লেনদেন হচ্ছে নগদ অর্থ জমা ও উত্তোলনে। ২০১৯ সালের একই সময়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাত্র ৩০ শতাংশ ছিল ডিজিটাল লেনদেন। আর ৭০ শতাংশ লেনদেন হতো নগদ অর্থ জমা ও উত্তোলনে। সেই হিসাবে, দুই বছরের ব্যবধানে ডিজিটাল লেনদেন বাড়ছে, তার বিপরীতে কমেছে নগদ অর্থ জমা ও উত্তোলন।

মোবাইল ব্যাংকিংয়ের আওতায় গ্রাহকেরা এখন সরকারি নানা পরিষেবার বিল প্রদান, পরিবার-পরিজনকে টাকা পাঠানো, কেনাকাটা, বেতন-ভাতা, মোবাইল রিচার্জ বাবদ লেনদেন বাড়িয়ে দিয়েছেন। এর ফলে এই সেবায় দিনে দিনে নগদ অর্থ লেনদেন কমে আসছে। এই প্রবণতা অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

বাংলাদেশ ব্যাংক ১৩টি এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানের তথ্য নিয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তাতে দেখা গেছে, গত বছরের অক্টোবরে এই সেবায় লেনদেন হয়েছে ৬৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে যা ছিল ৬৫ হাজার ১৪১ কোটি টাকা। গত অক্টোবরে মোট লেনদেনের মধ্যে টাকা জমা হয়েছিল ২১ হাজার ৪৯ কোটি ও উত্তোলিত হয়েছিল ১৭ হাজার ৬৮১ কোটি। ফলে মোট লেনদেনে ৫৭ শতাংশই ছিল জমা ও উত্তোলন। বাকি ৪৩ শতাংশ লেনদেন হয়েছে ডিজিটাল। এর আগে গত বছরের মে মাসে মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সর্বোচ্চ ৭১ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল।

রকেট নামে এমএফএস সেবা দিচ্ছে ডাচ্-বাংলা ব্যাংক। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোবাইল ব্যাংকিং সেবার অন্যতম একটা উদ্দেশ্য ছিল নগদ টাকার লেনদেন কমিয়ে আনা। কারণ, নগদ লেনদেন কমলে অবৈধ অর্থের ব্যবহার কমে আসবে। প্রথম দিকে টাকা জমা ও উত্তোলন বেশি হলেও এখন তা অনেকটা কমে আসছে। ওয়াসার বিল পরিশোধে এখন রকেট শীর্ষে। পাশাপাশি কেনাকাটা, মোবাইল রিচার্জও ভালো হচ্ছে। এতে নগদ লেনদেন কমে গেছে।

বাংলাদেশে মোবাইলের মাধ্যমে আর্থিক সেবার যাত্রা শুরু হয় ২০১১ সালের মার্চে। বেসরকারি খাতের ডাচ্-বাংলা ব্যাংক প্রথম এ সেবা চালু করে। পরে এটির নাম বদলে হয় রকেট। এরপর ব্র্যাক ব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে এমএফএস সেবা চালু করে বিকাশ। পরবর্তী সময়ে আরো অনেক ব্যাংক এ সেবায় এসেছে। তবে খুব সুবিধা করতে পারেনি। বর্তমানে বিকাশ, রকেটের পাশাপাশি মাই ক্যাশ, এম ক্যাশ, উপায়সহ ১৩টি ব্যাংক এই সেবা দিচ্ছে। এ বাজারের ৭০ শতাংশের বেশি বিকাশের নিয়ন্ত্রণে, এরপরই রকেটের। বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোর কিছু লেনদেন হচ্ছে। ব্যাংকের বাইরে ডাক বিভাগের সেবা ‘নগদ’ও এই সেবা দিচ্ছে, যারা এমএফএস বাজারের বড় অংশ এরই মধ্যে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে।

 কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, গত অক্টোবরে একজন গ্রাহক অন্য গ্রাহককে ১৯ হাজার ৭১০ কোটি টাকা স্থানান্তর করেছে, কেনাকাটা হয়েছে ২ হাজার ৯৫৩ কোটি টাকা, সরকারি ভাতা বিতরণ হয়েছে ৪৪ কোটি টাকার, বেতন প্রদান করা হয়েছে ২ হাজার ৩৮৭ কোটি টাকা ও মোবাইল রিচার্জ হয়েছে ৬৬৬ কোটি টাকা।

এদিকে এখন গ্রাহকেরা ঘরে বসেই ডিজিটাল কেওয়াইসি (গ্রাহকসম্পর্কিত তথ্য) ফরম পূরণ করে সহজেই এমএফএস সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানে হিসাব খুলতে পারছেন। ফলে গ্রাহক হওয়ার যে ঝামেলা, তা-ও মিটে গেছে।

করোনার মধ্যে এই সেবার ব্যবহার আরো বেড়ে গেছে। কারণ, করোনার মধ্যে পোশাক শ্রমিকদের বেতন-ভাতা যায় এই সেবার মাধ্যমে। আর এখন সরকারি বেশির ভাগ ভাতা বিতরিত হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে। আর বিল পরিশোধে এখন অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে মোবাইল ব্যাংকিং।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads