শিক্ষা সংস্কার প্রস্তাবনা
রব্বানী আলেম হওয়ার মানচিত্র
লাবীব আব্দুল্লাহ
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৭:৫৩
মাদরাসার নামগুলো জামিয়া আরাবিয়া। জামিয়া অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়, আরাবিয়া মানে আরবী। আরবী বিশ্ববিদ্যালয়। পৃথিবীর সবচে অপব্যবহার হওয়া শব্দটি জামিয়া। আর এই অপব্যবহার হয় বাংলাদেশের কওমী মাদরাসায়। বৃটিশরা বৃটিশি আচরণে মাদরাসার নাম দিয়েছিলো খারেজি মাদরাসা। নেসাবের দিকে নিসবত করে কেউ কেউ বলতেন দরসে নেজামি মাদরাসা। ভারত পাকিস্থানে আরবী মাদরাসা বা দীনি মাদরাসা এবং বাংলাদেশে মাদরাসাগুলোর নাম হয়েছে কওমী মাদরাসা।
এক. পাকিস্থান ও ভারতে কওমী মাদরাসা বলা হয় না। এই মাদরাসা শব্দের অর্থ স্কুল হয় আরব দেশে। আলমাদরাসা আলইবতেদাইয়া মানে প্রাথমিক স্কুল। আরবী সাধারণত দীনি শিক্ষার ফরজ অংশ স্কুলেই দেওয়া হয়। আলাদা মাদরাসার প্রয়োজন মনে করে না মধ্যপ্রাচ্যে। মধ্যপ্রাচ্যে মসজিদে মসজিদে বিকেলে রয়েছে তাহফিজুল কুরআনের আয়োজন। বিকেল থেকে ঈশা। শিশুরা সকাল থেকে বিকেলে। স্কুলে বিকেলে তাহফিজে। সাধারণ শিক্ষার সাথে আগ্রহীরা হাফেয হয়ে যাচ্ছে। আমাদের দেশে মোল্লা ও মিস্টার বানানোর গলদ তরিকা। তবে আমাদের ঐতিহ্যের মাদরাসাকে আলিয়া মাদরাসা বা স্কুল বানানোর প্রয়োজন নেই এবং এ দেশের জনতা মাদরাসা শিক্ষার বিকৃতি, বিলুপ্তি, অন্যায়ভাবে নিয়ন্ত্রণের কোনো অপচেষ্টা মেনে নেয় নাই। নেবেও না। মাদরাসা ছিলো, আছে, থাকবে।
তবে মাদরাসাগুলো দাওরা খুলে জামিয়া বানাতে হবে এটি অযৌক্তিক। গের হর শব শবে কদর বুদে শবে কদর বেকদর বুদের অবস্থা এই দেশের জামিয়া। হঠাৎ মাদরাসার নাম আবার মারকায হয়ে যাচ্ছে। মারকাযুতৃৃ। মাদরাসার নাম আবার ক্যাডেট হয়ে যাচ্ছে। ক্যাডেট মাদরাসা।
মারকায ও ক্যাডেট মাদরাসার সুন্দর কোনো নাম নয়। ক্যাডেট প্রতারণা। আর মারকায একটি হয়। জামিয়ার নামের সঙ্গে আবার এতিমখানা জুড়ে দিয়ে ধান্দাবাজির মানসিকতাও আছে। এতিমদের লালন পালন বিশাল খেদমত কিন্তু জামিয়ার সাথে লেজুড় লাগালে সেটি হয় হাস্যকর এবং ধান্দাবাজের আয়োজন। এতিমদের সুযোগ থাকবে জামিয়ায় বা মাদরাসায় কিন্তু মাদরাসার নামের অংশ বানিয়ে এতিম ব্যবসা করা হয় কোথাও কোথাও। যারা এতিমের যথাযথ খেদমত করেন তারা মানণীয়। বরণীয়। স্মরণীয়।
দুই. বাংলাদেশের অধিকাংশ মাদরাসা জামিয়া হয়ে যাচ্ছে। আমি যে শহরে বসবসা করি সে শহরে জামিয়া মহিলাসহ বারোটি। মহিলা মাদরাসাও জামিয়া মহিলা মাদরাসা হয়ে যাচ্ছে। এবং শুরু থেকে তাহারা মাস্টার্স করছেন মাত্র আট বছরে। মহিলা জামিয়ার ক্লাসের নাম খুছুছী, মিযান, নাহবেমীর, কুদুরী, শরহে বেকায়া, হেদায়া, মেশকাত এবং দাওরায়ে হাদীস। হাজার হাজার মহিলা এই জামিয়াগুলো আবাদ করছেন এবং দ্রুত মাস্টার্স পাশ করছেন। কিন্তু ক্লাসের নাম ও পড়ালেখার নামে বাংলা নির্ভর কিতাবের নোট গাইডের যে ছড়াছড়ি তা অভিভাবকগণ জানলে সেই মহিলা জামিয়ার চ্যান্সেলর বা ভাইস চ্যান্সলরদের কপালে পাদুকাবৃষ্টির সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
শিক্ষাবাণিজ্যের বিরুদ্ধে কথা শুনি কিন্তু ইলমবাণিজ্য মুখে তালা। আমাদের বোর্ডগুলো আবার যে তালেবে ইলমকে বারো বছর শেষে তাকমীলের সনদ দেয় সেই একই সনদ প্রদান করে আট বছরে। মাদারিসিল আরাবিয়া হয়ে আবার মাস্টার্সের পরীক্ষা ও সনদ বিতরণ করে কওমী মাদরাসা শিক্ষা বোর্ড! মাদরাসাগুলো জামিয়ার সনদ দেয়। আমাদের সৌভাগ্য আমাদের শিক্ষার নানা কিছু তালেবে ইলমের অভিভাবক এবং অন্য কেহ তলিয়ে দেখতে চায় না। যে দিন চোখ খুলে দেখবে পাদুকার বারেশ পড়ার সম্ভাবনা কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
তিন. আগে কওমীর তালেবে ইলম জামিয়া থেকে মাস্টার্স করে আলিয়া মাদরাসায় আবার দশম শ্রেণিতে দাখেল পরীক্ষা দিতো এখন দিতে যাচ্ছে ফাইভ বা এইটের পরীক্ষা। মাস্টার্স পাশ পরীক্ষা দেয় জেডিসি। অনেক তরক্কি। উন্নতি। প্রগতি। অনেক তালেবে ইলম আবার দাড়ি উঠে যাচ্ছে তাই কওমী তরক করে আলিয়ার নৌকায় পা রাখছে দাওরার আগেই। পরিনামের কী দশা তা আর বলতে হয় না। আমাদের চারপাশে এই কওমী প্লাস আলিয়ার জেনারেশন দেখলেই সব হল ও সমাধান হয়ে যাবে। এরা আবার কওমী ভায়া আলিয়া ভায়া কলেজে। কলেজ ভায়া ভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজ।
অধ্যাপিকা পড়ান শাড়ি পরিধান করে ইসলামিক স্টাডিজ। কওমীর তালেবে ইলম তখন ভাবতে থাকে যুগের সাথে তাল মিলাতে হবে। যুগের হাওয়ায় ভেসে ভেসে দাড়িটি ফেলিয়ে দিতে হবে। লোকিয়ে রাখতে হবে টুপিটাও। নতুন ফ্যাশন হিসেবে প্যান এন্ড পাঞ্জাবি মাথায় ক্যাপ। কলেজের প্যান্ট, কওমীর পাঞ্জাবি ক্যাপটি নতুন যুগের। তবে ক্যাপটি উল্টিয়ে আবার।
মহিলা মাদরাসা বা মহিলা জামিয়ার কেউ কেউ আবার যাত্রা শুরু করেছেন সেই দাখেল আলেমের পথে। কওমী শিক্ষাবোর্ডে ছবি জমা দিতে হয় না। মেয়েটি আলেমা হলো কালো বোরকা ও হাতমোজায় আচ্ছাদিত হয়ে। আলেমা তার যথেষ্ট নয়। মাস্টার্স শেষে করে মহিলাটি যখন আলিয়ায় দাখেল দিচ্ছে তখন চেহারা খোলা ছবি, কোচিং এ ডেটিং সুযোগ এবং বোরকা ও হাতমোজা না পড়ার অবাধ স্বাধীনতা। আধুনিকতা হওয়ার বিশাল সুযোগ। বাড়তি তো এন্ডয়েড ফোন আছেই, যা নিষিদ্ধ ছিলো কওমীর আঙ্গিনায়।
এই প্রবনতা দিন দিন বাড়ছে। মহিলাগুলো সাধারণত স্কুল থেকে কওমীতে ভর্তি হয়েছিলো। তাহলে স্কুল ভায়া মহিলা মাদরাসা বা মহিলা জামিয়া ভায়া আলিয়া ভায়া কলেজ। মহিলা মাদরাসার ছাত্রীদের অভিভাবকরা আবার বেশী বিশ্বাস করেন পোষ্যদের। মেয়ে হিসেবে কত দাবি!
চার. আমাদের জামিয়াগুলোতে গবেষণার কোনো সিস্টেম নাই। সিলেবাস নিয়ে কোনো পর্যালোচনা নেই। পাঠ্যতালিকাকে অপরিবর্তণীয় মনে করা হয়। কিতাবকেই মাকসাদ বানানো হয় ফনকে নয়। যোগ্যতা হলো কি না তা বিবেচনা না করে উপরের ক্লাসে তরক্কী দেওয়া হয়। যার যার মতো রচিত হয় সিলেবাস। পৃথিবীতে শিক্ষার নামে এতো অরাজকতা কোনো দেশে আছে কি না আমার জানা নেই।
ইসলাম সৌন্দর্যের নাম। শৃংখলার অনেক গুরুত্ব অসলামে। একতা ও সমতার অনেক তাকিদ। কিন্তু ইসলামী শিক্ষায় এতো অনিয়ম কেন? কেন এতো মত ও পথ। কওমী মাদরাসার শিক্ষাকে কেন হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে? পদ ও পদবীর জন্য এতো হা হুতাশ কেন? নতুন প্রজন্ম এবং আগামী প্রজন্ম কওমীর কর্নধারদের কীভাবে মূল্যায়ণ করবে? নতুন পৃথিবীর এই সন্তানরা কওমীর কী বিষয় নিয়ে গৌরব করবে?
যে অভিভাকরা আমাদের বিশ্বাস করে ছেলেকে মানুষ বানানোর জন্য পাঠালো মেয়েকে দীনদার বানানোর জন্য পাঠালো কতটুকু জিম্মাদারি পালন হলো আমাদের? মানুষ কি বানাতে পারলাম আমরা? শত শত প্রশ্ন কিলবিল করে মাথায়। কিন্তু আমার কাছে সমাধান নেই অনেক প্রশ্নের।
পাঁচ. তবুও আমরা কওমী মাদরাসা। আমাদের ঐতিহ্যের পাঠশালা মাদরাসা। হাজার বছর ধরে জাতিকে পথ দেখাচ্ছে। আমরা ইমাম। মিম্বর ও মেহরাব আমাদের। আর কী আমাদের? কবে হবে আমাদের সংসদ? প্রশাসন? দেশের নানা সেক্টর? হবে হবে, একদিন সব হবে।
প্রস্তাবনা:
এইসব অরাজকতা বন্ধে আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে। কথা বলতে হবে। আত্মসমালোচনা করতে হবে। মতবিনিময় করতে হবে। প্রজন্ম নিয়ে ভাবতে হবে। চিন্তা করতে হবে আগামী নিয়ে। আমাদের পথ রচনা করতে হবে নতুন পথ। একুশ শতকের মহাসড়ক। আলেম কীভাবে হবে, তা নিয়ে শুরু হোক ভাবনা। গবেষণা। দরবারি আলেম নয়। সাহসী আলেম। চিন্তক আলেম। লেখক আলেম। দাঈ আলেম। উম্মাহর দরদি আলেম।
কীভাবে আলেম হবে বিষয়ে একটি মানচিত্র রচনার সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করা হোক। বোর্ডগুলো যদি উদ্যোগ নেয় তাহলেই ফলাফল পাওয়া সহজ। বোর্ডগুলো আলেম হওয়ার মানচিত্র রচনা করবে এই প্রত্যাশা।
লেখক : শিক্ষাবিদ, লেখক, গবেষক, পরিচালক, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট ময়মনসিংহ

