• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

শিল্পী অধ্যাপক হামিদুজ্জামান খানের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ পর্ব : বারো

  • প্রকাশিত ২৪ অক্টোবর ২০২১

ভাস্কর শিল্পী : আইভি জামান

 

শিল্পী হামিদুজ্জামান উনিশ-শ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ওই সময়টা ঢাকায়, পঁচিশ-এ মার্চের ভয়ঙ্কর কালো রাত। পরদিন ছাব্বিশ মার্চ, রাতের বেলা পাক আর্মিরা এসে হাজির হামিদুজ্জামানের রুমে।

শেরেবাংলা নগরে কর্মচারীদের আবাসিক ভবনের একটি রুম নিয়ে থাকতেন। অভিনয় শিল্পী টেলি সামাদ উনিও চিত্রশিল্পী ছিলেন। পরে অবশ্য অভিনয় কৌতুকশিল্পী হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন। উনি হামিদুজ্জামান খানের এক বৎসরের অগ্রজ ছিলেন চারুকলায়।

থাকতেন হামিদুজ্জামানের পাশের বাসায়। তাঁর সাথে হামিদুজ্জামানের খুব ভালো যোগাযোগ  ছিল। প্রতিদিন দেখা হতো। যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো সাথে সাথেই শিল্পী  টেলি সামাদ পরিবার নিয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় হামিদুজ্জামানকে বললেন তুমি আমার বাড়িতেই থাকো। হামিদুজ্জামান তাঁর ভাইয়ের ছেলেকে  নিয়ে থাকতেন। তাঁরা দুই জনই ইয়াং। একদিন রাতে প্রায় দুইটা-আড়াইটার সময় পাঁচ-ছয় জন আর্মি এসে টহল দিচ্ছিল এবং বাড়িতে ঢুকেই জানতে চাইল তোমরা কী করো? হামিদুজ্জামান খান ও তাঁর  ভাইয়ের ছেলে আগেই ঠিক করে রেখেছেন কি বলবেন।

তখন হামিদুজ্জামান চারুকলার শিক্ষক রেজাউল করিম তাঁর ভাইয়ের ছেলে হাইস্কুলের ছাত্র। দুজনেই বললেন রং-টং নিয়ে কাজ করেন। যদি শোনে ছাত্র ও ইউনিভার্সিটি থেকে পাশ করেছেন, সাথে সাথেই মেরে ফেলতে পারে। হামিদুজ্জামানকে পেছন থেকে হাত ধরল, প্রায় গুলিই করে এই অবস্থা । পরে সব আর্মিরা ভিতরে ঢুকলো, বাড়ি সার্চ করল। বাড়ি পুরাটাই সব উল্টাপাল্টা করল, মানে আর্মস-টার্মস কিছু আছে কিনা? তার পর

হামিদুজ্জামানকে...বলল, ‘তোমকো ছোড় দিয়া।’ বলে জোরে ধাক্কা দিয়ে বাইরে চলে গেল। যাওয়ার সময় ওরা অনেক দামি জিনিস নিয়ে গেছে। পাশের বাসায় ঢুকে অত্যাচার করেছে। তাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এগুলো আশপাশে হচ্ছিল। এই সময়টা ছিল খুব ক্রুশিয়াল সময় ।

এগুলো হলো কারফিউ ব্রেকগুলোর মধ্যেই। পঁচিশ মার্চের রাতের পর ছাব্বিশ, সাতাশ তখন কারফিউ ছিল। কারফিউ দুই ঘণ্টার ব্রেক করত। তখন লোকজন বের হতো। হামিদুজ্জামান যখন এ রকম একটা ধাক্কা খেলেন, পরের দিন তিনি তাঁর ভাইয়ের ছেলেকে নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। হাঁটতে হাঁটতে নিউমার্কেট-এর দিকে আসলেন। চারুকলা থেকে হামিদুজ্জামান একটু দূরে থাকতেন। তিনি তখন চারুকলায় শিক্ষক ছিলেন। এসে কাজগুলো সেরে চলে যেতেন। তখন টিচারের বেতন ছিল মাত্র তিন-শ টাকা।

পঁচিশ, ছাব্বিশ, সাতাশ তারিখে একটু লম্বা কারফিউ ছেড়েছে, তখন হামিদুজ্জামান বেরিয়ে পড়েছেন। তখন তিনি নিজে দেখেছেন নিউমার্কেট-এর কাছেই ডেডবডি পড়ে আছে । কুকুর অর্ধেক খেয়ে ফেলেছে, এ রকম অবস্থা। তারপর হামিদুজ্জামান ও তাঁর ভাইয়ের ছেলে রেজাউল করিমকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন, হঠাৎ দেখতে পেলেন, পেটটা ফুলে আছে মানুষের। এগুলো দেখেছেন স্বচক্ষে। এগুলো পরে হামিদুজ্জামান খানের স্কাল্পচারে এসেছে। নদী পার হওয়ার পরে একটা ট্রাক পেলেন, ট্রাকের মধ্যে উঠলেন।

নদীর ওপারের, ট্রাকে উঠে নরসিংদীর কাছাকাছি গেলেন। ওখানে নামিয়ে দিল আর কোনো রাস্তাই নাই যাওয়ার। হামিদুজ্জামানের বাড়ি তখনো অনেক দূর। হয়তো এখনো প্রায় এক শ কিলোমিটার। আর্মিরা তখন ঘুরছে, যাকে খুশি ধরে নিয়ে যাচ্ছে।

হামিদুজ্জামান ও রেজাউল করিম নৌকা দিয়ে পার হয়ে একটু গ্রামের দিকে যেতে চেষ্টা করলেন। যেতে যেতে অনেক পরিচিত লোকের সাথে দেখা হয়েছে। তখন একটা গ্রুপের মতো হয়ে গেল। আর একটাই উপায় হলো হাঁটা। তারপর নৌকা নিয়ে পার হয়ে ভৈরব গেলেন। ভৈরব থেকে হামিদুজ্জামান খানের গ্রামের বাড়ি পঞ্চাশ কিলোমিটার। পুরোটাই হেঁটে গেলেন। পা ফুলে যাওয়ার মতো অবস্থা । হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি চলে গেলেন।

হামিদুজ্জামান বাড়ি যেয়ে কয়েক দিন একটু ভালোই ছিলেন। বাবা মার খুব খুশি, কারণ তাঁরা তো শুনেছেন ঢাকা শেষ, খুব কষ্টে ছিলেন। হামিদুজ্জামান-এর বাড়িটা যেহেতু স্টেশনের কাছে, একদিন  গ্রামে পাক বাহিনীরা আগুন দিল। হামিদুজ্জামান সেখান থেকে পালালেন। তিনি সবার সাথে দৌড়াতে  দৌড়াতে বহুদূর চলে গেলেন।

হামিদুজ্জামান এগুলো তো নিজের চোখেই দেখেছেন। হামিদুজ্জামান যখন স্কাল্পচার শুরু করেছেন, এসব অভিজ্ঞতার প্রভাব আছে। যখন তিনি স্কাল্পচার করছেন ওই জিনিসগুলো প্রকাশ করার চেষ্টা করেছেন তাঁর স্কাল্পচারে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করেছেন আট থেকে দশ বছর। সেভেনটি ফোর-ফাইভ থেকে, এইটটি ফোর পর্যন্ত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads