• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

বৈষম্যের বিরুদ্ধে উপমার লড়াই

  • অরণ্য সৌরভ
  • প্রকাশিত ১৮ অক্টোবর ২০২১

বয়সের মাপকাঠিতে তিনি যখন ২০, তখন ১৪ বছর বয়সি এক কিশোরের দ্বারা ইভটিজিংয়ের শিকার হন। এরপর এমন পরিস্থিতি বা সমস্যার পেছনে মূলত কী দায়ী, সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে থাকেন। ভেবেচিন্তে খুঁজে পান, সমাজের গোড়া নারীবিদ্বেষে জড়িয়ে পড়া। সেই প্রেক্ষাপট থেকে উত্তরণের জন্য লিঙ্গীয় বৈষম্যহীন এবং এসডিজি-৫ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে বাংলাদেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয়ে ২০১৬ সালে গড়ে তোলেন একটি যুব সংগঠন। নাম ‘ইভোলিউশন৩৬০’।

তিনি বলেন, দেশে প্রতি ২৩ মিনিটে একজন ধর্ষিত, প্রতি ১৫ মিনিটে একজন শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হয় এবং প্রতি ৫৩ মিনিটে একটি যৌন সহিংসতার ঘটনা ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে আমার কাছে মনে হয়েছিল সংগঠনটি গড়ে তোলা খুবই প্রয়োজনীয় এবং সময়োপযোগী।

যার গল্প বলছিলাম, তিনি ‘ইভোলিউশন৩৬০’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি উপমা। পুরো নাম আনিকা সুবাহ আহমেদ উপমা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের পর কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের প্রভাষক হিসেবে যুক্ত হলেও বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের ভারপ্রাপ্ত প্রধান হিসেবে কর্মরত।

ছেলেবেলা থেকেই সব ধরনের কাজে বাবা-মায়ের সাপোর্ট পাওয়া উপমার বাবা ইফতেখার উদ্দিন আহমদ বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ-মহাব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত এবং মা নাজমা খানম একজন ব্যবসায়ী উদ্যোক্তা। ছোট থেকেই সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি আসক্তি থাকায়, অর্জনের পাল্লাটাও ছিল ভারী। সাধারণ জ্ঞান, ইসলামিক জ্ঞান, গান, উপস্থিত বক্তৃতা, বিতর্কসহ সহশিক্ষা কার্যক্রমে ছিল সমান পারদর্শী। পাশাপাশি উচ্চমাধ্যমিকে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডগার্ল হিসেবেও অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি।

২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে ১৫ জন সদস্য নিয়ে যাত্রা শুরু করা সংগঠনটি সারা দেশে এখন প্রায় ৫০০ সদস্য নিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। শুরুতে আর্থিক অসংগতি, বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা (বিশেষত নারী সদস্যদের মাঠপর্যায়ে অংশগ্রহণে পারিবারিক বাধা), প্রতারণা, সাইবার বুলিং, ভুয়া ফেসবুক আইডি খুলে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর মতো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হওয়া সত্ত্বেও ইচ্ছাশক্তিকে পুঁজি করে নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে উপমার ‘ইভোলিউশন৩৬০’।

সংগঠনটি এসডিজির লক্ষ্য পূরণে পুরো বাংলাদেশে ইউএন উইমেনের নির্দেশনা অনুযায়ী ‘হি ফর শি’ নামে একটি ক্যাম্পেইনের প্রচার করে থাকে। যা লোকালি ক্যাম্পেইন ‘পরিবর্তন : বি দ্য চেঞ্জ’ বলা হয়। এই ক্যাম্পেইনের প্রধান উদ্দেশ্য ছেলেদের কনসেন্ট এবং বিপরীত লিঙ্গের প্রতি যে ব্যবহার করা উচিত তা শেখানো এবং মেয়েদের ব্যক্তিগত আত্মরক্ষা শিক্ষা দেওয়া।

এ ছাড়া ‘গুড টাচ ব্যাড টাচ’ ক্যাম্পেইন করে থাকে সংগঠনটি। এই ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে তিন থেকে দশ বছর বয়সের শিশুদের ভালো এবং মন্দ স্পর্শের পার্থক্য শেখানো হয়। তা ছাড়া বিভিন্ন সময়ে পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ধরনের ক্যাম্পেইন এবং প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করে সংগঠনটি। যুব সংগঠনটি ইউএন উইমেনের ‘উই কমিট ক্যাম্পেইনের’ গ্লোবাল এলাই হিসেবে বর্তমানে কাজ করছে। বিশেষ ইভেন্টের মধ্যে, প্রতি বছর সারা দেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে জাতীয় পাবলিক স্পিকিং প্রতিযোগিতা ‘স্পিক ফর চেঞ্জ’ আয়োজন, ট্যালেন্ট ট্রাঞ্জিশন, অ্যাক্ট ফর ইক্যুয়ালিটির ইত্যাদি ইভেন্ট পরিচালনা করেছে।

নিজ দেশের প্রতিনিধিত্ব করার বিষয়ে উপমা বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজের দেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারার অনুভূতিটা বরাবরই আনন্দ দেয়। বেশ কয়েকবার বাংলাদেশকে ইউএন উইমেনে রিপ্রেজেন্ট করেছি। ২০১৬ সালে যখন প্রথমবার বাংলাদেশের পাশে নিজের নামটা দেখেছিলাম, তখন বুঝতে পেরেছিলাম আমার জীবনের একটা লক্ষ্য তৈরি হয়ে গেছে।’

জীবনের বাঁকে বাঁকে অনেক কিছুই হতে চেয়েছিলেন তিনি। খুব ছোটবেলা হতে চেয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। তারপর বিনোদনজগতে স্থায়ী হওয়ার ইচ্ছাসহ আরো অনেক কিছুই। তার পড়াতে ভীষণ ভালো লাগে। সেই সুবাধে কয়েক বছর ধরে করপোরেট ট্রেনিংসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পড়াচ্ছেন। বর্তমানে তিনি একজন শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘তরুণ প্রজন্মের কাছাকাছি যেতে এবং তাদের মোটিভেট করতে এবং তাদের এনার্জিটা পেতে ওদের কাছাকাছি থাকতে ভালো লাগে। সেজন্যই টিচিংকেই প্রফেশন হিসেবে নেওয়া।’

অর্জনের পাল্লাটাও হালকা নয় তার। সংগঠনটি বিভিন্ন সময়ে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পদকে ভূষিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ইউএনডিপি, ইউএনভি ও ইউথপিয়া বাংলা থেকে পেয়েছে সমাজসেবা পুরস্তার। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ‘ইন্টারন্যাশনাল আর্ক অব ইউরোপ’ নেতৃত্ব ও উৎকর্ষতা শাখা (গোল্ড) ক্যাটাগরিতে নির্বাচিত হয়ে ‘উদ্যোগের অস্কার’ অর্জনে, ‘বঙ্গবন্ধু ডিজিটাল সোশ্যাল ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’, ‘ভলান্টিয়ার অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’, ২০২১ সালে ‘রিপাবলিক অব উইমেন’ কর্তৃক আয়োজিত ‘বিউটি ইউথ ব্রেইন’র সেরা দশের তালিকাসহ ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড জমা হয়েছে সাফল্যের ঝুড়িতে। তা ছাড়া জাতিসংঘের এসডিজি নেটওয়ার্কের একজন অ্যাম্বাসেডর হিসেবে বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করার চেষ্টায় কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। অর্জিত পুরস্কারগুলো একেকটা তার অনুপ্রেরণা বলে তিনি মনে করেন। এ বিষয়ে উপমা বলেন, ‘পরিবর্তনের লক্ষ্যে যখন কাজ শুরু করি তখন কোনো পদক বা পরিচিতির আশায় কাজ শুরু করিনি।’

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে উপমা বলেন, ‘নিজের মাধ্যমে এবং ইভোলিউশন৩৬০-এর মাধ্যমে বাংলাদেশে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে চাই।’

একজন নারী হয়ে পরিবর্তনের পথটা মোটেই সহজ ছিল না। রয়েছে ত্যক্ত বা প্রতিবদ্ধকতামূলক অভিজ্ঞতা। তিনি নিজেই এ ধরনের বৈষমের শিকার হয়েছেন। বিভিন্ন কাজ বা প্রস্তাবনা পেশ করতে গিয়ে পেয়েছেন অনেক কুপ্রস্তাব। তিনি বলেন, ‘আমি যা প্রতিরোধে কাজ করি, তার সম্মুখীন আমাকেও হতে হয়েছে। কাছের মানুষদের থেকে হয়েছি প্রতারিত।’

নারী অধিকার বিষয়ে কাজ করতে গিয়ে বার বার হুমকি আসা সত্ত্বেও তিনি সবসময় বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলে যাবেন বলে আশা ব্যক্ত করেন।

উপমা বলেন, ‘বরাবরের মতো ভালো কাজ অব্যাহত রাখতে চাই। আর আমার কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা এখন আরো বেশি, বিষয়টা মাথায় রেখে সামনে এগিয়ে যেতে চাই। কারণ দিনশেষে এটা আমার চলার পথের সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads