• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা

ফাইল ছবি

ব্যবসার খবর

পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা মানুষ

মূল্যস্ফীতি আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৩ মে ২০২২

সর্বত্রই এখন মূল্যস্ফীতির রাজত্ব। সকল পণ্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধিতে দিশেহারা মানুষ। বর্তমানে দেশের মূল্যস্ফীতি খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাসকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সরকারি মূল্যস্ফীতির পরিসংখ্যানে প্রকৃত বাজারমূল্যের প্রতিফলন নেই। এমনকি মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে নেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকেরও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ।

যদিও আমদানি ব্যয়ের রাশ টেনে ধরতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কিছু উদ্যোগ নিয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সাময়িক উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি সংস্থাগুলো থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগের অভাব রয়েছে। বৈশ্বিক পূর্বাভাস দেখে মনে হচ্ছে পণ্যের বাড়তি দামের বিষয়টি আর সাময়িক থাকছে না। সমপ্রতি বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসা ও বিনিময় হারে চাপ বৃদ্ধির কারণে এই মূল্যস্ফীতি আরো বাড়ার আশঙ্কা করছেন তারা। 

মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ায় হাঁসফাঁস করছে ভোক্তারা, সেইসঙ্গে দেখা দিয়েছে প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। এ কারণে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারতের মতো দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে উদ্ভূত মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফনের মধ্যে নিজেদের অর্থনীতি সচল রাখতে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে। ঋণ ও ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে গত কয়েক সপ্তাহে তারা প্রধান সুদহারগুলো বাড়িয়েছে।

বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রাকে (৫ দশমিক ৫ শতাংশ) ছাড়িয়ে গেছে। বিলাসবহুল পণ্য আমদানি রুখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এলসি মার্জিন উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ালেও ব্যাংক রেট বা রেপো রেট বাড়ানোর মতো কঠোর আর্থিক পদক্ষেপ নেওয়ার চিন্তা এখনো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেই।

সরকার চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হার ৫ দশমিক ৫ শতাংশের নিচে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও মার্চে দেশের অর্থনীতি ৬ দশমিক ২২ শতাংশ পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি দেখেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রকাশিত গত ১২ মাসের চলমান গড় মূল্যস্ফীতিও বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।

তবে অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, বিবিএস যে তথ্য দিয়েছে, তার তুলনায় সমপ্রতি বাজারমূল্য দ্রুত বাড়ছে। ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) দৈনিক পণ্যের মূল্য বুলেটিনেও পণ্যের দাম বেশি।

গতকাল প্রকাশিত টিসিবির তথ্য বলছে, ১১৮ টাকা লিটারে বিক্রি হওয়া খোলা তেলের দাম ১৯২ টাকায় উঠেছে। ভোজ্যতেলের দাম প্রকার ও পরিবেশনের ধরন অনুযায়ী ৪৮ শতাংশ থেকে ৬৬ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। আটার দাম ৪০ শতাংশ ও ময়দার দাম বেড়েছে ৬০ শতাংশ পর্যন্ত। একইসঙ্গে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে পেয়াঁজ, রসুন, আদা, মরিচসহ সব ধরনের মসলা ও মাছ-মাংসের দাম।

দেশের জনসাধারণের মনেও এখন আকাশছোঁয়া দামের রাজত্ব। রাস্তার পাশের চায়ের স্টলে সাধারণ মানুষ কিংবা টেলিভিশন টক শোতে বিশেষজ্ঞরা, সবাই-ই জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় ও মাথাপিছু আয়ের সরকারি তথ্যের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করছেন। আগামী তিন মাসে আমাদের মাথাপিছু আয় ২৩৩ ডলার বেড়ে ২,৮২৪ ডলারে পৌঁছবে।

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির প্রকৃত তথ্য প্রকাশে অনীহার পাশাপাশি সরকারের সংস্থাগুলো থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগেরও অভাব রয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধির কারণে দেশের বাজারে মূল্যস্ফীতি বাড়ছিল। সামপ্রতিক সময়ে বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে আসা ও বিনিময় হারে চাপ বৃদ্ধির কারণে এই মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে।

অন্যদিকে গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে ইউএস ফেডের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েল বলেন, মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি এবং আমরা বুঝতে পারছি যে এটি অসুবিধা সৃষ্টি করছে। আমরা এটি কমানোর জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি। নিম্ন-আয়ের মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপের কথা উল্লেখ করে তিনি মূল্য স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথা জানান।

যুক্তরাজ্যের মূল্যস্ফীতি ১৯৮২ সালের পর সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। এতে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা বাড়িয়েছে। এই আশঙ্কাও আটকে রাখতে পারেনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডকে। আকাশচুম্বী জীবনযাত্রার ব্যয়ের মধ্যে লাখ লাখ পরিবারকে সাহায্য করতে ব্যাংকটি ১৩ বছরের মধ্যে তাদের সুদহার সর্বোচ্চ করেছে।

ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর অ্যান্ড্রু বেইলি বলেছেন, তারা ‘সংকীর্ণ পথে হাঁটছেন’ এবং ব্যাংক রেট কেবল বর্তমান মূল্যস্ফীতি নয়, প্রত্যাশিত ভবিষ্যৎ-মূল্যস্ফীতি মোকাবিলা করতেও বাড়ানো হয়েছে। এমনিক পণ্যমূল্য পুরোপুরি নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই রেপো রেট বাড়ানোর মাধ্যমে পদক্ষেপ নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক, রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া।

এ অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংকের পদক্ষেপ অপ্রতুল বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, দেশের মূল্যস্ফীতি খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বাভাসকেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারপরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবেনি। মূল্যস্ফীতির বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়নি।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ পর প্রকাশিত আর্থিক নীতি পর্যালোচনা ২০২১-এ, বিশ্বব্যাপী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ব্যাপারে সতর্ক করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে বলেছিল, ভূরাজনৈতিক দ্বন্দ্বের কারণে মূল্য আরো বাড়তে পারে, ফলে দেশে মূল্যের চাপ তৈরি হতে পারে। এর ফলে মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে রাখতে ব্যর্থ হতে পারে সরকার। কেন্দ্রীয় ব্যাংক মূল্যস্ফীতি রুখতে অর্থ সরবরাহ কমানোর সুপারিশ করলেও তারা নিজেরাই বর্তমান সমপ্রসারণমূলক ও সামঞ্জস্যপূর্ণ আর্থিক অবস্থান ধরে রেখেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির গত মাসে এক নীতি সভায় বলেন, মূল্যস্ফীতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা (৫দশমিক ৫ শতাংশ) থেকে বাড়তে পারে। আগামী অর্থবছরের জন্য ৫ দশমিক ৬ শতাংশ মূল্যস্ফীতি প্রাক্কলনের অনুরোধ করেন তিনি ওই সভায়। সভায় অর্থ সচিব আবদুর রউফ তালুকদার সতর্ক করে বলেন, ভর্তুকি কমানো হলে এবং জ্বালানি ও সারের দাম বাজারের সাথে সমন্বয় করা হলে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশের পর ভর্তুকি কমানো হয়নি। জ্বালানি ও সারের দামও বাড়ানো হয়নি।

তারপরও মূল্যস্ফীতি ফেব্রুয়ারিতে ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ থেকে মার্চে ৬ দশমিক ২২ শতাংশে এ উঠে যায়। মার্চে মাসিক গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৭৫ শতাংশ, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশের চেয়ে বেশি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) ডিস্টিংগুইশড ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, জাতীয় বাজেটের পাশাপাশি সরকারের মুদ্রা নীতিতে চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির ৫ দশমিক ৫ শতাংশের লক্ষ্য থাকলেও পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবেই আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ভোক্তা মূল্যসূচক বেড়েছে ৬ দশমিক ২২ শতাংশ। মার্চ মাস পর্যন্ত ১২ মাসের গড় মূল্যস্ফীতিও লক্ষ্যের অনেক ওপরে। যদিও বাজারে নিত্যপণ্যের দাম পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া তথ্যের চাইতে অনেক বেশি।

করোনা থেকে বিশ্ব অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের প্রক্রিয়া শুরু হলেই চাহিদা বৃদ্ধির কারণে গ্যাস, তেলসহ জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ছিল। ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হলে প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম দফায় দফায় বেড়ে যায়। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে এমন অবস্থায় চলে গেছে যে আমাগীতে মূল্যস্ফীতি না বাড়লেও চলমান উচ্চমূল্যের কারণে অনেকের জীবন নির্বাহ কঠিন হয়ে পড়বে, বলেন তিনি।

তিনি আরো বলেন, আমাদের বর্তমান মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ অতিমাত্রায় আমদানি-নির্ভরতা। তেল, সার, জ্বালানি, খাদ্যসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করতে বাড়তি ব্যয় হচ্ছে। এ সময়ে রপ্তানি বৃদ্ধির পেছনেও রয়েছে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল আমাদনির ব্যয়।

সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড.  সেলিম রায়হান বলেন, বৈশ্বিক পূর্বাভাস দেখে মনে হচ্ছে পণ্যের বাড়তি দামের বিষয়টি আর সাময়িক থাকছে না। যুদ্ধের প্রভাব, উপকরণের দাম, বিভিন্ন দেশের উৎপাদন পর্যালোচনায় মনে হচ্ছে চলতি বছরের পুরোটা জুড়েই পণ্যের দাম বেশি থাকবে। এ অবস্থায় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেও সাময়িক উদ্যোগ খুব একটা কাজে আসবে না।

ড. সেলিম রায়হান আরো বলেন, বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতির বিষয়ে কথা বলতে গেলেই দুটি বিষয় প্রথমেই সামনে আসে। প্রথম কথা হলো পরিসংখ্যান ব্যুরোর মূল্যস্ফীতির হিসাব বাস্তবসম্মত কি না? সরকারের এই তথ্য বাজারের প্রকৃত অবস্থা রিপ্রেজেন্ট করে কি না, এমন প্রশ্ন সানেমের পক্ষ থেকেও ওঠানো হয়েছে। আমার ধারণা, সরকারের মূল্যস্ফীতির তথ্যে অনেকটাই আন্ডার-এস্টিমেট রয়েছে। বাস্তবে হয়তো বাজারে গিয়ে দেখা যাবে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, এই মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষ থেকে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে, তা যথেষ্ট কি না? এ অবস্থায় নন-এসেনশিয়াল পণ্য ও ভোগ্যপণ্যের আমদানি নিরুৎসাহিত করার কোনো বিকল্প থাকছে না।  

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads