বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় বহির্বিশ্বের প্রভাব
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:৩৪
বাংলাদেশের বর্তমান আইনব্যবস্থা একক কোনো উৎস থেকে গঠিত নয়; বরং উপনিবেশিক ঐতিহ্য, আঞ্চলিক ইতিহাস, ধর্মীয় নীতি এবং আধুনিক আন্তর্জাতিক আইন- সব মিলিয়ে একটি মিশ্র কাঠামো তৈরি হয়েছে। ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা, বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনিক বিধান অনেক দেশের সাথে বিভিন্নভাবে সাদৃশ্য রাখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব মিল শুধু ঐতিহাসিক কারণেই নয়, বরং বর্তমান বৈশ্বিক আইনপ্রণয়ন ধারার দিক থেকেও তা যৌক্তিক।
ব্রিটিশ কমন ল’ই বাংলাদেশের আইনের প্রধান ভিত্তি : বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রভাব এসেছে যুক্তরাজ্য থেকে। ব্রিটিশ শাসনামলে উপমহাদেশে প্রবর্তিত কমন ল’ ব্যবস্থা এখনো দেশের বিচারব্যবস্থার মূল ভিত্তি হিসেবে টিকে আছে। আদালতে নজির অনুসরণ থেকে শুরু করে ফৌজদারি, দেওয়ানি, চুক্তি, সাক্ষ্য ও কোম্পানি আইন- সবক্ষেত্রে ব্রিটিশ আইনের ছাপ গভীর।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, ভারতীয় দণ্ডবিধি (Penal Code- 1860), সাক্ষ্য আইন (Evidence Act- 1872, চুক্তি আইন (Contract Act- 1872), দেওয়ানি কার্যবিধি ), ফৌজদারি কার্যবিধি- এসবই ব্রিটিশ আমলে প্রণীত এবং বাংলাদেশের বর্তমান আইনব্যবস্থার ভিত্তি। বিচারাধীন মামলাতেও আদালত যুক্তরাজ্যের উচ্চ আদালতের রায় ও নীতিমালা নজির হিসেবে বিবেচনা করে থাকে।
ভারত ও পাকিস্তানের সাথে ঘনিষ্ঠ মিল :
বাংলাদেশের আইনের সঙ্গে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিল ভারতের। উপমহাদেশে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইন একই কাঠামোয় গড়ে ওঠায় দু’দেশের অনেক আইনই অভিন্ন বা প্রায় একই ধরনের। আদালতের স্তরবিন্যাস, হাইকোর্টের রিট ক্ষমতা, মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত সংবিধানিক নীতি-সবই একে অপরের কাছাকাছি।
তাছাড়া ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থাকার কারণে প্রশাসনিক কাঠামো, ইসলামিক ব্যক্তিগত আইন, পুলিশ প্রশাসন, ভূমি ব্যবস্থাপনা ও দণ্ডবিধির বহু ধারায় পাকিস্তানি আইনের প্রভাব এখনো বিদ্যমান। পারিবারিক আইন- বিশেষত বিবাহ, তালাক, মোহরানা, উত্তরাধিকার- দু’দেশেই প্রায় একই।
আইন বিশ্লেষকরা বলেন, বাংলাদেশ- ভারত- পাকিস্তানের আইনব্যবস্থা একই উৎস থেকে গঠিত হওয়ায় এখানে পারস্পরিক সাদৃশ্য অত্যন্ত স্বাভাবিক।
যুক্তরাষ্ট্র থেকে মৌলিক অধিকার ও সাংবিধানিক তত্ত্বের প্রভাব : যদিও বাংলাদেশের আইনের মূল কাঠামো ব্রিটিশ কমন ল’, তবুও সংবিধানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রভাব অস্বীকার করা যায় না। স্বাধীনতা- পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের সংবিধানে যুক্তরাষ্ট্রের, মৌলিক অধিকার সুরক্ষা, রাষ্ট্রক্ষমতার বিভাজন এর ধারণা আংশিকভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
সংবিধানের মৌলিক অধিকার অধ্যায়, নাগরিক স্বাধীনতা ও আদালতের ন্যায়বিচার সম্পর্কিত ধারায় এই প্রভাব স্পষ্ট। মানবাধিকার সুরক্ষা এবং বিচারব্যবস্থার স্বাধীনতা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি নীতি বাংলাদেশের আইনমণ্ডলেও অনুকরণীয় উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
ফরাসি প্রশাসনিক আইনেও মিল খুঁজে পান বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের প্রশাসনিক আইন ও সরকারি কর্পোরেশন ব্যবস্থায় ইউরোপীয়, বিশেষ করে ফরাসি প্রশাসনিক আইনধারার প্রভাব দেখা যায়। ফ্রান্সের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালের মতো বাংলাদেশেও কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল ও বিশেষায়িত সংস্থার ভূমিকা বেড়েছে।
ফরাসি “নির্বাহী ক্ষমতার আধিপত্য” তত্ত্ব এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের অস্তিত্ব বাংলাদেশের প্রশাসনিক আইনে আংশিকভাবে প্রতিফলিত। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থার আন্তর্জাতিক রূপান্তরের অংশ।
মধ্যপ্রাচ্যের শরিয়াহভিত্তিক আইনের প্রভাব :
বাংলাদেশের মুসলিম ব্যক্তিগত আইন মূলত শরিয়াহভিত্তিক, যা পাকিস্তান, সৌদি আরব, মিসরসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশের পারিবারিক আইনের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। বিবাহ, তালাক, রক্ষণাবেক্ষণ, মোহরানা, উত্তরাধিকার- এসব বিষয়ে বাংলাদেশ ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির অনুসরণে আইন প্রণয়ন করেছে।
বাংলাদেশের যে বিধানসমূহ রয়েছে, তা অনেক মধ্যপ্রাচ্যের দেশের আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ধর্মীয় বিধানের ভিত্তিতে গঠিত বিধিগুলো দক্ষিণ এশিয়ার মুসলিম সমাজে যুগ যুগ ধরে অভিন্নভাবে চলে আসছে।
আন্তর্জাতিক আইন ও সমসাময়িক বিশ্বব্যবস্থার প্রভাব : বিশ্বায়নের কারণে বাংলাদেশের আইনব্যবস্থায় আন্তর্জাতিক আইনি নীতির প্রভাবও ক্রমশ বাড়ছে।
যেমন- মানবাধিকার আইন, পরিবেশ সুরক্ষা, শ্রম অধিকার, নারী ও শিশুর সুরক্ষা, বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আইন। এসব ক্ষেত্রে জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (ওঈঈ)- এর নীতি ও মানদণ্ড বাংলাদেশের আইন সংশোধনে ভূমিকা রাখছে। পরিবেশ আদালত, ভোক্তা অধিকার আইন, তথ্য অধিকার আইন, মানব পাচার দমন আইন- এসবই আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রণীত।
বাংলাদেশের আইন একটি মিশ্র কাঠামো :
আইন গবেষকরা বলছেন, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ একটি সম্পূর্ণ নতুন আইনব্যবস্থা গড়ে তুলেনি; বরং ঐতিহাসিকভাবে উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আইনকাঠামোকেই সময়োপযোগী করে নিয়েছে।
ফলে ব্রিটিশ, ভারতীয়, পাকিস্তানি, ইসলামী, ইউরোপীয় ও আধুনিক আন্তর্জাতিক আইনের সমন্বয় ঘটেছে।
তাদের মতে, এই মিশ্র কাঠামো একদিকে যেমন বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতার সঙ্গে মানানসই, তেমনি বৈশ্বিক মানদণ্ড রক্ষায়ও সহায়ক। আদালতের প্রশাসন, ফৌজদারি বিধান, পারিবারিক আইন এবং সংবিধানিক অধিকারে বহির্বিশ্বের প্রভাব স্পষ্ট হলেও দেশটি নিজস্ব প্রয়োজন অনুযায়ী আইনগুলোকে পুনর্গঠিত করছে।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, বাংলাদেশের আইনব্যবস্থার সঙ্গে সবচেয়ে বেশি মিল রয়েছে যুক্তরাজ্য, ভারত ও পাকিস্তানের, তবে সংবিধান ও মানবাধিকার আইনে যুক্তরাষ্ট্র, প্রশাসনিক আইনে ফ্রান্স, এবং ব্যক্তিগত আইনে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর অনুরূপতা পাওয়া যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বহুমাত্রিক প্রভাব বাংলাদেশের আইনকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে উন্নয়নের পথও সুগম করেছে।

