• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ০৭ নভেম্বর ২০২১

দক্ষিণাঞ্চলের (পিরোজপুর) বলেশ্বর নদী তীরবর্তী জেলে জনগোষ্ঠীর শিশুদের জীবনমান উন্নয়ন, তাদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত, নিজস্ব সংস্কৃতি বিকাশ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ করার পাশাপাশি তাদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সৃষ্টি করতে কাজ করে যাচ্ছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। দারিদ্র্য এ জনগোষ্ঠীর শিশুরা শিক্ষাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত যার ফলে সামাজিক ভাবে তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। সমাজের অন্যদের সাথে বৈষম্য দূরীকরণে তাদের জন্য কাজ করছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। পিছিয়ে পড়া এই জেলে জনগোষ্ঠীদের নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি সমাজ উন্নয়নে কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন অর্জন করে জয় বাংলা ইয়ূথ অ্যাওয়ার্ড-২০২০।

২০১৮ সালের ১৭ মার্চ হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের যাত্রা শুরু। শুরুর পর থেকে বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে জেলে জনগোষ্ঠীর শিশুদের কল্যাণে কাজ করে যাচ্ছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। প্রজেক্টের বাইরেও তারা কাজ করছে সামাজিক ব্যাধি বাল্যবিবাহ এবং ইভটিজিং প্রতিরোধে। সরকারি টোল ফ্রি নম্বর ৯৯৯, ১০৯ এর সুবিধাসমূহের তথ্য দেওয়ার পাশাপাশি মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন আদর্শকে নতুন ও তরুণ প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে তারা করছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক শিশু চলচ্চিত্র প্রদর্শনী উৎসব। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় রাস্তার ধার জেলেদের বাড়ির আঙিনা ও বিভিন্ন স্থানে তারা করে যাচ্ছেন বৃক্ষরোপণ। যাদের নিরলস পরিশ্রমে এগিয়ে যাচ্ছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তড়িৎ প্রকৌশলী মো. রুবেল মিয়া নাহিদ। তিনি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। যার দিকনির্দেশনায় এগিয়ে যাচ্ছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন।

হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের  কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তরুণ উদ্যোক্তা সুমন চন্দ্র মিস্ত্রি সজিব। তিনি ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি। যার পরিশ্রম ও পরিচালনায় এগিয়ে যাচ্ছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। সজিব উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যয়নরত আছেন । সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন সৌরভ হাওলদার। তিনি নীল গার্মেন্টস ডিজাইন প্যাটারনিটি (টেক্সটাইল) নিয়ে পড়াশুনা করছেন। সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্বে রয়েছেন শান্ত মিত্র। ব্যবস্থাপনা বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষে পড়াশুনা করছেন । কোষাধ্যক্ষের দায়িত্বে রয়েছেন জয়া হাওলাদার পড়াশুনা করছেন অনার্স তৃতীয় বর্ষে । এছাড়াও সক্রিয়ভাবে কাজ করছেন কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি উজ্জ্বল ঘরামী, তন্ময় হাওলাদার যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক অভি মন্ডল, প্রচার সম্পাদক বেল্লাল খান রানা, শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক সৌরভ হাওলাদার। যারা সংগঠনের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে ফাউন্ডেশনের ব্যানারে থেকে কাজ করে যাচ্ছেন জেলে জনগোষ্ঠীর শিশুদের জীবনমান উন্নয়ন, সমাজ উন্নয়নের পাশাপাশি দেশ ও দশের কল্যাণে।

সংগঠনের দুই তরুণ  উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান মো. রুবেল মিয়া নাহিদ এবং  প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি সুমন চন্দ্র মিস্ত্রি সজিব জানালেন, আমাদের বয়সের কিছুটা ফারাক থাকলেও আমাদের চিন্তা-চেতনা ছিল প্রায় একই রকম। যে কারণে আমরা একসাথে চলাফেরা করতাম। মাঝে মাঝে আমরা দুজন মিলে ঘুরতে যেতাম বলেশ্বর নদীর তীরে। ঘুরতে গিয়ে দেখতাম খুব অল্প বয়সে নানারকম শিশুশ্রমের সাথে জড়িয়ে পড়ছে ওখানকার শিশুরা। বাবার সাথে মৎস্য শিকারে যাচ্ছে জেলে পরিবারের শিশুরা। এসব দেখে আমরা ভাবি এদের জন্য কিছু করা যায় কিনা। এরপর আমরা দুজনে মিলে আলাপ আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে আরো কয়েকজন পরিচিত জনদের নিয়ে গড়ে তুলি হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন।

জেলে শিশুদের কল্যাণে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন কাজ করে বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে। যে সমস্ত শিশুদের নেই স্কুলে যাওয়ার সুযোগ সে সমস্ত শিশুদের জন্য রয়েছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের ‘হাতে খড়ি ফ্রাইডে স্কুল’।

বলেশ্বর নদী তীরবর্তী এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রায় ৮০ভাগ শিশুই নানারকম কারণবশত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। আর এসকল শিশুরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শিশুশ্রমের সাথে জড়িত। সেই সমস্ত শিশুদের এই সংগঠন ‘হাতে খড়ি ফ্রাইডে স্কুল’র আওতায় এনে তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছে শিক্ষার আলো। আবার অনেক অভিভাবক আছেন যারা তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে চান না। আধুনিক এই যুগে এসেও প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই অভিভাবকরা মনে করেন জীবনে পড়াশুনার কোনো মূল্য নেই। এর চেয়ে তার সন্তানরা অর্থ উপার্জন করবে, সংসার ভালোভাবে চলবে। সেই সব অভিভাবক ও তাদের সন্তানের জন্য রয়েছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের প্রজেক্ট আলো। আলো প্রজেক্টের মাধ্যমে ওই সব অভিভাবক ও পড়াশুনায় অমনোযোগী শিশুদের পড়াশুনার গুরুত্ব বুঝিয়ে তাদেরকে পড়াশুনায় মনোযোগী করতে নানারকম কাউন্সেলিং করে থাকেন হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের সদস্যারা। হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের সদস্যদের কাউন্সেলিংয়ের পর থেকে স্কুলমুখী হয়েছে পড়াশুনায় অমনোযোগী অনেক শিশুরা।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই শিশুদের জন্য নেই কোনো খেলাধুলার ব্যবস্থা। পড়াশুনা করতে করতে যখন তারা ক্লান্ত, তাদের মধ্যে বাসা বাঁধে একঘেয়েমিতা। তখন তাদের প্রয়োজন একটু খেলাধুলার। কিন্তু নানা কারণে সেই সুযোগ পায়না এই সব জেলে জনগোষ্ঠীর শিশুরা। তাদেরকে একটু বিনোদন দিতে প্রায় সময় তাদের জন্য হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন আয়োজন করে উপকূলে আনন্দ বিলাস। যেখানে থাকে জেলে শিশুদের জন্য নানারকম খেলাধুলার আয়োজন ও পুরস্কারের ব্যবস্থা।

প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই সব শিশুদের মাঝে নেই কোনো আনন্দ। তাদের মাঝে স্পষ্ট অভাব রয়েছে বিনোদনের। তাদের এই অভাব ঘোচাতে তাদেরকে আনন্দিত করতে বিভিন্ন সময়ে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন আয়োজন করে চিত্তবিনোদনের। তাদের জন্য আয়োজন করা হয় প্রজেক্ট প্রদর্শনী । যে প্রদর্শনীর মাধ্যমে জেলে শিশুদের সামনে প্রদর্শিত হয় শিশুতোষমূলক সিনেমা, নানা রকম শিক্ষণীয় ভিডিও। যেখান থেকে শিশুরা আনন্দিত হওয়ার পাশাপাশি শিখতে পারে নতুন কিছু। তারা পরিচিত হয় আধুনিক কিছু যন্ত্রের সাথে (ল্যাপটপ, ট্যাব, প্রজেক্টের) ইত্যাদি।

হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়ে স্কুলমুখী হয় জেলে শিশুরা। তবে বিপত্তি বাধে বর্ষা মৌসুমে। স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায় এই সময়ে। যেখানে নেই তাদের পড়াশুনার সুযোগ সেখানে বৃষ্টিতে ছাতা ব্যবহার তাদের কাছে অলীক স্বপ্ন। বর্ষাকালে বৃষ্টির কারণে স্কুলে যেতে পারে না এই সব শিশুরা। এসময়ও তাদের পাশে দাঁড়ায় হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। তাদেরকে উপহার দেয় রঙিন ছাতা, কর্দমাক্ত পথ পাড়ি দিয়ে মাথার ওপর রঙিন ছাতা নিয়ে আনন্দে স্কুলে পৌঁছায় জেলে শিশুরা। দুপুরের টিফিন নিয়ে যাওয়ার জন্য তাদেরকে দেওয়া হয় সুন্দর সুন্দর টিফিন বক্স, পানি নিয়ে যাওয়ার জন্য ওয়াটার পট। অনেক জেলে শিশু আছে যারা মনে করে তাদের দয়া করা হচ্ছে। এই সংগঠন তাদের দয়া করছে না সেজন্য তারা আয়োজন করে এক টাকার মিনি মার্কেট। যে মার্কেট থেকে শুভেচ্ছা মূল্য এক টাকার বিনিময়ে বাচ্চারা কিনে নিতে পারে তাদের প্রয়োজনীয় উপকরণটি। এক টাকার মিনি মার্কেটে প্রতিটি শিশুর জন্য থাকে এক একটি প্যাকেজ। যে প্যাকেজে থাকে তাদের খুব প্রয়োজনীয় চার-পাঁচটি শিক্ষা উপকরণ। এছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রজেক্টের মাধ্যমে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন কাজ করে যাচ্ছে জেলে শিশুদের কল্যাণে। জেলে জনগোষ্ঠীর শিশুদের কল্যাণে কাজ করার পাশাপাশি সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখা হাতে খড়ি ফাউন্ডেশনের সফলতার ঝুড়িতেও রয়েছে পূর্ণতা। কল্যাণকর এই কাজে যেমন আছে সফলতা আছে প্রতিবন্ধকতাও। থাকে আর্থিক সমস্যা। থাকে নানারকম প্রতিবন্ধকতা। জেলে জনগোষ্ঠীর কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে বেশ কয়েকবার ছোট বড় ঝামেলার সম্মুখীন হয়েছে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন। সব প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে কল্যাণ ও সফলতা নিয়ে হাতে খড়ি ফাউন্ডেশন একটি সফল সংগঠন। হাতে ফাউন্ডেশনের এই কল্যাণকর কাজ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছেন সংগঠনের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সদস্যরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads