• শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

শিশুর অন্ধত্ব প্রতিরোধ করি স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করি

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ০৩ জুন ২০২১

পৃথিবীতে অন্ধত্বের চারটি প্রধান কারণের মধ্যে ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত কর্নিয়ার রোগ ও কর্নিয়ার ক্ষত অন্যতম। ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত সমস্যা বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রধান পুষ্টি সমস্যা। ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবারের অভাবই এর প্রধান কারণ। ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত কারণে শিশু রাতকানা রোগে ভোগে এবং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। প্রাপ্তবয়স্করা যকৃতে জমে থাকা ভিটামিন ‘এ’র কারণে এ ধরনের ঝুঁকি থেকে মুক্ত থাকেন। ভিটামিন ‘এ’র অভাবে রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায় এবং বার বার শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। ভিটামিন ‘এ’ দৃষ্টিশক্তি ঠিক রাখে, রোগ সংক্রমণ থেকে শরীরকে রক্ষা করে এবং রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। এই ভিটামিনটির অভাবে আপনার শিশুটি হয়ে যেতে পারে রাতকানা। হয়ে যেতে পারে চিরদিনের জন্য অন্ধ। অন্ধত্ব একটি পরিবারের জন্য অভিশাপ, দেশের জন্য বোঝা। আমরা জানি, ভিটামিন ‘এ’র ঘাটতি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ফলে শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। সেজন্য শিশুদের দৈনিক খাবারের তালিকায় বিভিন্ন খাদ্যশ্রেণি থেকে ভিটামিন ‘এ’, ভিটামিন ‘ডি’ এবং আয়রনসমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো নিশ্চিত করতে হবে। অনেক পরিবারে প্রাপ্ত খাদ্য থেকে ভিটামিন ‘এ’ নিশ্চিত হয় না। সরকার সে কারণে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানোর বিষয়ে উৎসাহিত করার পাশাপাশি ৬-৫৯ মাস বয়সি শিশুদের ৬ মাস পরপর ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর কার্যক্রম চালু রেখেছে। এই ক্যাপসুল আপনার শিশুকে ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত রোগ থেকে রক্ষা করবে। এক হিসাবমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৯০ হাজার শিশু ভিটামিন ‘এ’র অভাবজনিত চক্ষূরোগে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে ৪০ হাজার শিশু অন্ধ হয়ে যায়।

এই ভিটামিনটি দৃষ্টিশক্তি স্বাভাবিক রাখতে বিরাট ভূমিকা পালন করে। ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানোর ফলে শিশু যে শুধু রাতকানা রোগ থেকে রক্ষা পায় তা নয়, এ ছাড়াও ভিটামিন ‘এ’ শিশুদের আরো বহুবিধ উপকার করে-যেমন শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে; দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখে; শিশুর মৃত্যুর হার কমায়; শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা নিশ্চিত করে; ডায়রিয়ার ব্যাপ্তিকাল এবং হামের জটিলতা কমায় ইত্যাদি। ত্বক ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লির স্বাস্থ্যরক্ষার কাজ করে। দেহ বৃদ্ধি, বিশেষ করে দেহের অস্থি কাঠামোর বৃদ্ধি প্রক্রিয়ার সঙ্গে ভিটামিন ‘এ’র সংযোগ রয়েছে। ভিটামিন ‘এ’ জীবাণু সংক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে। আমরা অপুষ্ট শিশুকে দেখতে চাই না। অপুষ্টিজনিত রাতকানা রোগ কিংবা অন্ধত্ব চাই না। সরকারের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানোর মাধ্যমে অন্ধত্ব প্রতিরোধ করতে পারি। শিশুর দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারি। শিশুর মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে পারি।

 

ভিটামিন ‘এ’র অভাব কেন হয়

জন্মের পর শিশুকে শালদুধ না খাওয়ালে। শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ না খাওয়ালে। বুকের দুধের পরিপূরক হিসেবে দেওয়া খাবারে ভিটামিন ‘এ’ কম থাকলে। গর্ভবতী ও প্রসূতি মা ভিটামিন ‘এ’র অভাবে ভুগলে এবং তার বুকের দুধ শিশুকে খাওয়ালে। ছয় মাস বয়সের পর থেকে শিশুর পরিপূরক খাবারের সঙ্গে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ শাকসবজি ও ফলমূল না খাওয়ালে। দীর্ঘমেয়াদি ডায়রিয়া, হাম ও মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগলে। শিশু কৃমি আক্রান্ত হলে।

 

ভিটামিন ‘এ’র উৎস

গাঢ় সবুজ রঙের শাকসবজি এবং হলুদ ও কমলা রঙের সবজি ভিটামিনের প্রাথমিক উৎস। এ ছাড়া কলিজা, ডিম, মাংস, মাছ, বিশেষত মলা ও ঢেলা মাছ এবং মাছের তেলেও প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ পাওয়া যায়। অনেক পরিবার শিশুদের নিয়মিত মাছ, মাংস, ডিম, কলিজা খাওয়াতে পারে না। এ কারণে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’র অভাব দেখা যায়। এই অভাব দূর করার জন্য সরকার শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ায়।

শিশুকে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ প্রাণিজ খাবার (কলিজা, মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি) এবং উদ্ভিজ্জ খাবার (গাঢ় হলুদ ফলমূল এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ তেল দিয়ে রান্না করা রঙিন শাকসবজি) খেতে দিতে হবে। শিশুর ভিটামিন ‘ডি’র চাহিদা পূরণ করতে শিশুকে সূর্যের আলোতে নিতে হবে। সূর্যের আলো ভিটামিন ‘ডি’র প্রধান উৎস। এ ছাড়া শিশুদের দৈনিক খাবারের তালিকায় ভিটামিন ‘ডি’ সমৃদ্ধ খাবার, যেমন দুধ, মাখন, পনির, তৈলাক্ত মাছ, সামুদ্রিক মাছ, ডিমের কুসুম ইত্যাদি খেতে দিতে হবে।

রাতকানার লক্ষণ, কারণ ও প্রতিকার

লক্ষণ : চোখের  সাদা অংশের রং পরিবর্তন হয়ে বাদামি হয়ে যায়। চোখের পানি কমে গিয়ে সাদা অংশ শুষ্ক হয়ে যায়। চোখ লাল হয়ে যায়। অল্প আলোতে চোখে ঝাপসা বা কম দেখে। উজ্জ্বল আলোর দিকে সরাসরি তাকাতে পারে না, চোখে ফুলি পড়ে (বিট স্পট)। চোখের মণিতে ঘা হয়ে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যায়।

কারণ : ভিটামিন ‘এ’র অভাব। শিশুকে মায়ের দুধ না খাওয়ানো। বাড়তি খাবারে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাদ্য কম বা না থাকলে। শিশুর স্বাভাবিক খাবারে ভিটামিন ‘এ’ জাতীয় খাদ্য কম থাকলে কিংবা ডায়রিয়া বা হাম হলে।

প্রতিকার : এক থেকে পাঁচ বছর বয়সের শিশুদের প্রতি বছরে ৬ মাস অন্তর অস্তর ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো।

প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ সমৃদ্ধ খাদ্য, যেমন কলিজা, মাছের তেল, ডিম, মাখন এবং গাঢ় রঙিন শাকসবজি ও ফলমূল খাওয়া। শাকসবজি রান্নায় অবশ্যই পরিমিত তেল ব্যবহার করা। শালদুধসহ যতদিন সম্ভব বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানো। লক্ষণ দেখা গেলেই দ্রুত চিকিৎসকের শরণাপন্ন হোন।

জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন

১৯৭৩ সাল থেকে দেশব্যাপী ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল বিতরণ করা হচ্ছে। ১৯৯৪ সাল থেকে ভিটামিন ‘এ’ সপ্তাহ পালন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে নিয়মিতভাবে জাতীয় টিকা দিবস (ঘধঃরড়হধষ ওসসঁহরুধঃরড়হ উধু-ঘওউ) পালন শুরু হলে কখনো কখনো এনআইডির সঙ্গে ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হয়। পোলিও টিকার সঙ্গে ছয় মাস পরপর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো হতো। ভিটামিন ‘এ’র সঙ্গে শিশুকে কৃমিনাশক খাওয়ানো শুরু হলে কর্মসূচির নাম হয়ে যায় ‘ন্যাশনাল ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন’। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় পুষ্টিসেবা (এনএনএস) ও জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় ৫ জুন থেকে ১৯ জুন ২০২১ তারিখ পর্যন্ত দেশব্যাপী ‘জাতীয় ভিটামিন এ প্লাস ক্যাম্পেইন’ উদ্যাপিত হবে। গত ২৪ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ‘পুষ্টি কার্যক্রম বাস্তবায়ন সংক্রান্ত স্টিয়ারিং কমিটির (ঝঃববৎরহম ঈড়সসরঃঃবব ভড়ৎ ঘঁঃৎরঃরড়হ ওসঢ়ষবসবহঃধঃরড়হ) সভায় পক্ষকালব্যাপী সর্বোচ্চ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সারা দেশে জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইন পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জাতীয় ভিটামিন ‘এ’ প্লাস ক্যাম্পেইনে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৬-১১ মাস বয়সি শিশুদের ৫০,০০০ আইইউ মাত্রার একটি নীল ক্যাপসুল এবং ১২-৫৯ মাস বয়সি শিশুদের ১,০০,০০০ আইইউ মাত্রার একটি লাল ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। দেশের সব ইপিআই কেন্দ্র এনং স্থায়ী স্বাস্থ্যকেন্দ্রসমূহে প্রতিদিন ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে। নির্ধারিত ইপিআই সিডিউল অনুযায়ী প্রত্যেক ওয়ার্ডের (পুরাতন) ৮টি সাব-ব্লকে সপ্তাহের ৬ কর্মদিবসের ২ দিন ইপিআই টিকাদান কর্মসূচির ব্যাঘাত না ঘটিয়ে অবশিষ্ট ৪ দিন নির্ধারিত ইপিআই কেন্দ্রে পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্য সহকারী, পরিবার কল্যাণ সহকারী ও স্বেচ্ছাসেবী কর্তৃক উদ্দিষ্ট শিশুদের ভিটামিন ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। তা ছাড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও অন্যান্য সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল খাওয়ানো হবে। পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন এলাকায়ও ইপিআই কেন্দ্রসমূহেও এই কার্যক্রম পরিচালিত হবে।   একই সাথে কেন্দ্রে আগত শিশুদের পিতা-মাতা বা অভিভাবকদের পুষ্টিবিষয়ক বার্তা জানানো হবে। এবারের ক্যাম্পেইনে কোনো ভ্রাম্যমাণ টিকা কেন্দ্র থাকবে না। কোভিড-১৯ মহামারী প্রাদুর্ভাবের কারণে শারীরিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি (মাস্ক পরিধান করা, সাবান দিয়ে ২০ সেকেন্ড হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার) সুনিশ্চিত করা হবে।

 

যেসব খাবারে আছে ভিটামিন ‘এ’

বিভিন্ন ধরনের খাবার থেকে দৈনন্দিন ভিটামিন ‘এ’র চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। জেনে নিন কোন খাবারগুলোতে ভিটামিন ‘এ’ পাবেন-

কলিজা : কলিজায় আয়রনের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে।

গাজর : এক কাপ গাজরে যে পরিমাণ ভিটামিন এ থাকে, তা একজন মানুষের গড় চাহিদার ৩৩৪ শতাংশ পর্যন্ত পূরণ করতে পারে।

কুমড়া : কুমড়াতে পাওয়া যায় ভিটামিন ‘এ’। প্রতিদিন একশ গ্রাম কুমড়া খাবারে যোগ করে নিলে তা আপনার চাহিদার ১৭০ শতাংশ পূরণ করতে পারবে।

মিষ্টি আলু : শুধু একটি মিষ্টি আলুই মানুষের দৈনন্দিন ‘ভিটামিন ‘এ’র গড় চাহিদার ৪৩৮ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম। এ ছাড়া এটি ত্বকের কোষের জন্য প্রয়োজনীয় ভিটামিন ‘এ’ সরবরাহ করতে এবং ইনফেকশন বা সংক্রমণ ঠেকাতে পারে।

টমেটো : টমেটোতে ক্যালোরি কম থাকলেও এর মিনারেল কনটেন্টে প্রচুর ভিটামিন ‘এ’ রয়েছে। একটি মাঝারি আকারের টমেটো আপনার দৈনন্দিন চাহিদার ২০ শতাংশ পূরণ করতে সক্ষম।

লাল মরিচ : লাল মরিচে ভিটামিন ‘এ’ তো থাকেই, পাশাপাশি এতে থাকে কারোটেনয়েডস ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। খাদ্য তালিকায় রাখলে এটি আপনার দৈনন্দিন ভিটামিন ‘এ’র চাহিদার ৪২ শতাংশ পূরণ করবে।

সবুজ শাকসবজি : সবুজ শাকসবজিতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ থাকে। এ ছাড়া এতে ম্যাঙ্গানিজ, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন ‘সি’ এবং ‘কে’ থাকে।

মাছ : মাছ ও মাছের তেল ভিটামিন ‘এ’র চমৎকার উৎস।

দুধজাতীয় খাবার : এক কাপ দুধ দৈনন্দিন ১০-১৪ শতাংশ পর্যন্ত ভিটামিন ‘এ’ সরবরাহ করতে পারে। আর এ ক্ষেত্রে পনির ১ থেকে ৬ শতাংশ পর্যন্ত সরবরাহ করে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads