• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯

ব্যবসার খবর

বেড়েই চলেছে ডলারের দাম

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ এপ্রিল ২০২২

টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে। ডলারের চাহিদা বাড়তে থাকায় সম্প্রতি ডলারের দামে খানিকটা অস্থিরতাও তৈরি হয়েছে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম এখন ঠেকেছে সর্বোচ্চে। এ সংকট কাটাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে প্রতিদিন ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। ব্যাংক কিংবা খোলা বাজারে নগদ ডলার কিনতে এখন গুনতে হচ্ছে ৯২ টাকার মতো।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চাহিদা অনুযায়ী ডলারের জোগান কমে গেছে দেশের মুদ্রাবাজারে। এমন পরিস্থিতিতে আমদানি দায় পরিশোধে কোনো ব্যাংক যেন সমস্যায় না পড়ে সেজন্য ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এছাড়া বিলাসপণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণসহ আরো কিছু নীতি নির্ধারণী পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে গত কয়েকদিনে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ডলারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের যা যা করণীয়, তা-ই করছে। তিনি জানান, সরবরাহ বাড়াতে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একইসঙ্গে বিলাসবহুল পণ্য আমদানিকে নিরুৎসাহিত করতেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি ডলারের সরবরাহ বাড়াতে ‘ডলার বন্ডে’ সীমাহীন বিনিয়োগের সুযোগ করে দিয়েছে সরকার। প্রবাসীদের জন্য চালু থাকা এ বন্ডের সুদের হারও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে সুদ আকারে ডলার দেশ থেকে বের হয়ে যাওয়া কমে যাবে। আবার এ বন্ডে বিনিয়োগ বাড়লে ডলার দেশে ঢুকবে।

এর আগে গত ১১ এপ্রিল এক সার্কুলারে বাংলাদেশ ব্যাংক জরুরি ছাড়া অন্য পণ্য আমদানিতে এলসি খোলার ক্ষেত্রে নগদ মার্জিন হার ন্যূনতম ২৫ শতাংশ সংরক্ষণের নির্দেশনা দিয়েছে।

ব্যাংক কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, টাকার বিপরীতে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সতর্ক পদক্ষেপেও কাজে আসছে না। অর্থাৎ আন্তঃব্যাংক লেনদেনে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েই চলেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার বিক্রির মাধ্যমে বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। পাশাপাশি আন্তঃব্যাংকে মৌখিকভাবে ডলার ঠিক করে দিচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এলসি খোলার জন্য বর্তমানে প্রতি ডলারের দাম ৮৬ টাকা ২০ পয়সায় ঠিক করে দেওয়া হয়েছে। গত আগস্টের শুরুতে যেখানে আন্তঃব্যাংকে প্রতি ডলারের দাম ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায়।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী,গত মঙ্গলবার আন্তঃব্যাংক লেনদেনে প্রতি ডলারের দর ছিল ৮৬ টাকা ২০ পয়সা। কিন্তু বুধবার আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলারে কিনতে খরচ হ‌য়ে‌ছে ৮৬ টাকা ৪৫ পয়সা। গত ১ মার্চ যা ছিল ৮৬ টাকা। এক বছর আগে ২০২১ সালে এ দর ছিল ৮৪ টাকা ৮০ পয়সা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে এক দশমিক ৯০ শতাংশ দাম বেড়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, কোভিড মহামারি পরবর্তী আমদানি বাড়তে থাকার পাশাপাশি বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে অতিরিক্ত ডলার ব্যয় হচ্ছে। এর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ ও শিক্ষা ব্যয়ের জন্যও ডলারের চাহিদা বেড়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ফেব্রুয়ারিতে আমদানি ব্যয় পরিশোধ করা হয়েছে ৮৩২ দশমিক ৪৮ কোটি ডলার, যা এক বছর আগের একই মাসের তুলনায় প্রায় ৪৯ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি।

এদিকে দেশে পণ্য আমদানির ঋণপত্র বা এলসি খোলার পরিমাণ বাড়ছে অস্বাভাবিকভাবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে (জুলাই-মার্চ) ৬ হাজার ৮৩৬ কোটি ১৮ লাখ (৬৮.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৬ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বেশি। অর্থাৎ  টাকার অঙ্কে চলতি অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে ৫ লাখ ৮৯ হাজার ২৬৩ কোটি টাকার এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তারা। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের কাছাকাছি।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, আমদানি ব্যয় বৈদেশিক মুদ্রার জোগানে চাপ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমদানির লাগাম টানার পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, রপ্তানি ও রেমিট্যান্স   বাড়লেও আমদানি ব্যয় তার চেয়ে বেশি হচ্ছে। আমদানি বেড়ে যাওয়ার কারণেই ডলারের চাপ বেড়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, রপ্তানি করতেও আমাদের আমদানি করতে হয়। ভোগ্যপণ্যের জন্যও আমদানি করতে হয়। তিনি মনে করেন, উৎপাদন বাড়িয়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া আর কোনও পথ নেই।

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর  বলেন, এখন থেকেই অপ্রয়োজনীয় খরচ কমাতে সরকার ও দেশের সব ধরনের মানুষকে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। তিনি উল্লেখ করেন, যে করেই হোক আমদানি কমাতে হবে। এছাড়া এখন আর অন্য কোনো পথ খোলা নেই।

ব্যাংক কর্মকর্তারা ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন ধারাবাহিকভাবে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্যে। এ প্রসঙ্গে ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির সরাসরি প্রভাব পড়েছে আমদানিতে।  আর এ কারণে বাড়ছে পণ্যের ব্যয়। জিনিসপত্রের দাম সে কারণেই বেড়ে যাচ্ছে। তিনি জানান, জিনিসপত্রের দাম বাড়ার পাশাপাশি চিকিৎসাসহ বিভিন্ন প্রয়োজনে বিদেশ যেতে যাদের নগদ ডলারের প্রয়োজন তাদেরও গুনতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ।

চলতি অর্থবছরে গত ২১ এপ্রিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে রেকর্ড পরিমাণ ৪৫৬ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যদিও গত অর্থবছরে বাজার থেকে ৭৯৪ কোটি ডলার কিনতে হয়েছিল।

বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে এ পর্যন্ত যে পরিমাণ ডলার বিক্রি করেছে তাতে বাজার থেকে উঠে এসেছে ৩৯ হাজার কোটি টাকার মতো। যদিও গত অর্থবছর ডলার কেনার বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাজারে যায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। অবশ্য গত অর্থবছর কয়েকটি ব্যাংকের কাছে ২৩ কোটি ৫০ লাখ ডলার বিক্রি করে ২ হাজার কোটি টাকা বাজার থেকে উঠে আসে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরে জুলাই-মার্চ সময়ে এলসি খুলতে সবচেয়ে বেশি বিদেশি মুদ্রা খরচ হয়েছে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাকশিল্পের কাঁচামাল কাপড় ও অন্য পণ্য আমদানিতে। এর পরিমাণ ৯৬৬ কোটি ৬০ লাখ (৯.৬৬ বিলিয়ন) ডলার, গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা ৪৩ দশমিক ৩১ শতাংশ বেশি।

সুতা আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৮৭ কোটি ৬ লাখ ডলারের যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৩ দশমিক ৫৭ শতাংশ বেশি। তুলা ও সিনথেটিক ফাইবার আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৩৩২ কোটি ৯০ লাখ ডলারের। ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি ৩৫ দশমিক ৭৬ শতাংশ।

রাসায়নিক দ্রব্য ও সার আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৪১৮ কোটি ১৮ লাখ ডলার। ব্যয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৭৫ দশমিক ৪২ শতাংশ। এ ছাড়া ওষুধের কাঁচামালের এলসি খোলা হয়েছে ৯১ কোটি ৯২ লাখ ডলারের। অর্থাৎ আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে ২০ দশমিক ২৫ শতাংশ।

শিল্পের মধ্যবর্তী কাঁচামাল আমদানির জন্য ৬৩৫ কোটি ৫১ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৪৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ বেশি।

মূলধনি যন্ত্রপাতি বা ক্যাপিটাল মেশিনারিস আমদানির জন্য ৪০৭ কোটি ৭৩ লাখ ডলারের এলসি খুলেছেন ব্যবসায়ী। যা আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে বেড়েছে ৪৯ শতাংশ। শিল্পের মধ্যবর্তী পণ্যের জন্য এলসি খোলা হয়েছে ৫৫৪ কোটি ৮৩ লাখ ডলার; প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৫৫ দশমিক ৭২ শতাংশ। জুলাই-মার্চ সময়ে জ্বালানি তেল আমদানির জন্য ৩১৯ কোটি ১৯ লাখ ডলারের এলসি খোলা হয়েছে। বেড়েছে  ১২৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। খাদ্যপণ্যের মধ্যে গম আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৭৩ কোটি ৯২ লাখ ডলার। আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে   ৪২ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।

চিনি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ৮৭ কোটি ৫৪ লাখ ডলারের। প্রবৃদ্ধি ৭৮ দশমিক ৭৭ শতাংশ। ভোজ্যতেল আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১৬২ কোটি ৭১ লাখ ডলারের; বেড়েছে ৫৬ দশমিক ৬৩ শতাংশ। এ ছাড়া অন্যান্য পণ্য ও শিল্প যন্ত্রপাতি আমদানির এলসি খোলা হয়েছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ৭৬ লাখ ডলারের। অর্থাৎ এক্ষেত্রে আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৩৫ শতাংশ।

একদিকে ডলারের চাহিদা মেটাতে বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে ৩৯ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া সম্প্রতি বেড়েছে বেসরকারি খাতে ঋণের চাহিদা। অন্যদিকে করোনায় ক্ষতিগ্রস্তরা টাকা ফেরত দিতে পারেনি। তারল্য সংকটের চিত্র দেখা যায়, কল মানি মার্কেটে। বর্তমানে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ পর্যন্ত সুদে যা লেনদেন হচ্ছে। গত মাসের শেষ দিনে গড়ে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ সুদ ছিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে কলমানিতে লেনদেন ও সুদহার ছিল অনেক কম। বছরের প্রথম কর্মদিবস ২ জানুয়ারি কল মানি মার্কেটে সুদহার ছিল গড়ে ২ দশমিক ৭২ শতাংশ থেকে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে টানাটানির কারণে অনেক ব্যাংক এখন আগের মতো সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে টাকা খাটাতে চাইছে না। যে কারণে কলমানির পাশাপাশি ট্রেজারি বিলের সুদহারও বাড়তির দিকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads