মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা
মহেশখালীর শিক্ষাআলোর পাঁচ দশকের যাত্রা
মুহাম্মদ হেদায়ত উল্লাহ
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৮:১২
আমার শিক্ষাজীবনের সূচনা হয় কক্সবাজারের মহেশখালীর রাজুয়ারঘোনায় অবস্থিত মুঈনুল ইসলাম মাদরাসায়। ছোটবেলার নিষ্পাপ দিনগুলোতে এই মাদরাসাই ছিল আমার শেখার প্রথম পাঠশালা, চরিত্র গঠনের প্রথম ভিত্তি এবং দীনি পরিবেশের প্রথম স্পর্শ। নীরব পাহাড়, সবুজ প্রকৃতি, আজানভেজা বাতাস আর আলিম–উলামাদের সান্নিধ্য সব মিলিয়ে মাদ্রাসার সেই পরিবেশ আমাকে আজও টানে। এখানকার প্রতিটি সকাল আমাকে শিখিয়েছে নিয়ম, প্রতিটি সন্ধ্যা শিখিয়েছে নৈতিকতা, আর প্রতিটি ক্লাস আমাকে বুঝিয়েছে জ্ঞান মানে আত্মাকে পরিশুদ্ধ করা। সেই স্মৃতিবহুল শিক্ষালয়ের ইতিহাসই আজ তুলে ধরছি।
প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের জেলা কক্সবাজারের মহেশখালী উপজেলায়, হোয়ানক ইউনিয়নের রাজুয়ারঘোনায় অবস্থিত মুঈনুল ইসলাম কওমি মাদরাসাটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বছর।
পুকুরঘেরা নীরব গ্রামবাংলার শান্ত পরিবেশে ধর্মপ্রাণ মানুষের ইচ্ছা ও পাঁচজন আলেমের নিষ্ঠায় জন্ম নেয় এই কওমি মাদরাসাটি। উদ্দেশ্য ছিল স্পষ্ট- আল-কুরআন ও সুন্নাহভিত্তিক একটি আদর্শিক প্রজন্ম তৈরি করা, যারা নৈতিকতা, মানবিকতা ও দীনদারির মাধ্যমে সমাজকে আলোকিত করবে।
প্রতিষ্ঠাতা আলেম ও সূচনালগ্নের পথচলা
মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন এই অঞ্চলের খ্যাতনামা ও প্রাজ্ঞ আলেমগণ। তারা হলেন- মাওলানা ইজহারুল হক (রহ.), মাওলানা আব্দুল মালেক (রহ.), মাওলানা আব্দুল জলিল (রহ.), মাওলানা নুরুল হক (রহ.), মাওলানা মো. হোসাইন (দা.বা.)।
তাদের সৎ উদ্দেশ্য, ত্যাগ ও দূরদর্শিতায় উপকূলীয় অঞ্চলে একটি শক্ত ভিত্তির দীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দাঁড়িয়ে যায়, যা আজ অর্ধশতাব্দী পরও দীনের আলো ছড়াচ্ছে একই দৃঢ়তায়।
মাদ্রাসার মুহতামিমগণ
প্রতিষ্ঠার পর মাদরাসাটি পরিচালিত হয়েছে বেশ কয়েকজন বরেণ্য মুহতামিমের নেতৃত্বে। তারা প্রত্যেকে তাদের সময় অনুযায়ী শিক্ষা, শৃঙ্খলা ও প্রশাসনিক উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছেন।
১. মাও. নুরুল হক (রহ.)
২. মাও. মোস্তাক আহমদ (রহ.)
৩. মাও. আলী আহমদ (রহ.)
৪. মাও. ফররুখ আহমদ (খণ্ডকালীন)
৫. মাও. আব্দুর রহমান (খণ্ডকালীন)
৬. মাও. আব্দুল জলিল (রহ.)
৭. মাও. মুফতি আমিন (রহ.)
৮. মাও. আব্দুল মালেক (রহ.)
৯. মাও. আবু তাহের (রহ.)
১০. মাও. আজিজুল্লাহ (দা.বা.)
১১. মাও. মমতাজুল ইসলাম (দা.বা.)
১২. হাফেজ আমিনুল ইসলাম (দা.বা.)
বর্তমানে দায়িত্ব পালন করছেন- মাওলানা মো. হোসাইন (দা.বা.)। তার নেতৃত্বে মাদ্রাসা আজ আরও সংগঠিত, পরিবর্ধিত ও আধুনিক শিক্ষার উপযোগী হয়ে উঠেছে।
শিক্ষা বিভাগের বিস্তৃতি
প্রতিষ্ঠার পর মুঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। বর্তমানে এখানে রয়েছে।
১. নুরানি বিভাগ: নুরানি ১ম থেকে ৩য় বর্ষ পর্যন্ত। এখানে কুরআনের শুদ্ধ পঠন, বাংলা, গণিত, ইংরেজি, নৈতিকতা ও ইসলামি শিষ্টাচার শেখানো হয়।
২. নাজেরা ও হেফজ বিভাগ: নাজেরা বিভাগে শিক্ষার্থীরা শুদ্ধ তিলাওয়াত ও কুরআন পাঠ শিখে। হেফজ বিভাগে তারা মুখস্থ করে সম্পূর্ণ ৩০ পারা, হয়ে ওঠে হাফেজে কুরআন। গত কয়েক দশকে এখান থেকে অসংখ্য দক্ষ হাফেজ দেশ-বিদেশে কৃতিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
৩. বালক শাখা: কিতাব বিভাগ পূর্বে জামাতে পঞ্জুম পর্যন্ত ছিল। বর্তমানে হয়ে জামাতে শশুম পর্যন্ত চালু রয়েছে।
৪. বালিকা শাখা: মেয়েদের ইসলামী শিক্ষার প্রয়োজন বিবেচনায় পৃথক বালিকা বিভাগ চালু রয়েছে, যেখানে জামাতে ছাহারুম পর্যন্ত পাঠদান করা হয়। এটি এলাকার মেয়েদের জন্য দীনি শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সমাজে অবদান
মুঈনুল ইসলাম মাদরাসা শুধু একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নয়; এটি রাজুয়ারঘোনা ও আশপাশের জনগোষ্ঠীর আস্থা, চরিত্র গঠন ও নৈতিকতার কেন্দ্র। এখান থেকে বহু আলেম, হাফেজ, ক্বারি ও দীনি কর্মী তৈরি হয়ে মহেশখালী, কক্সবাজার, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষার্থীদের সুনাম, আলেমদের নৈতিক দীক্ষা এবং প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা মাদ্রাসাটিকে একটি মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছে।
অর্ধশতাব্দীর সাফল্যের দীপশিখা
দীর্ঘ পাঁচ দশকের যাত্রায় মাদরাসাটি দীনি শিক্ষার মান ধরে রেখেছে। নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখেছে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করেছে। স্বাধীনতার বছর জন্ম নেওয়া এই প্রতিষ্ঠান আজও সেই আদর্শ ধরে রেখে নিরন্তর এগিয়ে চলেছে। যে প্রতিষ্ঠান থেকে আমার শিক্ষাজীবনের সূচনা, সে প্রতিষ্ঠান আজ অর্ধশতাব্দী ধরে দীনের আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
এর উন্নয়ন, অগ্রগতি ও নেতৃত্ব আগামী প্রজন্মকে আরও আলোকিত করবেূ এই প্রত্যাশাই সকলের।
লেখক : প্রভাষক ইসলামিক স্টাডিজ, দশমিনা ইসলামিয়া কামিল এমএ মাদরাসা, পটুয়াখালী, বরিশাল

