• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

‘শুভদিন শুভক্ষণ’

  • সেলিনা হোসেন
  • প্রকাশিত ১৩ মে ২০২১

মুজিবের চেতনায় শূন্যতা নাই। গণমানুষকে ভালোবাসার বোধে মন ভরে থাকে। আলো-বাতাসের ফুরফুরে দিনের শোভা পূর্ণ করে রাখে বুকের ভেতর সবটুকু ফাঁকা জায়গা। কখনো মনে হয় না বুক খালি হয়ে গেছে, কষ্ট বাড়ছে।

পাকিস্তানের লায়ালপুর জেলে থাকার পরও শূন্যতা তাকে আচ্ছন্ন করে না। বাংলার মাটি আর মানুষ তার হূদয়-ভরা উর্বর জনজীবন। যখন নিজেকে বলেন, বাংলার মানুষের ভালোবাসা আমার জীবনের আশীর্বাদ। তখন দ্বিতীয় কোনো চিন্তা মাথায় থাকে না। তিনি ভরপুর হূদয়ে জেলখানার ছোট ঘরকে বিশাল হতে দেখেন। আবেগের তাড়নায় সরে যায় জেলের ঘরের দেয়াল। চারদিকের প্রবল বাতাস বয়ে যায় দিগন্ত ছাড়িয়ে নতুন দিগন্তে। ফসলের মাঠ, পথঘাট, মানুষের বসতি পুরো প্রান্তর ভরে রাখে। নদী সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে, দেখ আমাকে। দেখ বন্যায় কত বিস্তার লাভ করেছি। তোমার স্বদেশ এমনই নানা বৈচিত্র্যের। ফিরে এসে আমাদের কাছে। তোমার সোনার বাংলা স্বাধীন হয়েছে। খবরটি কেউ তাকে সরাসরি বলেনি। তিনি শুনেছেন আশপাশের লোকজনের আলোচনা থেকে। তখন মনে হয় তিনি আর জেলখানার ছোট ঘরে নেই। বিশাল পথে হেঁটে যান সবুজ-সোনালি প্রান্তরে। হাঁটতে শুরু করলে পথ ফুরোয় না। তাকে আটকে রাখার সাধ্য পাকিস্তানি সেনাদের নেই। ওরা তো বিতাড়িত হয়েছে বাংলার মাটি থেকে। বুকের ভেতর উদিত হয় নতুন সূর্য। বলতে থাকেন, জয়-জয়-জয়-জয়-বাংলা। শান্ত-স্নিগ্ধ হয়ে যায় শরীর।

তিনি জানতে পারেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরে ইয়াহিয়া খানকে বন্দি করা হয়েছে। ডিসেম্বরের ২০ তারিখে ভুট্টো প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। অনেক দূর থেকে স্লোগানের মতো শব্দ ভেসে আসছে- জুলফিকার আলী ভুট্টো, ভুট্টো- প্রেসিডেন্ট, প্রেসিডেন্ট। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

ক্ষমতার এই পরিবর্তন মুজিবকে বিষণ্ন করে। ভুট্টোর পুরনো কথা অসহযোগ আন্দোলনের সময় মনের তটে ভেসে ওঠে। শেখ মুজিব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবে, মানতেই পারছিল না ভুট্টো। নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ স্বীকার করেনি ভুট্টো। কত তালবাহানা, কত রাজনীতির কূটকৌশল চালিয়ে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত হওয়ার পরও তার দাপাদাপির শেষ ছিল না। মুজিবের মনে হয় ভুট্টোর মাথায় গোবর জমেছিল। তাকে বন্দি করে আনার পরে স্বপ্নের ডালপালায় নিজের বিস্তার দেখেছিল নির্লজ্জভাবে। অন্যায়কে বুকে ধারণ করে রেখে। এখন প্রেসিডেন্ট হয়ে আগামী দিনে কী করবে, কে জানে? মুজিব নিশ্বাস ফেলে ঘরের চারদিকে তাকায়। ইচ্ছে হয় ঘরের দেয়ালগুলো রঙ দিয়ে ছবি এঁকে ভরিয়ে রাখতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিজের আত্মতৃপ্তির রঙবলয়। কিন্তু হাতের কাছে রঙ নেই। বন্দিজীবনে রঙের ঔজ্জ্বল্য থাকে না। তার চোখের সামনে সবুজ প্রান্তরে ভেসে ওঠে বাংলার মাটির প্রাকৃতির রঙ। সেই রঙ এই জেলখানার কাছেও পৌঁছাবে না। হা-হা হাসিতে মাতিয়ে তোলে নিজের বুকের ভুবন।

ভুট্টো বিদেশি সাংবাদিকদের বলেছে, মুজিবকে জেলখানায় বন্দি না রেখে গৃহবন্দি অবস্থায় রাখা হবে।

সাংবাদিকরা কোথায় রাখা হবে জানতে চাইলে সে প্রশ্নের উত্তর দেয় না ভুট্টো। ক্রুদ্ধস্বরে বলে, এত কথা জানার দরকার কি তোমাদের?

— তাঁর দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনারা পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখতে পারেননি।

— শাটআপ। আর কথা বলবে না। ক্রুদ্ধস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে ভুট্টো।

সাংবাদিকরা চলে যায়। যেতে যেতে মৃদুস্বরে বলে, কত ষড়যন্ত্র করে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছে। এখন সাংবাদিকদের সঙ্গে চিৎকার করছে।

কেউ আর কথা বাড়ায় না। চুপচাপ হেঁটে যায়।

ভুট্টোর মাথার মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। একসময় স্থিরভাবে চিন্তা করে পশ্চিম পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যে কনফেডারেশন গঠন করার চেষ্টা করতে হবে। বিষয়টি শেখ মুজিবের সঙ্গে আলাপ করতে হবে।

ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে হত্যা করতে চেয়েছিল। ডিসেম্বরের ৪ তারিখে পাকিস্তানি মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল শেখ মুজিবকে প্রাণদণ্ডাদেশ দেয়। ফাইলটি ইয়াহিয়া খানের টেবিলে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ফাইলে সাইন করতে পারেননি। ক্ষমতার পালাবদলে ভুট্টো এসে যায় ক্ষমতার চেয়ারে। ভুট্টো এত দ্রুত মুজিবকে মেরে ফেলতে চায়নি। বিচারের শেষ দিকে মুজিবকে লায়ালপুর জেল থেকে হেলিকপ্টারে করে মিয়ানওয়ালি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেই জেলখানায় একটি কবর খোঁড়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পরিকল্পনা ছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো হবে। তার এই প্রস্তাবে ভুট্টো রাজি ছিল না। কারণ বাংলাদেশে তখন এক লক্ষ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি আছে। কয়েক লক্ষ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। শেখ মুজিবকে হত্যা করলে ওদেরকে ফিরিয়ে আনা কঠিন হয়ে যাবে। সেজন্য ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের মুজিবকে হত্যার করার সিদ্ধান্ত মানতে পারেনি। ভুট্টো ইয়াহিয়া খানের এই সিদ্ধান্ত জানতে পেরে মুজিবকে মিয়ানওয়ালি জেলখানা থেকে দ্রুত অন্য জায়গায় সরিয়ে নেয়ার জন্য জেলখানার প্রিজন গভর্নরকে নির্দেশ দেন। নির্দেশ পেয়ে প্রিজন গভর্নর আলী হাবীব মুজিবকে একটি ট্রাকে করে তাঁর সরকারি বাসভবনে নিয়ে যান। সেখানে মুজিবকে দুদিন রাখা হয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের এসব আচরণে মুজিব বেশ স্বস্তি বোধ করে। মনে হয় বন্দি জীবনের এই খেলা তার বুকের শূন্যতায় জমা হয়েছে। বন্দি জীবনের শূন্যতা তাকে আর কাবু করতে পারেনি। স্বাধীনতার খবরে আপ্লুত হয়ে নিজেকে বলেছে, স্যালুট লাল-সবুজ পতাকা। স্যালুট আমার সাহসী বীর যোদ্ধারা। নারী-পুরুষ সবাই আমার সামনে সৈনিক। তখনই গুনগুনিয়ে গাইতে থাকেন, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।’

একজন বেয়ারা মুখতার চা-নাস্তা এনে বলে, স্যার আপনি গান গাইতে পারেন?

- না রে, আমি গায়ক না। নিজের জন্য কিছু গান গাইতে পারি।

- শুনতে খুব ভালো লাগে স্যার।

- তুই একটা সোনার ছেলে রে? আমাকে ভালোবাসার চা খাওয়াস।

- আমার কষ্ট আমি আপনার বাংলাভাষা জানি না। আপনি আমার সাথে উর্দুতে কথা বলেন।

- আমিও তো ভাঙা ভাঙা উর্দু বলি রে মুখতার।

দুজনেই প্রাণখুলে হাসে। হাসতে হাসতে মুজিব বলেন, বস, আমার সঙ্গে রুটি-হালুয়া খা।

- না, না, আমাকে এখন যেতে হবে। আমি যাই। মুখতার লাফ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে দরজা বন্ধ করে।

মুজিব ভাবে, বন্দি জীবনেও আনন্দ আছে। আসলে তার বুকভরা বিজয়ের গৌরবের কারণে কখনো মনের ব্যথা চেপে বসে না। এখন এই মুহূর্তে তাঁর কাছে মৃত্যুর কোনো কষ্ট নেই। ওরা মেরে ফেললে বুকভরা আনন্দ নিয়ে মরে যাবে। হাততালি বাজাতে বাজাতে হেসে আকুল হন তিনি - সুর করে টেনে টেনে বলে, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা। স্বাধীনতার সুর বয়ে যায় কারাগার থেকে আমার বাংলার মাটিতে।

দুদিন পরেই শেখ মুজিবকে শিহালাতে সেনাবাহিনীর রেস্টহাউসে নিয়ে যাওয়া হয়। রাওয়ালপিন্ডি থেকে শিহালা পঁচিশ কিলোমিটার দূরে। যেতে যেতে পাহাড়ি জনপদের প্রাকৃতির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে ভাবেন, বীর মুক্তিযোদ্ধারা তোমাদের কথা ভেবে আমি ব্যাকুল হয়ে যাই। তোমাদেরকে দেখতে না পেলে মরেও শান্তি পাব না। আমার মরণের ভয় নাই, কিন্তু তোমাদেরকে দেখার ইচ্ছা নিয়ে মরতে চাই না। তোমাদেরকে দেখে তারপরে মরবো।

গেস্ট হাউসের সামনে এলে ড্রাইভার বলে, এটা ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর রেস্ট হাউস ছিল। আপনি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হলে আবার আসবেন এখানে থাকার জন্য।

- না, আসব না। আমার আসার দরকার নেই।

- কালকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসবেন। তাহলে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট আসবে না কেন?

মুজিব আর কথা বাড়ান না। চুপ করে থাকেন। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এলাকাটি তার খুবই ভালো লাগে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখেন। একজন কর্নেল দ্রুতপায়ে হেঁটে এসে বলেন, আমাদের প্রেসিডেন্ট আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসবেন।

- কখন আসবেন?

- কিছুক্ষণের মধ্যে। আপনি চলুন চা খাবেন।

- না, আমি এখন চা খাব না।

- রাগ করছেন কেন?

- রাগ করবো কেন? আমার চা খাওয়ার ইচ্ছা নাই।

- তাহলে আপনাকে মিষ্টি খাওয়াই?

- খাওয়াও। নিয়ে এসো।

- যাক, আনন্দ পেলাম। আপনার সঙ্গে আমরাও খাব। আপনি না খেলে আমরা খেতাম না।

মুজিব কথা বলে না। অকারণে কথা বলে নিজেকে হালকা করতে চায় না ওদের সামনে। ওরা পাকিস্তানের এক অংশ হারিয়েছে। এখন কেমন আচরণ করবে এটা ভেবে নিজেকে নিঃশব্দ রাখে। ওরা যেন কোনোভাবে আক্রমণ করতে উদ্যত হয় না। এখন পর্যন্ত ওরা তেমন কোনো আচরণ করেনি সেটাও ঠিক। কিন্তু ভুট্টো কেন এখানে আসবে? এমন ভাবনার মাঝে মিষ্টির প্লেট এনে দেয় তাঁকে। মুজিব বারান্দার চেয়ারে বসে মিষ্টি খান। বেশ ভালোই লাগে খেতে। ওরা প্লেট ভর্তি মিষ্টি দিয়েছে। তিনি বেশ কয়েকটি খেয়ে ফেলেন।

বেশ কতক্ষণ পরে জুলফিকার আলী ভুট্টো আসেন হেলিকপ্টারে করে। দ্রুত পায়ে উঠে আসেন রেস্টহাউজে। মুজিব মিষ্টির প্লেট হাতে দাঁড়িয়ে বলেন, আসুন একসঙ্গে মিষ্টি খাই।

 হো-হো করে হাসে ভুট্টো।

- বেশ তো মিষ্টি দিয়ে আমাকে আপ্যায়ন করলেন।

- করবই তো আপনি এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট।

- শুধু প্রেসিডেন্ট না, আমি চিফ মার্শাল ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর।

মুজিব একথা শুনে সঙ্গে সঙ্গে হাসতে শুরু করলেন। ভুট্টো খানিকটা অবাক হয়ে বলেন, আপনি হাসছেন কেন?

- হাসলাম এজন্য যে আমি বুঝতে পারি একজন প্রেসিডেন্ট সিভিলিয়ান হতে পারে। কিন্তু আমি অবাক হই, যখন শুনি যে একজন সিভিলিয়ান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক।

ভুট্টো জোর দিয়ে বলে, দ্যাট ইজ পসিবল ইন পাকিস্তান।

মুজিব এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলেন, ‘মি. ভুট্টো টেল মি ফার্স্ট, হোয়েদার আই অ্যাম এ ফ্রি ম্যান অর প্রিজনার? ভুট্টো জবাব দিলেন, ‘নাইদার ইউ আর এ প্রিজনার, নর ইউ আর এ ফ্রি ম্যান।’

- বন্দি হিসেবে আমি কথা বলব না।

ভুট্টোর চোখে চোখ রেখে কথা বললে ভুট্টো অন্যদিকে চোখ ফেরায়। তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলেন, কীভাবে কনফেডারেশন করা যায় তা নিয়ে আমি ভাবছি।

মুজিব কথা বলেন না।

ভুট্টো আবার বলেন, কীভাবে একসঙ্গে থাকা যায় সেটাও আমরা আলাপ করতে পারি।

মুজিব দৃঢ় কণ্ঠে বলেন, আমার প্রিয় জনগণ এবং সহকর্মীদের সঙ্গে কথা না বলে আপনার এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব না। আমার জনগণ আমার জীবনের সবকিছু। জনগণকে বাদ দিয়ে আমার দ্বিতীয় কোনো জীবন নেই। আমাকে মেরে ফেলা হলে আমার লাশ বাংলার মাটিতে পাঠিয়ে দেবেন। বাংলার মাটি আমার মা। আমি আমার মায়ের বুকে শেষ ঘুম ঘুমাতে চাই।

ভুট্টো দুচোখ মেলে মুজিবের কথা শুনলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। একটুক্ষণ অপেক্ষা করে মুজিব বললেন, আমি কি এখন দেশে যেতে পারি?

- হ্যাঁ, পারেন; কিন্তু কীভাবে যাবেন? পাকিস্তানের পিআইএ বিমান ভারতের ওপর দিয়ে যায় না।

- তাহলে আমি লন্ডন হয়ে যাবে। 

- ঠিক আছে ব্যবস্থা করব।

গেস্ট হাউজ থেকে চলে যান ভুট্টো। মুজিব বাইরে বেড়াতে বের হন। ভাবেন, প্রকৃতির মধ্যে কোনো ফারাক নাই। এই জায়গাটিকে আমার রাঙামাটির মতো লাগছে। কী সুন্দর গাছ, কী সুন্দর ফুল। বনের ভেতর হেঁটে আসি। মুজিব কাউকে কিছু না বলে বনের পথে বেরিয়ে পড়েন। সবুজ পাতা ছুঁয়ে দেখেন, বুনো ফুলে নাক লাগিয়ে গন্ধ টানেন। এই গাছপাল সবই আমার জনসাধারণ। আমি ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হাঁটব- উদয়ের পথে শুনি কার বাণী, ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই- কবিতা বলতে বলতে গাছের পাতা ছুঁয়ে বেশ ভেতরে চলে যান। পেছন থেকে কর্নেল আইয়ুব চিৎকার করে বলে, আপনি বের হয়েছেন কেন? আপনি তো বন্দি মানুষ?

- আপনাদের প্রেসিডেন্ট বলেছেন আমি চলে যাব। তাই ভাবলাম আমার নিঃশ্বাসে বনের বাতাস নিয়ে আসি।

- আপনি কি কবিতা লেখেন?

- লাখ লাখ মানুষকে ভালোবাসা আমার কবিতা।

- ওহ রাজনীতি! খেঁকিয়ে ওঠে কর্নেল।

মুজিব তাকে পেছনে ফেলে দ্রুত হেঁটে ফিরে আসেন। রেস্ট হাউজে নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করেন। কর্নেল দরজায় শব্দ করে। মুজিব খোলেন না।

কর্নেল বাইরে থেকেই বলেন, আগামীকাল আপনাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাব।

মুজিব দরজা খুলে বলেন, থ্যাঙ্ক ইউ।

কর্নেল কোনো কথা না বলে চলে যায়।

পরদিন মুজিবের মনে হয় আকাশে সোনালি সূর্য উঠেছে। এটি সোনার বাংলার সূর্য। বারান্দায় দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকেন নীলাভ আকাশের দিকে। ভেসে আসে স্নিগ্ধ বাতাসের পরশ। অনুভবে জেগে ওঠে টুঙ্গিপাড়া। বয়ে যায় মধুমতী নদী। নদীর কলকল শব্দ লক্ষ মানুষের আহ্বান, বঙ্গবন্ধু চলে আস আমাদের কাছে। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। মাঠে-ঘাটে, পথে-প্রান্তরে, শহরের রাস্তায় অপেক্ষা করছে তোমার জন্য বঙ্গবন্ধু। শেখ মুজিবের বুক ভরে যায়।

নির্দিষ্ট সময়ে তিনি লন্ডনের উদ্দেশে যাত্রা করেন। ৮ জানুয়ারি লন্ডন এসে পৌঁছান। সেখানে বসে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। লিখেছেন : ‘বাংলার মুক্তিসংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’-এর দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত জেলে জীবন কাটাচ্ছি।’

বড় একটি বিবৃতি লিখতে লিখতে ভাবেন, এমনই আমার জীবন। শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা এসেছে বাংলার মাটিতে। আমি এখন ফিরে যাব আমার মাটিতে, আমার মানুষের ভালোবাসার কাছে। মানুষের ভালোবাসায় আমার জীবন ধন্য হয়।

১০ জানুয়ারি দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান। বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান ভারতের রাষ্ট্রপতি ভি. ভি. গিরি আর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। মুজিবের কেবল মনে হতে থাকে চারদিকে ফুলের সৌরভ। আর কোথাও অন্ধকার নেই। উজ্জ্বল আলোর বিভা চোখ জুড়িয়ে দিচ্ছে। নয় মাস পরে আমি নিজের প্রাণের দেশে ফিরে যাচ্ছি। এই নয় মাস শতাব্দী অতিক্রম করেছে প্রিয় গণমানুষ। আমাকে যখন পাকবাহিনী দেশের মাটি থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল। আমাকে যখন বন্দি করে রেখেছিল তখন তারা যুদ্ধ করেছিল। এখন আমি যখন তাদের কাছে যাচ্ছি তারা বিজয়ের উৎসবে মেতে আছে। বিজয়ী মানুষদের বুকের আলিঙ্গনে আমি বিজয়ের পতাকা উড়াব। লাল-সবুজের পতাকায় ছেয়ে যাবে সারা দেশ।

বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে নামলে তিনি শুনতে পান গগনবিদারী স্লোগান- জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

মুজিব নিজেও বিমানের সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে দুহাত উপরে তুলে বলেন, জয় বাংলা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads