রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে ভারতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের কী অবস্থা?
দিল্লি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:২৪
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের একাংশ। ছবি : বাংলাদেশি স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌজন্যে
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে উত্তেজনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা, হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ-সব মিলিয়ে এক অস্বস্তিকর আবহ তৈরি হয়েছে। তবে এই উত্তেজনার মাঝেও ভারতে অধ্যয়নরত বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা আপাতত নিজেদের নিরাপদ বলেই মনে করছেন।
শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যু পরবর্তী পরিস্থিতে ময়মনসিংহের ভালুকায় দীপক চন্দ্র দাস হত্যাকাণ্ডের পর ভারতজুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঢেউ ওঠে। দিল্লিতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের সামনে বিক্ষোভ হয়, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ জানায়। বাংলাদেশের কট্টর মুশলিম নেতাদের কুশপুত্তলিকা দাহও করা হয় জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই সব খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় ঘুরতে থাকায় আতঙ্ক বাড়ে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও।
তবে দিল্লি, নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা, বেঙ্গালুরু ও কলকাতার একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে-বাস্তব অভিজ্ঞতা এখনও ততটা ভীতিকর নয়। ক্লাস, পরীক্ষা, ল্যাব কিংবা হোস্টেল— সবকিছু মোটামুটি স্বাভাবিকই চলছে। কিন্তু মানসিক চাপ স্পষ্ট।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আনিসা খাতুন পড়তে এসেছিলেন আইসিসিআর স্কলার হিসেবে। পাচ্ছেন নিয়মিত বৃত্তি। তিনি বলেন, ‘খবর দেখলে মনে হয় কিছু একটা ঘটে যাবে। কিন্তু ক্যাম্পাসে গেলে দেখি সব আগের মতোই। দেড় বছরে বাংলাদেশ ভারতের সম্পর্কের নানা উত্তেজনা থাকলেও কখনও ঘৃণা সূচক কোনো কিছু দেখিনি। তবুও ভেতরে একটা অজানা ভয় কাজ করে।’
এই ভয়ের সঙ্গে যুক্ত আছে নানা অনিশ্চয়তা। বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং প্রশাসনিক জটিলতার কারণে অনেক শিক্ষার্থী ভিসা পেতে দেরির আশঙ্কায় মূল একাডেমিক সেশন শুরুর অনেক আগেই ভারতে চলে এসেছেন এবার। কেউ কেউ ইংরেজি বা চীনা ভাষার স্বল্পমেয়াদি কোর্সে ভর্তি হয়েছেন আগামী জুনের সেশনে ভর্তি হবার জন্যেই।
ঢাকায় থাকা অবস্থায় একাধিকবার ভিসা প্রক্রিয়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগা সোমা রায় বলেন, ‘ভিসা হাতে পাওয়ার পর আর অপেক্ষা করতে চাইনি। দেশে থাকলে মনে হচ্ছিল আবার কোনো ঝামেলা হবে। এখানে এসে অন্তত পড়াশোনার সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছি। আগামী বছর জুলাই থেকে রেগুলার প্রোগ্রামে ভর্তি হয়ে যাব।’
ময়মনসিংহ থেকে আসা পূর্ণিমা চৌধুরীও একই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তার কোর্স শুরু হতে এখনও সময় থাকলেও তিনি আগেভাগে চলে এসেছেন। ‘দেশের পরিস্থিতি খুব অনিশ্চিত। ঝুঁকি নিতে চাইনি,’ বলেন তিনি।
ভারতীয় শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া তুলনামূলকভাবে সংযত। অধিকাংশই এটিকে দুই দেশের রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখছেন, ব্যক্তিগত পর্যায়ে নয়। ক্লাসরুমে বা হোস্টেলে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সম্পর্ক আগের মতোই রয়েছে বলে জানান অনেকে। তবে কিছু ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ, পোস্টার ও স্লোগান চোখে পড়ায় মানসিক অস্বস্তি তৈরি হয়েছে।
দিল্লিতে অধ্যয়নরত সোহেল আসলাম (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক, ছদ্মনাম) বলেন, ‘কেউ সরাসরি কিছু বলেনি। কিন্তু ক্যাম্পাসের বাইরে কী হচ্ছে, সেটার প্রভাব মাথা থেকে যায় না। তবুও মনে হয়, এখানে থাকা দেশে থাকার চেয়ে নিরাপদ ‘
পশ্চিমবঙ্গের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী। সেখানকার শিক্ষার্থী ফারজানাও বললেন, ‘দেশে উত্তেজনার আচ নিয়ে সবাই সচেতন। আলোচনাও হয়। কিছু ক্ষেত্রে কটু কথাও শুনতে হয়। তবে সেটা শঙ্কা করার মতো কিছু না। আমার ভারতীয় বন্ধুরা বেশ ফ্রেন্ডলি।’
উত্তরপ্রদেশের আলিগড় মুশলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের মোহাম্মদ শরীফ বলেন, ‘এখানে সাধারণত বাংলাদেশি মুসলিমরা পড়তে আসে। এখানে হিন্দু মুসলিম ইস্যু নিয়ে তেমন কোনো উৎকণ্ঠা কখনও চোখে পড়েনি। দিল্লিতে পশ্চিমবঙ্গে কিছু হয়তো হতে পারে। তবে আলীগড়ে তেমন কিছু হবার সম্ভাবনা নেই।’
জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি অদিতি মিশরা বলেন, এখানে বাংলাদেশি স্টুডেন্ট খুব বেশি নেই। তবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট সজাগ। এখানে আমরা সবাইকেই একই চোখে দেখি। ভিন্ন ভাবে দেখার কিছু নেই। কিছু গোষ্ঠী হয়তো উত্তেজনা সৃষ্টি করে, তবে সেটা এতটাও শঙ্কার কিছু নেই।
দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই মুহুর্তে প্রায় আড়াইশো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন বলে জানিয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেন স্টুডেন্ট রেজিস্ট্রি বিভাগ। বিভাগের ডিন প্রফেসর ড রুপম কাপুর বলছিলেন, ‘দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ বা শঙ্কার কথা কোনো বাংলাদেশি শিক্ষার্থী জানায়নি। বাংলাদেশ-ভারতের কুটনৈতিক উত্তেজনা নিয়ে আমরা সজাগ আছি। এর প্রভাব শিক্ষাঙ্গনে পড়েনি। সব শিক্ষার্থীই আমাদের কাছে সমান।’
অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশনের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে। ২০২১-২২ সালের এআইএসএইচই (অল ইন্ডিয়া সার্ভে অন হায়ার এডুকেশন) প্রতিবেদন অনুসারে, ভারতে শিক্ষার্থী প্রেরণকারী দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ চতুর্থ স্থানে রয়েছে। তথ্য থেকে জানা যায়, সেই বছর ২,০৮৩ জন বাংলাদেশি শিক্ষার্থী স্নাতক কোর্সে, ২১৪ জন স্নাতকোত্তর প্রোগ্রামে এবং ৪০ জন পিএইচডি গবেষণায় ভর্তি হয়েছিলেন। সব মিলিয়ে, ভারতে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থী জনসংখ্যার ৫.৬ শতাংশই বাংলাদেশের, যা নেপাল (২৮%), আফগানিস্তান (৬.৭%) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (৬.২%) পরেই চতুর্থ স্থানে রয়েছে। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক উত্তেজনার পর নতুন তথ্য প্রকাশিত না হলেও ভারতে বাংলাদেশ থেকে শিক্ষার্থী আসা কমেনি বলেই জানিয়েছেন এখানকার বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা।
সিয়াম/এমএইচএস

