প্লট দুর্নীতির মামলা
শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের দণ্ড, রায়ে যা বলেছেন আদালত
ডিজিটাল ডেস্ক
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:০৯
ক্ষমতার অপব্যবহার করে পূর্বাচলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্লট বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগে করা তিন মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ২১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।
তার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল এবং সজীব ওয়াজেদ জয়কে পাঁচ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একইসঙ্গে এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডও দেওয়া হয়েছে।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, কোনো আবেদন পত্র ছাড়াই এখতিয়ার বহির্ভূতভাবে শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের নামে প্লট বরাদ্দ করা হয়েছিল।
এ রায় সম্পর্কে সজীব ওয়াজেদ জয় বলেন, ‘একটা মিথ্যা মামলা আমাদের বিরুদ্ধে সাজানো হয়েছে, যাতে আমরা নির্বাচন না করতে পারি। এই রায়গুলোর মূল উদ্দেশ্যই হলো যাতে আমার মা, আমার পরিবারের কেউ নির্বাচন করতে না।’
বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন এ রায় ঘোষণা করেছেন।
এ রায়কে ঘিরে বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত এলাকায় কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
সকাল থেকেই আদালত প্রাঙ্গণে পুলিশ, বিজিবিসহ ব্যাপকসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন ছিল।
মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডের পর এবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলায় দ্বিতীয় রায় হলো।
তবে শেখ হাসিনা, তার ছেলে ও মেয়ে সকলে পলাতক থাকায় তাদের অনুপস্থিতিতেই এই মামলার বিচার হয়েছে।
এ মামলার ২৩ জন আসামির মধ্যে কেবলমাত্র রাজউকের একজন কর্মকর্তা খুরশিদ আলম কারাগারে রয়েছেন।
মামলাটির সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে আত্মসমর্পণ করেন তিনি। আসামি খুরশিদ আলমের এক বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।
২৩ জনের মধ্যে এই একজন আসামিই শুধু কারাগারে রয়েছে।
রায়ের দিন বৃহস্পতিবার (২৭ নভেম্বর) সকালে তাকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়।
রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে আদালত
এ মামলার আরেক আসামি গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকারকে খালাস করে রায় দিয়েছেন আদালত।
মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছে, সরকারি সম্পত্তি নিজের নামে নিয়ে রাষ্ট্রের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন শেখ হাসিনা।
একইসাথে প্লট নেওয়ার জন্য যে হলফনামা দেওয়া হয়েছিল তাতে নোটারি করা ছিল না বিধায় সেই হলফনামা জাল নথি ছিল বলে রায়ে উল্লেখ করেছে আদালত।
একইসাথে প্লট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজউকের বিধিমালা বা কোনো নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি বলেও রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছে আদালত।
রায় সম্পর্কে সজীব ওয়াজেদ জয় যা বলছেন
রায় ঘোষণার আগে সজীব ওয়াজেদ জয় দাবি করেছেন, ‘একটা মিথ্যা মামলা আমাদের বিরুদ্ধে সাজানো হয়েছে, যাতে আমরা নির্বাচন না করতে পারি।’
অনিয়ম করে রাজউকের প্লটগুলো বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে। সে অভিযোগের জবাবে তিনি দাবি করেছেন তারা আইন অমান্য করেননি।
তিনি বলেন, ‘আমার নিজস্ব কোনো জমি নাই। আমার যে জমি আছে সেটা আমার বাবার ছিল। আমি কোনোদিন ঢাকা শহরে বাংলাদেশে কোনো জমি কিনিনি। আমার যে খালাতো ভাই-বোনেরা তাদের কিন্তু নিজস্ব কোনো জমি নেই। তারা যে পৈতৃক সম্পত্তি পেয়েছে সেটাই আছে।’
‘তো স্পষ্ট এখানে যারা একটা জমি কেনে নাই তারা কিন্তু একটা কিনতে পারে। আমাদের পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে আমাদের পৈতৃক সম্পত্তি ছাড়া বাংলাদেশে আমাদের কোনো জমি নেই। এই একটা মাত্র জমি আমরা প্রথমবারের মতো নিজেদের অর্থায়নে কিনলাম।’
‘এখানে কিন্তু আইন একদম স্পষ্ট। যে যাদের কোনো জমি নাই তারা কিনতে পারে। এখন আপনারা দেখেন আমার অন্য কোনো জমি আছে কিনা বাংলাদেশে। আমার খালাতো ভাই বলেন বোনের অন্যকোনো বাড়ি আছে কিনা। আমাদের কোনো জমি নাই।’
দুর্নীতির যে অভিযোগে বিচার হয়েছে
শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তাদের পরিবারের বিরুদ্ধে এ বছরের জানুয়ারিতে মোট ছয়টি মামলা করে দুদক।
প্লট দুর্নীতির ছয় মামলাতেই সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আসামি করা হয়েছে। প্রতিটি মামলারই বিবরণই প্রায় একরকম।
গণ অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর, গত ডিসেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পে ১০ কাঠা করে ছয়টি প্লট বরাদ্দে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। মোট ৬০ কাঠার প্লট।
এরপর এ বছরের ১২ জানুয়ারি প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রে ক্ষমতার অপব্যবহার ও অনিয়মের অভিযোগে পুতুলের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করে দুদক।
পরদিন শেখ রেহানা ও তার ছেলেমেয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে সংস্থাটি। পরে ১৪ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ও সজীব ওয়াজেদ জয়ের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক।
পরে পৃথকভাবে শেখ হাসিনাসহ তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে করা তিন মামলার একসাথে সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিচার হয়েছে।
এসব মামলায় পূর্বাচলে রাজউকের নতুন শহর প্রকল্পে মোট ৩০ কাঠা প্লট বরাদ্দে ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়েছে।
তদন্ত শেষে গত ১০ মার্চ এসব মামলায় শেখ হাসিনা, জয় ও পুতুলসহ ২৩ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগ পত্র দেয় সংস্থাটি।
আর গত ৩১ জুলাই শেখ হাসিনাসহ সব আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেয় ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত।
এ তিনটি মামলাতেই ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসামি।
তার বিরুদ্ধে করা মামলায় মোট আসামি বারোজন। মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মোহাম্মদ সালাহউদ্দিন।
শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের বিরুদ্ধে করা মামলার আসামি ১৮ জন।
এ মামলার বাদী দুদকের সহকারি পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়া সাক্ষ্য দিয়েছেন।
এছাড়া প্লট দুর্নীতির অভিযোগে সজীব ওয়াজেদ জয়সহ ১৭ আসামির বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছেন দুদকের সহকারি পরিচালক ও বাদী এস এম রাশেদুল হাসান।
গত ১১ আগস্ট মামলায় বাদীদের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়।
ওইদিন শুনানির পরে দুদকের আইনজীবী খান মো. মইনুল হাসান পরে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘বাদী হিসেবে তারা যে প্রাথমিক অনুসন্ধান করেছেন সেখানে তিনজন বাদীই বলেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী তার ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন। তিনি দ্য ঢাকা টাউন আইনের বিধি লঙ্ঘন করে মিথ্যা হলফনামা প্রদান করে প্লটগুলো নিজের কাছে এবং ছেলে ও মেয়ের কাছে হস্তান্তরের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।’
ঢাকায় তাদের নামে একাধিক বাড়ি, প্লট রয়েছে এবং সুধা সদন তাদের নামে নামজারি করা রয়েছে বলে জানিয়েছিলেন দুদক আইনজীবী।
রাজউকের বিধি অনুযায়ী, ঢাকা বা আশেপাশে নারায়নগঞ্জেও যদি নিজেদের নামে, নির্ভরশীল বা পোষ্য কারো নামে কোনো প্লট, ফ্ল্যাট থাকে তবে তারা প্লট পাবে না বলে উল্লেখ করেছিলেন দুদকের আইনজীবী।
বিচার চলাকালে চার মাসে এসব মামলায় ৯১ জন সাক্ষ্য দিয়েছে।
তবে সাক্ষ্যগ্রহণের শেষ পর্যায়ে এসে গত ২৯ অক্টোবর আদালতে আত্মসমর্পণ করেন রাজউক কর্মকর্তা খুরশিদ আলম।
এরপর তিন মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া সব সাক্ষীকে রিকল করে জেরা করেন তার আইনজীবী।
গত ২৩ নভেম্বর আত্মপক্ষ সমর্থন করে খুরশীদ আলম নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন।
কিন্তু পলাতক থাকায় আইনানুযায়ী আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পাননি শেখ হাসিনা, জয়, পুতুল ও পলাতক বাকি আসামিরা।
পরে ওইদিনই দুদক ও আসামিপক্ষের আইনজীবীদের যুক্তিতর্ক শেষে ২৭ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার রায় দেওয়া হবে বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন ঢাকার পঞ্চম বিশেষ জজ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মামুন।
এসব মামলায় শেখ হাসিনার পরিবারের সদস্য ছাড়াও এসব মামলায় যাদের আসামি করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফ আহমেদ, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক একান্ত সচিব সালাউদ্দিন, জাতীয় গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব শহীদ উল্লা খন্দকার, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) কাজী ওয়াছি উদ্দিন, প্রশাসনিক কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম সরকার, সিনিয়র সহকারী সচিব পূরবী গোলদার, রাজউকের সাবেক চেয়ারম্যান আনিছুর রহমান মিঞা।
এছাড়া রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকেও এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে।
আসামিদের অনেকেই একাধিক মামলার আসামি।
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, শেখ হাসিনা নিজে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারের সর্বোচ্চ পদাধিকারী পাবলিক সার্ভেন্ট হিসেবে দায়িত্বরত ও বহাল থাকা অবস্থায় নিজ ক্ষমতার অপব্যবহার করেছেন।
তিনি পরস্পর যোগসাজশে নিজেরা লাভবান হওয়া ও অন্যকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে পূর্বাচল আবাসন প্রকল্পের অতি মূল্যবান কূটনৈতিক এলাকায় ২৭ নং সেক্টরের ২০৩ নম্বর রাস্তার নয় নম্বর প্লট নিজ নামে দখল ও রেজিস্ট্রি করেছেন।
শেখ হাসিনা নিজের পুত্র-কন্যার নামে, নিজ বোন ও বোনের পুত্র-কন্যার নামে পৃথক প্লট বরাদ্দ করিয়ে ও তাদের পৃথক নামে রেজিস্ট্রিমূলে বাস্তব দখলসহ গ্রহণ করিয়ে প্রতারণামূলক অবৈধ পারিতোষিক গ্রহণ, প্রদান ও অপরাধজনিত বিশ্বাসভঙ্গ এবং বেআইনি অনুগ্রহ প্রদর্শন করে আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে দণ্ডযোগ্য অপরাধ করেছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে।
২০০৮ সালে রাজউক এ প্রকল্পে প্লট বরাদ্দের জন্য বিজ্ঞাপন দেয়। পরে ২০০৯ সালের ১২ এপ্রিল সংশোধনী বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়।
এছাড়া বাকি তিনটি মামলায় শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা তার মেয়ে টিউলিপ রিজওয়ানা সিদ্দিক, ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ও আরেক মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তীর বিরুদ্ধে বিচার কাজ শেষ হয়েছে। আগামী পহেলা ডিসেম্বর এই মামলার রায় দেওয়া হবে। তথ্যসূত্র-বিবিসি বাংলা
এমবি

