• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
বিলুপ্তপ্রায় কাঁসা-তামা শিল্প

ছবি : সংগৃহীত

ফিচার

বিলুপ্তপ্রায় কাঁসা-তামা শিল্প

  • প্রকাশিত ২৫ নভেম্বর ২০১৮


আবুল হাসান, ধামরাই (ঢাকা) ও জাহিদ হাসান মাহমুদ মিমপা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী কাঁসা-পিতল শিল্প হারিয়ে যাচ্ছে : আধুনিকতার স্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ধামরাইয়ের কাঁসা-পিতল শিল্প। পূর্বে কাঁসা-পিতলসামগ্রী গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নিত্যসামগ্রী হিসেবে দেখা যেত। বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় এসবের ব্যবহারে ভাটা পড়েছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এ শিল্পের ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব হবে। নয়তো কালের বিবর্তনে একদিন হারিয়ে যাবে। হয়ত এ শিল্পের সঙ্গে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিচয়ও থাকবে না। ঢাকা জেলার বৃহত্তম উপজেলা ধামরাই। এ উপজেলা কাঁসা-পিতলের জন্য বিখ্যাত ছিল। আগ্রহীরা এ কাঁসা-পিতলসামগ্রী দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে নিতে আসত। এখনো আসে, তবে তেমন নয়। শুধুু বাংলাদেশ নয়, দেশের বাইরেও ছিল এর প্রচুর চাহিদা। সরেজমিনে কথা হয় ধামরাই মেটাল আর্টস অ্যান্ড ক্রাফ্টসের স্বত্বাধিকারী প্রকাশ নাথ বণিকের সঙ্গে। দীর্ঘ প্রায় ২শ-৩শ বছর ধরে তার পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে ৭ম বংশধর হিসেবে এ পেশার সঙ্গে তিনি জড়িত। প্রায় দুইশ বছরের পুরনো ভবনেই ব্যবসা করে যাচ্ছেন তিনি। দেখা যায় পুরনো ভবনের নিচতলা কাঁসা-পিতলের শিল্পকর্মে ভর্তি। পিতলের কলসি থেকে শুরু করে খেলনাসহ বিভিন্ন দেবদেবীর বিশাল সম্ভার। সাজানো হয়েছে নোটা, ঘটিবাটি হাঁড়ি-পাতিল, থালা, গ্লাস, বদনা ও বিভিন্ন শো-পিস, জীবজন্তুর প্রতিকৃতি জিনিসপত্র। তিনি বলেন, উপজেলা সদরে স্বাধীনতার পূর্বেও প্রায় ৩০-৪০টি কারখানা ছিল। ওই সময় প্রতিটি কারখানায় পালিশ, ফিনিশিং ও মোমের শতাধিক কারিগর ছিল। বর্তমানে ধামরাই মেটাল আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস, ধামরাই মেটাল ক্রাফটস, ধামরাই মেটাল হ্যান্ডি ক্রাফটস, সাহা হ্যান্ডি ক্রাফটস রয়েছে। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁসা-পিতলের জায়গা দখল করে নিয়েছে প্লাস্টিক, মেলামাইন, সিরামিকস, লোহা, অ্যালুমিনিয়াম ও স্টেইনলেস স্টিলের বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র তৈরি হওয়ায় এ শিল্পের দৈন্য দেখা দিয়েছে অনেক আগে থেকেই। এরপরও বাপ-দাদার শিল্পকে ধরে রাখছেন তিনি। তিনি বলেন, কাঁসা-পিতলের তৈরি জিনিসপত্র একবার ক্রয় করলে তা ৩০-৪০ বছরের বেশি সময় ধরে ব্যবহার করা যায়। শুধু তাই নয়, পূর্বে যে দামে কেনা হয় ব্যবহারের পর তারচেয়েও বেশি দামে বিক্রি করা যায়। কথা হয় ধামরাই মেটাল ক্রাফটসের স্বত্বাধিকারী সুকান্ত বণিকের সঙ্গে। তিনিও বলেন, ১৯৯০ সাল থেকে ব্যবসার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। কাঁচামাল আমদানিকৃত বিভিন্ন উপকরণের দাম বেড়েছে গত ১৪-১৫ বছরে প্রায় তিনগুণ। এরপরও খুব চাহিদা রয়েছে ধর্মীয় ও পৌরাণিক চরিত্র যেমন শিব, বিষ্ণু, রাধা-কৃষ্ণের মূর্তির। তার এখানে বিদেশি কূটনৈতিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা আসেন কাঁসা-পিতলসামগ্রী ক্রয় করতে। তিনি বলেন, এসব সামগ্রী আগে বিদেশে রফতানি করার ক্ষেত্রে তেমন একটা বেগ পেতে হতো না। এখন নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এখনো এ শিল্প ধরে রাখা সম্ভব হবে।


ধামরাই মেটাল ক্রাফটসে কর্মরত শ্রমিক নিমাই পাল (৪৫) বলেন, তিনি পূর্বে বাপ-দাদার সঙ্গে প্রতিমা তৈরির কাজে নিয়োজিত ছিলেন। বর্তমানে কাঁসা-পিতলের তৈরি প্রতিমা ও বিভিন্ন জীবজন্তুর প্রতিকৃতির কর্মকার হিসেবে তিনি এখানে ২৩ বছর ধরে কর্মরত। তিনি প্রতিদিন গড়ে ৫শ থেকে ১ হাজার টাকা উপার্জন করতে পারেন। অন্য শ্রমিকরা চলে গেছেন কারণ তারা যেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস তৈরি করেন তা এখন চাহিদা কমে গেছে। এ ছাড়া দামও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। আরো কথা হয় ৫০ বছর বয়সী মানসুর রহমানের সঙ্গে। তিনি ধামরাই বাজারে প্রায় ২৮ বছর ধরে কাঁসা-পিতলের থালা-বাসন, বাটি, ঘটি, চামচ, গ্লাস, বদনা বিক্রি করে আসছেন। তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরও এ ব্যবসা ছিল বেশ জমজমাট। এ বাজারেই ছিল অনেক ব্যবসায়ী। বর্তমানে আছে হাতেগোনা কয়েকজন। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে শুধু হিন্দু সম্প্রদায় মেয়ের বিয়েতে উপহার হিসেবে কাঁসা-পিতলের তৈরি কিছু জিনিসপত্র ক্রয় করে। তা ছাড়া সচরাচর কেউ এসব কেনে না। তাই ব্যবসায় পড়েছে ভাটা।

ফিরছে সুদিন : চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহ্য কাঁসা শিল্প ’৯০-এর দশকে ব্যাপকহারে ভারতে পাচার হয়ে যাওয়ার কারণে বিলুপ্ত হতে বসেছিল। কিন্তু বর্তমানে ভারতে পাচার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাঁসা শিল্প আবার আশার আলো দেখতে শুরু করেছে। এই শিল্পে ফিরে আসছে সুদিন। তবে বিলুপ্তপ্রায় এই শিল্পের অনেক কারিগরই অন্য পেশায় চলে গেছে। ফলে কাঁসার কারিগর আর তেমন গড়ে উঠছে না। তারপরও অনেকেই বাপ-দাদার এই পেশা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন। কাঁসার বাসনপত্র তৈরির কারিগররা জানান, এলাকার মানুষের কাছে প্রচলিত রয়েছে দেশ-গ্রামের লোকজনের ঘুম ভাঙত মোরগের ডাক শুনে। আর চাঁপাইনবাবগঞ্জের নামোশংকরবাটী, আজাইপুর, আরামবাগ, বটতলাহাট ও সোনারমোড় এলাকার মানুষের ঘুম ভাঙত কাঁসার কারিগরদের হাতুড়ির টুং-টাং শব্দে। আর বেশ কিছুদিন বন্ধ থাকার পর এখন আবার মানুষের ঘুম ভাঙছে কাঁসার কারিগরদের হাতুড়ির টুং-টাং শব্দে। কাঁসা-পিতলের কারিগররা কাঁচামাল আগুনে পুড়িয়ে গলানোর পর তৈরি করেন কাঁসার থালা, বাটি, কলস, জগ, বদনাসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় ব্যবহারসামগ্রী। মেয়ের বিয়েতে কাঁসার থালা, বাটি, কলস, জগ, গামলা, বদনা, কড়াইসহ বিভিন্ন জিনিস দেওয়া না হলে নতুন ঘরে মেয়েকে মানায় না বলে অনেকেই মনে করেন। কাঁসার কারখানার মালিক নূর আমীন জানান, কাঁসা-পিতলের কাঁচামাল পরিবহনে পুলিশ ও প্রশাসনের হয়রানি বন্ধ করা হলে এই শিল্পের আরো প্রসার ঘটবে। এ ছাড়া সার্কেল মেশিন হলে কাঁসার আসবাবপত্র তৈরি করা সহজ হবে, দামও কমবে বলে জানালেন কাঁসার কারখানার এই মালিক।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads