গাজী মিজানুর রহমান একাধারে বিসিএস ক্যাডার, লেখক, মোটিভেশনাল স্পিকার ও ক্যারিয়ার স্পেশালিস্ট। বর্তমানে তিনি বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে কুমিল্লার নওয়াব ফয়জুন্নেছা সরকারি কলেজে কর্মরত। পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের ক্যারিয়ার উন্নয়নে ক্যারিয়ার বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকেন। লিখেছেন ক্যারিয়ার ও চাকরিপ্রত্যাশীদের জন্য বই। ক্যারিয়ার বিষয়ক বিভিন্ন সেমিনার ও পত্রিকায় লেখালেখি করছেন নিয়মিত। জীবন ও ক্যারিয়ার সম্পর্কে অনলাইন ও অফলাইনে শিক্ষার্থীদের মোটিভেশনও দিয়ে থাকেন তিনি। ক্যারিয়ার ও চাকরি বিষয়ক বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন—অরণ্য সৌরভ
আপনার মতে, ক্যারিয়ার কী?
গাজী মিজানুর রহমান : ‘ক্যারিয়ার’ বলতে বোঝায় জীবনের পথে অগ্রগতি বা অগ্রসরণ। অর্থাৎ মানুষ যখন তার জীবনে ভালো অগ্রগতি সাধন করতে পারে, তখন সে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারে। আমরা সাধারণভাবে সেই সব কাজ করি, সেগুলো যেমন ক্যারিয়ার নয়; আবার কোনো চাকরি বা পেশাকেও ক্যারিয়ার বলা যায় না। বরং ক্যারিয়ার বলতে সব ধরনের কাজ, চাকরি, পেশা বা জীবনের অভিজ্ঞতার সমন্বিত রূপকে বোঝায়, যা কোনো ব্যক্তিকে তার পেশাগত জীবনে সাফল্যমণ্ডিত করে। কারণ, ক্যারিয়ারের মূল উদ্দেশ্যই হলো নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা কাজে লাগিয়ে জীবনের অগ্রগতি ও উন্নতি সাধন।
চাকরি হিসেবে সরকারি আর বেসরকারিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
গাজী মিজানুর রহমান : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সরকারি চাকরির ডিমান্ড বেশি। কারণ, সরকারি চাকরির স্যালারি যা-ই হোক না কেন সোস্যাল স্ট্যাটাস ও জব সিকিউরিটি বেশ ভালো বলা চলে। অন্যদিকে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেসরকারি চাকরির স্যালারি বেশি হলেও জব সিকিউরিটি কম থাকায় এবং অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, অফিস ওয়ারের পরও স্যালারিবিহীন কাজ করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত; তাই অনেকে প্রথম দিকে বেসরকারি চাকরিতে আসতে চান না বলে আমি মনে করি।
বর্তমান সময়ে ব্যাপক হারে তরুণদের বিসিএস মুখী হওয়ার কারণ কী?
গাজী মিজানুর রহমান : বিসিএস এতো জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। প্রথমত, যদি বলি ২০১৫ সালে সরকার যে অষ্টম পে-স্কেল দিয়েছে। এই পে-স্কেলে সরকারি অফিসারদের স্যালারি প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। এটার পরে মানুষ কিন্তু প্রাইভেট সেক্টর থেকে সরকারি সেক্টরের দিকে ছুটেছে। এক্ষেত্রে বিসিএসকে তো সরকারি চাকরির মধ্যে উপরের স্তর ধরা হয়। যারা সরকারি চাকরি করতে চায়, তারা হয়তো বিসিএস ক্যাডার হতে চায় অথবা তা না পেলে নন ক্যাডারের মাধ্যমে ভালো কোনো চাকরি পেতে চায়। স্যালারি ডাবল করার কারণে মানুষ বিসিএসের দিকে ঝুঁকছে। আরেকটা ব্যাপার হলো- সরকারি নিয়োগ পরীক্ষাগুলোতে বিভিন্ন সময়ে প্রশ্নপত্র ফাঁস হওয়া, এমনকি কোনো বেসরকারি সেক্টরে রেফারেন্সে জব হওয়া এ ধরনের অনেক অভিযোগ বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকা ও সংবাদে দেখা যায়। এ বিষয়গুলো দেখার পর উচ্চশিক্ষিত তরুণরা ডিমোটিভেটেড হচ্ছে।
এ থেকে উত্তরণের উপায় কী?
গাজী মিজানুর রহমান : প্রথমত, আমাদের প্রচুর কর্মস্থানের পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার দরকার বেশি। প্রায় দেখা যায় যে, চাকরি-প্রত্যাশীরা যে বিষয়ে গ্রাজুয়েশন করেছে কিংবা বিসিএস ও সরকারি চাকরির প্রস্তুতির জন্য যেসব বিষয়ে পড়াশোনা করছে তা পরবর্তী কর্মজীবনে খুব একটা কাজে আসছে না। এটা পরিবির্তন হওয়া উচিত। এছাড়াও আরেকটি বিষয় এই ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ- পড়ালেখা করলেই বিসিএস ক্যাডার হতে হবে, সরকারি চাকরি করতে হবে; এই ট্রেন্ড ও থিংকিংয়ে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে।
শেষ সময়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগে অংশগ্রহণকারীদের জন্য পরামর্শ?
গাজী মিজানুর রহমান : শেষ সময়ে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য আমি বলব, এই মুহূর্তে গুরুত্বপূর্ণ টপিকগুলো বেশি বেশি রিভিশন দেয়া দরকার। বিসিএস প্রিলির বিগত সালের প্রশ্ন, বিশেষ করে ৩৫তম-৪৩তম বিসিএস প্রিলির প্রশ্নগুলো জোর দেওয়া উচিত। পরীক্ষার ঠিক কয়েকদিন আগে প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ মডেল টেস্ট দিয়ে পরীক্ষার আগে নিজের প্রস্তুতি যাচাই করে নেওয়া প্রয়োজন।
যেকোনো প্রতিযোগিতামূলক চাকরির প্রস্তুতি বিষয়ে আপনার পরামর্শ?
গাজী মিজানুর রহমান : আমি বলব, প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় টিকতে হলে আগে প্রতিযোগিতা করার সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। সেজন্য কোনো বিষয়ে দুর্বলতা থাকলে সেটায় সবার আগে ওভারকাম করতে হবে।
চাকরির বাইরে অন্যকিছুতে ক্যারিয়ার গড়াকে কীভাবে দেখেন?
গাজী মিজানুর রহমান : ক্যারিয়ার বলতে কেবল বিসিএস ক্যাডার হওয়া, সরকারি চাকরিজীবী হওয়া কিংবা ব্যাংকার হওয়াকে বোঝায় না। ক্যারিয়ার হতে পারে ফ্রিল্যান্সিং, সাংবাদিকতা, ক্রিকেট, ফুটবল, উদ্যোক্তা কিংবা ব্যবসা অথবা অন্য কিছু। অর্থাৎ যার যেটা ভালো লাগে। ক্যারিয়ার প্ল্যান করার ক্ষেত্রে নিজের পছন্দের যত জোর দেওয়া যায়, ততই ভালো ক্যারিয়ার গড়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তাই আমি বলব, আপনি অন্যের দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে বরং আপনার যেটা করতে ভালো লাগে কিংবা যেটায় আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে, আপনি সেটা নিয়ে ক্যারিয়ার গড়ুন।
সরকারি এবং বেসরকারি চাকরির পরীক্ষা প্রস্তুতি কী একই হবে?
গাজী মিজানুর রহমান : না। সরকারি ও বেসরকারি চাকরির প্রস্তুতির মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। শুধু তা-ই নয়, সব সরকারি চাকরির প্রস্তুতিও এক নয়। আমি মনে করি, সরকারি চাকরি ক্ষেত্রে অনেক তথ্য জানতে হয়। অন্যদিকে, বেসরকারি চাকরির ক্ষেত্রে তথ্য কিছু কম জানাশোনা থাকলেও চলে; তবে কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে পারলে বেসরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকা যায়।
বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ক্যারিয়ার গড়ার চ্যালেঞ্জটা কোথায়?
গাজী মিজানুর রহমান : আমি মনে করি, বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে ক্যারিয়ার গড়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থানের স্বল্পতা এবং যে, যে যে সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়তে চায়, সেই সেক্টরের দক্ষতার অভাব।
বেকার তরুণদের উদ্দেশে কিছু বলুন-
গাজী মিজানুর রহমান : ২০১৬-২০১৭ সালে 'বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো' (বিবিএস) সর্বশেষ রিপোর্টের তথ্যমতে, দেশে বেকার সংখ্যা ২৭ লাখ। সম্প্রতি বিআইডিএস এর প্রকাশিত এক সমীক্ষা অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা ৬৬% শিক্ষার্থী বেকার। এ সমীক্ষা বলে দিচ্ছে, দেশের বেকার পরিস্থিতির দুর্বিষহ অবস্থা। বেকাররা যদি কেবল চাকরি আশায় বসে না থেকে উদ্যোক্তা হতে পারে কিংবা কোনো বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে পারে আমি মনে করি এই পরিস্থিতি দ্রুতই সহনীয় পর্যায়ে নামিয়ে আনা সম্ভব। আউটসোর্সিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে বিশ্বে দ্বিতীয়। বেকার তরুণরা চাইলে কোনো একটি বিষয়ে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে আউটসোর্সিং সেক্টরেও ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারেন।
বেসরকারি প্রতিষ্ঠান কোন দিকগুলোকে প্রাধান্য দিয়ে কর্মী নিয়োগ দেন?
গাজী মিজানুর রহমান : বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় দক্ষতার প্রতি। যে সেক্টরে লোকবল নিয়োগ দেওয়া হয়; সেই সেক্টরে দক্ষতা থাকলে তারা নিয়োগ দিতে চান। এর পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কমিউনিকেশন স্কিলের ওপর বেশ প্রাধান্য দেওয়া হয়। শুদ্ধ ও প্রমিত বাচনভঙ্গিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে লোকবল নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হয়।
আমাদের দেশে বেকারত্বের সমস্যাগুলো কোথায়? উত্তরণ কীভাবে?
গাজী মিজানুর রহমান : আমাদের দেশে বেকারত্বের সমস্যা তো আমার কাছে অন্তহীন মনে হয়। তবে মোটাদাগে বললে, কারিগরি শিক্ষার অভাব। তরুণ বেকারদের জন্য জামানতবিহীন পুঁজির যোগানের অপর্যাপ্ততা ও পুঁজি পাওয়ার জটিলতা। কর্মক্ষেত্রের সাথে অর্জিত শিক্ষার অসামঞ্জস্যতা। উচ্চশিক্ষিত হওয়ার পরও কোনো একটি বিশেষ দক্ষতা অর্জন করতে না পারা। কেবল সার্টিফিকেট সর্বস্ব উচ্চ শিক্ষা প্রদান। সবার উচ্চশিক্ষার সার্টিফিকেট নেওয়ার প্রবণতা। এছাড়াও আরও অনেক সমস্যা তো রয়েছেই। এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলে এর থেকে অনেকটাই উত্তরণ সম্ভব।
অনলাইনভিত্তিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছেন, সে বিষয়ে কিছু বলুন-
গাজী মিজানুর রহমান : বলতে পারেন এটা আমার অনেক দিনের অনেক বড় একটা স্বপ্ন। এখনো অনেক কিছু গুছিয়ে আনার বাকি আছে। সবকিছু ভালোভাবে গুছিয়ে নিয়ে ভালোভাবে শুরু করতে চাই অনলাইনভিত্তিক ‘ক্যারিয়ার স্কুল’। আশা করি, এই ‘ক্যারিয়ার স্কুল’ থেকে ক্যারিয়ার প্রত্যাশীরা স্বল্পমূল্যে ক্যারিয়ার গড়ার প্রস্তুতির জন্য সব ধরনের সাপোর্ট পাবে।
শিক্ষার্থীদের স্টাডি প্ল্যান কতটা জরুরি? কীভাবে তৈরি করা উচিত?
গাজী মিজানুর রহমান : ‘স্টাডি প্ল্যান’ হলো শিক্ষার্থীদের স্টাডি তথা পড়ালেখাকে সামনের দিকে প্ল্যানমতো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার একটি কার্যকর প্ল্যান। আমি ইতোমধ্যে বিসিএস ও প্রাইমারি শিক্ষক নিয়োগ প্রত্যাশীদের সম্পূর্ণ বিনামূল্যে ৯০ দিনের দুটি স্টাডি প্ল্যান দিয়েছি ফেসবুকে। অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা এসব স্টাডি প্ল্যান দ্বারা বেশ উপকৃত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন। স্টাডি প্ল্যান করার ক্ষেত্রে নিজের হাতের সময়ের ওপর প্রাধান্য দিয়ে স্টাডি প্ল্যান সাজানো উচিত। পাশাপাশি একই দিনে বা একই সময়ে একাধিক কঠিন বিষয় স্টাডি প্ল্যানে রেখে অদল-বদল করে রাখলে সেটি বেশ কার্যকর হয়।
আপনার মতে, সফল হতে কী প্রয়োজন?
গাজী মিজানুর রহমান : সফল হতে গেলে সবার আগে একটি স্বপ্নের প্রয়োজন। আর সেই স্বপ্নকে পূরণ করার জন্য যথাসময়ে যথাযথভাবে পরিশ্রম করার প্রয়োজন। সামনে স্বপ্ন না থাকলে দীর্ঘদিন পরিশ্রম করা যায় না। তাই সফল হতে গেলে স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকতে হবে। পরিশ্রম করার পাশাপাশি কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করার দৃঢ় মানসিকতা থাকতে হবে।