• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

ফিচার

আগুনপাখি ও টুকরো স্মৃতি

  • প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০২১

বঙ্গ রাখাল

 

দুচোখে স্বপ্ন—মনে আশা— জীবন-বাস্তবতাকে বোঝার চেষ্টায় দিনকে দিন হাঁকিয়ে ছুটি—বাস্তবতার ঘোড়া। সবে বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করে জীবনকে বুঝার চেষ্টা চলছে। আড্ডা মারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধু কিংবা পরিচিত কবিদের সঙ্গে—এ সময় পরিচয় ঘটে কবি মাসুদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি মাঝে মাঝে শিক্ষক ক্লাবে নিয়ে আমাদের খাওয়াতেন এবং আড্ডা মারতেন। এভাবেই দিন চলছে— হঠাৎ একদিন তিনি আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাকলেন, নিয়ে গেলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে। কিন্তু আসার পূর্বেও আমি কিছুই জানি না, কোথায় বা কেনো আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার কাছে সবকিছু উন্মোচিত হলো। এখানে গত রাতে এসেছেন বাংলার কিংবদন্তী কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক (১৯৩৯-২০২১)। তিনি মূলত কোনো একটা পুরস্কার পেয়েছেন, সেই অনুষ্ঠানে এসেছেন এবং এই কেন্দ্রেই তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। ইতিমধ্যে ‘ভারত বিচিত্রা’ থেকে একজন এসে হাসান আজিজুল হকের কাছ থেকে একটা লেখা নিয়ে গেছেন। লেখা বলতে হাসান আজিজুল হক বলছেন এবং তিনি লিখে যাচ্ছেন। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লোকজন কিংবা তাঁর ভক্ত অনুরাগীরা এসে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে যাচ্ছেন।

এখন আর কেউ নেই, আমি আর কবি মাসুদুজ্জামান প্রবেশ করলাম স্যারের কক্ষে। তিনি হাসি মুখে বসতে বললেন—পরে বললেন মাসুদ তোমার খবর কি? কিছু কথাবার্তার পরেই মাসুদুজ্জামান স্যার আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন—ওর নাম বঙ্গ রাখাল। ভাল কবিতা লিখছে—প্রবন্ধও লেখে ভাল। আজিজুল স্যার কিছু সময় আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন বাহ ভাল তো, এখন প্রবন্ধের মানুষ কম। চালিয়ে যাও—থামবে না। সাহিত্যের কাজ হলো চালিয়ে যাওয়া। এখানে কোনো থামার জায়গা নাই। তাই বলেই তিনি ছুটলেন ওয়াশ রুমের দিকে। এরই মধ্যে কবি তুষার কবির আসলেন— স্যারকে তার কি একটা বই দিলেন এবং স্যারের সঙ্গে এই স্মৃতি ধরে রাখার জন্য ক্যামেরাবন্দি করে রাখলেন। স্যারের এই সময় আমি এবং মাসুদুজ্জামান স্যার একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম বেশ দীর্ঘ সময় ধরে। পরে স্যার আমাকে তঁর লেখা একটা ছোট বই উপহার দিয়েছিলেন। এভাবেই প্রথম সাক্ষাতে স্যারের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

হাসান আজিজুল হক নামটার সঙ্গে আমি পরিচিত হই তাঁর ‘শকুন’ গল্পটির মধ্য দিয়ে। পরবর্তীতে ক্যাম্পাস জীবনে পড়েছি আগুনপাখি, আত্মজা ও একটি করবী গাছ, জীবন ঘষে আগুন। ষাটের দশকে তিনি কথাসাহিত্যে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন করেছেন— যাকে বলা হয় নির্মাণ ধারার সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত কথাসাহিত্যিক। তিনি সৃষ্টি করেছেন এক নব ভাষা শৈলী যা একজন আজিজুল হকের নিজস্ব ভঙ্গিকেই উপস্থাপন করে। হাসান আজিজুল হকের সাহিত্যে ঠাঁই পায় সেসব মানুষেরা যারা বিরূপ নির্মমতার শিকার, যাদের জীবন কাটে আর্থিক অভাব সংকটে। তিনি তাদের কথায় বলতে চান যাদের জীবন নিপীড়ন অভাব-বঞ্চনার শিকার, চোর, ভিক্ষুক, দিনমজুর চাষী হয়ে ওঠে তাঁর গল্পের মূল উপাদান। হাসান তাঁর গল্প বয়ানে সামান্য কিছুকেই মুহূর্তে অসামান্য বানিয়ে ফেলতে পারেন। আজিজুল হক নিজের চোখে দেখেছেন মানুষের এই যাতনাময় জীবন যে কারণে তিনি বারংবার বলতে চেয়েছেন এইসব সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের গল্প। তাঁর লেখায় সব সময় উঠে আসে— দেশভাগ, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, শরণার্থী সমস্যা, পাকিস্তানের স্বৈরশাসন, বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের বাস্তবতা, গণতন্ত্রের অপমৃত্যু ইত্যাদি। হাসানের লেখার মধ্যে প্রকাশিত হয় জীবন-জটিলতা কিংবা যাপনের জীবন ঘনিষ্ঠতার নানা উপাদান।

হাসান আজিজুল হকের ‘আগুনপাখি’ উপন্যাসটি পড়ে কিছুক্ষণ চুপ হয়ে বসে ভেবেছিলাম— এই লেখক এভাবে দৃশ্যগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরেন কি করে! তিনি এই গ্রন্থটির জন্য পশ্চিমবঙ্গের ‘আনন্দ পুরস্কার’ও পেয়েছেন। ‘আগুনপাখি’ মূলত দেশভাগেরই গল্প। যা একজন নারীর বাস্তু প্রীতি মমতাবোধেরই আখ্যান। ‘আরে কি মুশকিল? পাকিস্তান যাব কেন? নিজের দেশ ছেড়ে?’ বর্ধমানের একটি মুসলিম পরিবারকে কেন্দ্র করে এর ডালপালা বিকশিত হয়েছে। এখানে উঠে এসেছে— দেশভাগের  পূর্বাপর ইতিহাস— এককথায় লেখক এই পাত্র-পাত্রীর মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, দাঙ্গা পরবর্তী মানুষের জীবন এসব কিছুই একজন নিরক্ষর নারীর দৃষ্টিতে বর্ণনা করেছেন। আমরা এই উপন্যাসে যে নারীর দেখা পাই সেই নারী নিজের সংসার, সমাজ, ধর্ম, দেশের প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়িয়েছেন। এই উপন্যাসের সমস্ত কথা বলেন মেজ বউরুপি এই নারী। যে কথা শুরু হয় তার শৈশব থেকে আর পরিসমাপ্তি ঘটে দেশভাঙ্গনের পরে তার একাকিত্বময় জীবনযাপন করার মধ্য দিয়ে। মানুষের নিজের জীবনের কথা কতটুকুই বা থাকে— শুরু হয় বাবার কথা, মায়ের কথা, বিয়ের কথা, সেই সময়য়ে সবাই মিলে মিশে বসবাস করার কথা। সংসার হয়ে গেলে কিই-বা থাকে তার কথা। বাবার সংসারে একটা মেয়ে যতটা স্বাধীন থাকে, স্বামীর সংসারে তো তাও থাকে না, কমে যায় তার কথা বলা। তাইতো তার মনের চিলেকোঠায় জন্ম নেয় অনেক না বলা কথা— ‘জেবনের কুনো কাজ নিজে নিজে করি নাই, নিজের ইচ্ছা কেমন করে খাটাতে হয় কুনোদিন জানি নাই। আমি কি মানুষ না মানুষের ছেঁয়া? তাও কি আমার নিজের ছেঁয়া?’ এই উপন্যাসে কোনো নারীকেই নিষ্ঠুর রূপে দেখা যায় না। যেমন সৎমা বা কর্তামা কারও মধ্যেই এমন আচরণের দেখা মেলে না। বালিকা মেয়েটার মা ছিল না ছিল এক দাদি। তাও সে তো আপন হতে পারে না, কারণ সে ছিল বাবার খালা। কিছুদিনের মধ্যেই ঘরে আসে এক সৎমা। এই মার সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল বন্ধুর সম্পর্ক। তাও এটা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কয়েকদিন পরে বিয়ে হয়, পোয়াতী সৎমা কাঁদতে কাঁদতে বিদায় দেয় তাকে। প্রবেশ করে বিশাল এক যৌথ পরিবারে। যেখানে নিজের ভাবনার কোনো সময় নেই। এখানে অন্যের হুকুম পালন করাই শ্রেয়। এই মেজ বউ তার জীবনেরই গল্প করেছেন নানাভাবে— যা আমাদের সেই সময়কে বুঝতে সহজ করে দেয়।

‘আগুনপাখি’ উপন্যাসের এগিয়ে যাওয়া একটি নারীর জীবনের গহীনের গল্প নিয়ে— যেখানে হাহাকার, যন্ত্রণা, দেশভাগ, রক্তপাত—যেন বহুল মানুষের অনুভব একটি মানুষের অনুভব হয়ে একজন নারীর মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। এই উপন্যাসকে হাসান আজিজুল হক এমন একটি উপন্যাস করতে চেয়েছেন—যা ভারত বিভাজনকে দেখা হবে একজন নারীর আত্মা বা হূদয় দিয়ে এবং তিনি তা উপস্থাপনও করেছেন যথযাথ ভাবে। নারী উপলব্ধি করেছেন তার জীবন দিয়ে, আত্মা দিয়ে; আর সাম্প্রদায়িকতা, পুঁজিবাদ, দাঙ্গার বিপরীতে অবস্থান নেওয়া এই যে নারীরা সর্বদা থেকেছেন সচেতন। তবু সবকিছুর বিরুদ্ধে কিংবা শিকার হয়েছে সমাজের নিম্নকোটার লোকজন। তারা যেমন অবহেলিত আবার সময়ের প্রয়োজনে প্রতিবাদীও। হাসান আজিজুল হক সেসব স্মৃতিকে আশ্রয় করেই নির্মাণ করেছেন ‘আগুনপাখি’র কাঠামো—যার সবটাই তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মায়ের কাছ থেকে। এই মায়ের বর্ণনায় যেমন মেজ বউয়ের জবানিতে জীবন্ত হয়ে আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায় অতীতের দিকে। এই অতীতই নিজেকে চিনিয়ে দেয়—বারে বারে, সময় আর ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে। প্রবহমান জীবনের বাঁকে বাঁকে লুকিয়ে থাকে কত মানুষের জীবন, হাহাকার, নির্মমতা রক্তের দাগ, রাষ্ট্রের নানা কারসাজির মধ্যেও মানুষের থাকে বেঁচে থাকার হিমচাহনি। এই বেঁচে থাকার বোধই তো মানুষকে সংগ্রামী করে তোলে—একজন মেজবউ সেই সংগ্রামী আত্মার জীবন্ত উদাহরণ।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads