• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

ফিচার

গ্যালারি চিত্রকে হামিদুজ্জামান খানের ‘সৃষ্টির অন্বেষণ’

  • সালেহীন বাবু
  • প্রকাশিত ২৮ নভেম্বর ২০২১

এ অঞ্চলে আধুনিক ভাস্কর্যচর্চার সূচনা করেছিলেন পঞ্চাশের দশকে নভেরা আহমেদ। পরবর্তী সময়ে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক চারুকলা ইনস্টিটিউটে ভাস্কর্য বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেন। স্বাধীনতার পর যে শিল্পীদের চর্চায় বাংলাদেশে ভাস্কর্যচর্চা প্রসার ও গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে তাঁদের মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন শিল্পী হামিদুজ্জামান খান। ভাস্কর্য থেকে পেইন্টিংয়ে দেখিয়েছেন তার মুনশিয়ানা। ভাস্কর্য ও পেইন্টিং দুই ক্ষেত্রেই নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। এই বরেণ্য শিল্পী ও ভাস্করের শতাধিক ছবি ও ভাস্কর্য নিয়ে রাজধানীর গ্যালারি চিত্রকে গত শুক্রবার শুরু হয়েছে ৪৩তম একক শিল্প প্রদর্শনী  ‘সৃষ্টির অন্বেষণে’।

প্রায় এক সপ্তাহ সময় নিয়ে প্রদর্শনীর জন্য শিল্পকর্মগুলো স্থাপন করেছেন শিল্পী নিজে। গ্যালারির দেয়ালে ঝুলছে একের পর এক মুখাবয়ব, ল্যান্ডস্কেপ কিংবা কম্পোজিশন। ১৪ ফুট দীর্ঘ ও সাড়ে চার ফুট প্রস্থের বিশাল ক্যানভাসে শিল্পী মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করেছেন মুষল বৃষ্টিঝরা রাতে। যেখানে পড়ে আছে শহীদের লাশ। হামিদুজ্জামানের ছবিতে কালো বা ধূসর রঙের আপাত বিষাদের মধ্যে হঠাৎ ঝলকে উঠা লাল বা হলুদ রঙের ছটা দর্শককে আনন্দের উৎসমুখ দেখায়।

জলরং, অ্যাক্রিলিক এবং কালি-কলমে আঁকা প্রায় ১০০টি চিত্রকর্ম রয়েছে এ প্রদর্শনীতে। যেখানে শিল্পী এক ধরনের গবেষণার মধ্যে নিজেকে প্রবেশ করিয়েছেন। কালি-কলমে কাগজের ছোট ক্যানভাসের পাশাপাশি ২০ ফুট বা ১৪ ফুট দীর্ঘ ক্যানভাসেও মূর্ত হয়েছে তার বিমূর্ত ভাষা।

হামিদুজ্জামান খানের প্রচুর ভাস্কর্য এখন পর্যন্ত দেশে-বিদেশে স্থায়ীভাবে উন্মুক্ত উদ্যান ও সড়কদ্বীপে স্থাপিত হয়েছে। অথচ তাঁর শুরুটা হয়েছিল ড্রয়িং অ্যান্ড পেইন্টিং বিভাগের এক উজ্জ্বল শিক্ষার্থী হিসেবে, ভেবেছিলেনও হবেন পেইন্টার। একটা দুর্ঘটনা মোড় বদলে দিয়েছিল শিল্পী হামিদুজ্জামানের শিল্পীত অভিপ্সার। যদিও তিনি জলরঙের কাজেও খ্যাতি লাভ করেছেন, তদুপরি বাংলাদেশে ভাস্কর হিসেবেই বেশি পরিচিত তিনি।

হামিদুজ্জামান খান বাংলাদেশ সৃষ্টির ঐতিহাসিক ঘটনা, মুহূর্তকে স্থায়ীরূপ দিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশপ্তক, সিলেট জালালাবাদ সেনানিবাসের হামলা, বিজয়কেতন, জাগ্রতবাংলা প্রভৃতি কাজের মাধ্যমে। জয়নুলের মনপুরার মতোই উড়িরচরের সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগকে তিনি স্থাপনা শিল্পের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন, যা স্থান পেয়েছে জাতীয় জাদুঘরে। 

ভাস্কর্যের গতানুগতিক ধারাকে ভেঙেচুরে হামিদুজ্জামান খান সারা বিশ্বের প্রখ্যাত ভাস্করের মতোই সতত আধুনিকতার চর্চা করেছেন। ভাস্কর্য মানে যে শুধু মূর্তি-নির্মাণ নয় তা তিনি প্রমাণ করেছেন বঙ্গভবনের পাখি পরিবার থেকে শুরু করে সামপ্রতিক সময়ে করা ফার্মগেটের জাতীয় মাছ ইলিশ, ভাস্কর্যের মধ্য দিয়ে। সিউল অলিম্পিক পার্ক কোরিয়ায় হামিদুজ্জামান খানের ভাস্কর্য স্টেপস (সিঁড়ি) স্থায়ীভাবে স্থাপন করা হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য বয়ে এনেছে দুর্লভ সম্মান।

সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ হামিদুজ্জামানের প্রতিভা চিহ্নিত করেছিলেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সেই ১৯৬৪ সালে। তখন থেকেই জয়নুল আবেদিনের প্রিয় ছাত্র হামিদুজ্জামান খান শিল্পগুরুকে দেওয়া সব কথাই মেনেছেন অক্ষরে অক্ষরে।

শিল্প প্রদর্শনী ‘সৃষ্টির অন্বেষণে’ উপলক্ষে প্রকাশিত ব্রশিয়রে প্রয়াত শিল্পবোদ্ধা বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের একটি লেখা স্থান পেয়েছে। সেখানে তিনি লিখেছিলেন, ‘পেইন্টার হামিদুজ্জামান ও ভাস্কর হামিদুজ্জামানের কোথাও একটা মিল আছে। দুই ক্ষেত্রে, পেইন্টিং ও ভাস্কর্যের ক্ষেত্রে, একটা গতি জড়ানো, একটা গতির বিস্ফোরণ পেইন্টিং ও ভাস্কর্যকে উন্মীলিত করে রেখেছে। যদি বলি, একজন সভ্য মানুষ ছুড়ে ফেলেছে নিজেকে ঢেকে রাখার বর্ম, তাহলে হয়তো ভুল বলা হবে না। নিজেকে উন্মোচিত করার, নিজেকে উন্মীলিত করার, নিজেকে মেলে ধরার দ্বৈত মাধ্যম হামিদুজ্জামান খুঁজে পেয়েছেন। প্রকৃতি কিংবা নিসর্গ কিংবা সত্যের দিকে অগ্রসর হয়েছেন। এই অগ্রসর হওয়াটাই তার কাজের অন্তঃসার। নিজেকে প্রকাশ করার ক্ষমতা। তার কাজ, তার পেইন্টিং ও ভাস্কর্যকে বিভিন্ন মোটিফ দিয়েছেন। তিনি চিৎকার করে বলেছেন, দেখো দেখো, এখানেই আমার কাজের স্পষ্টতা ও নিষ্ঠুরতা। এখানেই তিনি যুক্ত করে দিয়েছেন আলোক, রং ও বাতাসের শব্দ। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, চন্দ্র উঠেছে, বাতাস চঞ্চল করে, আর আমি হামিদুজ্জামানের অনুভূতিতে অনিঃশেষ বাতাসের চিৎকার শুনেছি-এই হচ্ছে আমার ভাস্কর্য। বাতাস জড়িয়ে ধরেছে বৃক্ষ, বৃক্ষ জড়িয়ে ধরেছে পাখি, পাখি জড়িয়ে ধরেছে জনস্রোত, জনস্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে শিল্পীর চোখ। এই শিল্পী আমি, হামিদুজ্জামান, আর কেউ নয়। ইউরোপের তুষার ও ঢাকার বৃষ্টির মধ্যে আমি হামিদুজ্জামানকে এভাবেই ভিন্নভাবে বুঝতে শিখেছি।’

শিল্পী হামিদুজ্জামান খান তার এই ‘সৃষ্টির অন্বেষণে’ সম্পর্কে বলেন, ‘আমি জলরং করার জন্য ব্রাশটা যখন হাতে নিই, তখন ফর্মটা দ্রুত আসে। আমি মনে করি, পেইন্টিংয়ে অনেক দূর যাওয়া যায়। সবার ওপরে পেইন্টিং, তারপর ভাস্কর্য। ভাস্কর্যের উপাদানগত একটা বিষয় থাকে, সেই উপাদানকে বুঝতে হয়। পেইন্টিং ও ভাস্কর্য দুটি বিষয়ই কিন্তু কঠিন। তবে পেইন্টিং অনেকভাবে করা যায়। সেই জায়গা থেকেই আমি শেষ বয়সে এসে একটা এক্সপেরিমেন্টাল পেইন্টিং করার চেষ্টা করেছি। পেইন্টিংয়ে কতদূর যাওয়া যায়, কতভাবে যাওয়া যায়, সেটার একটা চেষ্টা করেছি। এটা একটা গবেষণার মতো। এ কাজটি করছি তিন-চার বছর ধরে। কোনো কোনো কাজ আমি তিন বছর ধরে লেয়ারের পর লেয়ার দিয়েছি। একটা ছোট্ট কাজ, কিন্তু বার বার করেছি। সেটা থেকে আমার এই ডেভেলপমেন্ট। এভাবেই পেইন্টিংয়ে একটা পরিবর্তন আনার চেষ্টা করেছি। এই প্রদর্শনীতে সেটার একটা প্রকাশ থাকবে।’

প্রদর্শনীটি চলবে আগামী ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শকের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads