জাতীয় মিম্বার থেকে
সাংবাদিক-লেখকদের দায়িত্ব হলো সত্য তুলে ধরা
মুফতি মুহাম্মদ আব্দুল মালেক
প্রকাশ: ১৩ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৩
আলহামদুলিলিল্লাহ! আল্লাহ আমাদের আরেকটি জুমার দিন দান করেছেন; এটাই তাঁর অনুগ্রহ। মানুষের জীবনে বারবার সুযোগ আসে পরিবর্তনের, তাওবা করার এবং সঠিক পথে ফিরে আসার। আজকের জুমায় সুরা আলে ইমরান হতে যে আয়াতগুলো তিলাওয়াত করা হয়েছে, সেগুলোর ওপর আমল করলে আমাদের ইমান ও আনুগত্য বাড়বে ইনশাল্লাহ।
আল্লাহপাক ইরশাদ করেন, “বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহ তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহ ক্ষমা করবেন” (আলে ইমরান ৩:৩১)।
এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা করছেন, আল্লাহকে ভালোবাসা শুধুই মুখের কথা নয়। ভালোবাসার প্রমাণ হলো নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সুন্নাহ অনুসরণ। অনেক সময় মানুষ দাবি করে, ‘আমি আল্লাহকে ভালোবাসি’ কিন্তু তার আমল, আচরণ, চলাফেরা, পোশাক, জীবনযাপন নবীর সুন্নাহর বিপরীত। আল্লাহ এখানে স্পষ্ট জানিয়ে দিচ্ছেন, যদি সত্যিই ভালোবাসো, তবে নবীর অনুসরণ করো। কারণ নবীর পথই আল্লাহর পথ।
পরের আয়াতে আল্লাহ বলেন, “বলুন, আল্লাহ ও রসুলের আনুগত্য করো। আর যদি তারা বিমুখ হয়, তবে জেনে রাখো আল্লাহ কাফিরদের ভালোবাসেন না।” (৩:৩২)।
এই আয়াত খুব কড়া সতর্কতা। অর্থাৎ যে ব্যক্তি নবীর সুন্নাহ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়; সেটা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। আজ আমাদের সমাজে অনেকেই আল্লাহকে ভালোবাসার দাবি করে, কিন্তু সুন্নাহর অনুসরণকে কঠিন মনে করে। এটা ভুল ধারণা।
এরপর আল্লাহ সেই বংশধারার কথা উল্লেখ করেন যাকে তিনি বেছে নিয়েছেন; আদম, নূহ, ইবরাহিম পরিবার ও ইমরানের পরিবার (৩:৩-৩:৩৪) আদর্শ বান্দারা কখনো আল্লাহর অবাধ্য হননি। কারণ তারা জানতেন সন্তান-সন্ততি, সমাজ, জাতি সবকিছু সঠিক পথে রাখতে হলে আল্লাহর আনুগত্য ছাড়া বিকল্প নেই।
অতপর উল্লেখ আছে ইমরানের স্ত্রীর ঘটনা। তিনি বলেছিলেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমার গর্ভের সন্তানকে আমি আপনার জন্য উৎসর্গ করলাম; আপনি তাকে গ্রহণ করুন’ (৩:৩৫)।
একজন মা তার সন্তান জন্মাবার আগে থেকেই আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করছেন; এটা দেখলে বোঝা যায়, ইসলামে একজন নারীর অবস্থান কী? আজকের অনেক নারীবাদী দাবি করে ইসলাম নাকি নারীকে সম্মান দেয় না; অথচ তারা কোরআন কখনো খুলে দেখেনি।
ইমরানের স্ত্রী যখন সন্তান প্রসব করলেন এবং দেখলেন সে মেয়ে, তখন বললেন, ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি তো কন্যাসন্তান জন্ম দিয়েছি।’ কিন্তু আল্লাহ বলেন, ‘আল্লাহ ভালো জানেন সে কি জন্ম দিয়েছে। ছেলে মেয়ের মতো নয়।
আমি তার নাম রাখলাম মারইয়াম এবং তাকে ও তার বংশধরকে আপনার আশ্রয়ে দিলাম’ (৩:৩৬)।
এ আয়াত প্রমাণ করে, মেয়ে সন্তান ঘৃণা করার ধারণা আরবদের ছিল, কিন্তু কোরআন সেই ভুল ধারণা সংশোধন করেছে। মারইয়াম ছিলেন আল্লাহর প্রিয় বান্দী। আল্লাহ তাঁকে বেছে নিয়েছেন, সম্মান দিয়েছেন, তাঁর জন্য মুজিযা দিয়েছেন।
আল্লাহ মারইয়ামকে সুন্দরভাবে কবুল করলেন। হযরত জাকারিয়া (আ.) তার দায়িত্ব নিলেন। যখনই তিনি মারইয়ামের কাছে যেতেন, তাঁর নিকট অপ্রত্যাশিত রিজিক পেতেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি বলতেন, “এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে। আল্লাহ যাকে ইচ্ছা হিসাব ছাড়া রিজিক প্রদান করেন” (৩:৩৭)।
এখানে শেখার বিষয় হলো যে, রিজিক আল্লাহর হাতে। সমাজ যাই বলুক, মানুষ যা-ই পরিকল্পনা করুক, আল্লাহ যার জন্য লিখে দেন তাকেই রিজিক দেন। এখন আসা যাক, সমাজের ভুল ধারণায়। আজ বলা হয়, আরবরা নাকি মেয়ে সন্তান জন্ম দিলেই লজ্জা পেত। কিন্তু কোরআনের এই আয়াতগুলো সেই ধারণাকে বাতিল করে। আরবরা ভুল করত, ইসলাম সেই ভুল সংশোধন করেছে। ঠিক যেমন আমাদের সমাজেও অনেক ভুল ধারণা আছে।
আজ সমাজে ‘বেগম রোকেয়া দিবস’ পালন করা হয়। তার নাম বলা হয়, উদ্ধৃতি দেওয়া হয়; কিন্তু তিনি ইসলামের কোন বিধান মানতেন, নামাজ পড়তেন কিনা, পর্দা পালন করতেন কিনা; এসব কিছুই বলা হয় না। কেবল তাঁকে নারী উন্নয়নের প্রতীক বানানো হয়। অথচ দিবস নামের এই সংস্কৃতি ইসলামী আদর্শ নয়। ইসলাম বলে, ব্যক্তির আদর্শ অনুসরণ করো, দিবস পালন করো না।
আজকের সমাজে নারীর অধিকার নিয়ে প্রচণ্ড ভুল ধারণা ছড়ানো হয়েছে। ইসলামে ‘মহিলা’ শব্দটি সম্মানের, কিন্তু আজ বলা হয়, ‘নারী বলো, মহিলা নয়’ এটা ভাষার বিকৃতি। এমনকি কেউ কেউ বলে, যে নিজেকে নারী মনে করে সে নারী। অথচ কোরআন মানুষকে তাঁর প্রকৃত লিঙ্গ অনুযায়ী পরিচিত করেছে। আজ পশ্চিমা প্রভাব আমাদের সমাজে ঢুকে পড়েছে। ছেলে মানুষ হয়ে নিজেকে মেয়ে বলে দাবি করা, কিংবা উল্টোটা; এসব সম্পূর্ণ শয়তানের ফন্দি।
ইসলাম নারীদের এমন সম্মান দিয়েছে, ইতিহাসে রুকাইয়া নামে অনেক আলেমা, মুহাদ্দিসা, ইসলামের বীর নারীর নাম পাওয়া যায়। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিজের কন্যার নাম ছিল রুকাইয়া। আজকের সমাজ এই নামকেই বিকৃত করে অন্য অর্থ দাঁড় করাচ্ছে।
সাংবাদিক ও লেখকদের দায়িত্ব হলো ইতিহাস ঠিকভাবে তুলে ধরা। কিন্তু তারা সত্য এড়িয়ে ভুলকে প্রতিষ্ঠিত করছে। ভুল কথা বারবার বলা হলে তা সমাজে সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়; এটাই আজকের সবচেয়ে বড় বিপদ।
কিন্তু এখন যদি অভিধানকে পরিবর্তন করা শুরু করেন আপনারা, তাহলে তো ভালো কাজ হবে না। এখন অভিধানের ওপর হাত দেওয়া হচ্ছে, পরবর্তীতে মানুষ বলবে নারী অর্থ কি? যে নারী হলো মহিলা, আর নারী হলো যে পরিবর্তন হয়ে নিজে নিজে মহিলা সেজেছে, তার নাম। এই যে এখন নতুন নতুন একটা অমূলক ইতিহাস, অবাস্তব ইতিহাস এবং অবাস্তব অভিধান তৈরি করা হচ্ছে। সাংবাদিকরা এটা রেকর্ড করেন। সাংবাদিকরা পারে খালি উল্টা ছবি তুলবে। খালি ছবি তুলবে, ভিডিও করবে। বরং আপনারা এখন থেকে অডিও শুরু করেন। আগের সাংবাদিকদের মতো কলম-কাগজ হাতে নেন। ঢেউয়ের সঙ্গে চলবেন না। মিথ্যা স্রোতের সঙ্গে চলবেন না। বরং পেছনের ভালো যেটা চলে যাচ্ছে, গায়েব হয়ে যাচ্ছে, ওটা রেকর্ড করেন যে- এতদিন পর্যন্ত এটা ভালো ছিল, এখন এসে এই নতুন খারাপ এখানে ঢুকছে। এই ইতিহাস সংরক্ষণ করেন। এটা সাংবাদিকদের দায়িত্ব। এটা সমস্ত লেখকদের দায়িত্ব, সাহিত্যিকদের দায়িত্ব। সাহিত্যিক সাংবাদিকদের কাজ এটা না যে, অন্যায় কোনো কিছু নতুন যুক্ত হলো, ওইটাকে মানুষের মধ্যে কিভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে সে তালে থাকবে। আর পিছনের ভালো যেটা চলে যাচ্ছে, গায়েব হয়ে যাচ্ছে, ওটার ব্যাপারে কোনো কথা নাই, আওয়াজ নাই। এটার নাম সাংবাদিকতা নয়! এটা মনে রাখতে হবে আমাদেরকে।
ভাষার বিকৃতি যেমন সমাজকে নষ্ট করে, তেমনি দৃষ্টিভঙ্গির বিকৃতি সমাজকে পথভ্রষ্ট করে। ইসলামে নারী-পুরুষ উভয়ের দায়িত্ব আছে। উভয়েই আল্লাহর নিকট দায়বদ্ধ। কিন্তু আজ প্রগতির নামে সংস্কৃতি ধ্বংস করা হচ্ছে। পশ্চিমা সভ্যতার অনুসরণে নিজের পরিচয় হারিয়ে সমাজ দিগ্ভ্রান্ত হচ্ছে।
অতএব প্রয়োজন হলো হককে জানা, হকের ওপর দাঁড়ানো, সত্যকে বলা এবং সমাজকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা। আমরা যেন নিজের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, কোরআনের নির্দেশনা; এসব ভুলে না যাই।
সবশেষে আমরা আল্লাহর কাছে দোয়া করি, আল্লাহ আমাদের হক বোঝার তাওফিক দিন। হকের জন্য কাজ করার শক্তি দিন। সমাজের ভুল সংশোধন করার বুদ্ধি দিন এবং আমাদের ইমান, জীবন, পরিবার ও সন্তানদের রক্ষা করুন। আমিন।
অনুলিখন : মাওলানা কাজী ইনজামামুল হক, সহ সম্পাদক, দৈনিক বাংলাদেশের খবর


