বৈদেশিক চুক্তি সম্পর্কে জনগণের জানার অধিকার কতটুকু?
আইন ও আদালত ডেস্ক
প্রকাশ: ০২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১১:২০
বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক প্রকাশ নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। সামরিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে বড় অবকাঠামো ঋণ- বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের সিদ্ধান্ত ও দায় জনগণের ওপরই বর্তায়। ফলে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন উঠছে- বাংলাদেশের জনগণের কি বৈদেশিক চুক্তি সম্পর্কে জানার সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার রয়েছে? সংবিধান, তথ্য অধিকার আইন ও আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক নীতির আলোকে বিষয়টির গুরুত্ব আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে তথ্য জানার অধিকার :
বাংলাদেশের সংবিধান সরাসরি “বৈদেশিক চুক্তি প্রকাশ” সম্পর্কে কিছু না বললেও ৩৯ অনুচ্ছেদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে তথ্য জানার স্বাধীনতার ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আইনজ্ঞদের মতে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা তখনই কার্যকর হয় যখন নাগরিক তথ্য জানতে ও তা প্রকাশ করতে স্বাধীন থাকে। এ বিষয়ে সংবিধানের ১১ অনুচ্ছেদে ঘোষিত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার নীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গণতন্ত্রে রাষ্ট্র পরিচালনার তথ্য জনগণের কাছে উন্মুক্ত থাকা স্বাভাবিক বিধান। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি ও বৈদেশিক প্রতিশ্রুতি জনগণের অজানা থাকলে সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণ গণতান্ত্রিক নীতির সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না। তাছাড়া সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের ভাষ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রক্ষমতার উৎস জনগণ। তাই রাষ্ট্রের পক্ষে আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনের বিষয়েও জনগণের অবহিত থাকার যৌক্তিক ভিত্তি রয়েছে।
তথ্য অধিকার আইন ২০০৯: কতটা সুযোগ, কতটা বাধা : ২০০৯ সালে তথ্য অধিকার আইন কার্যকর হওয়ার পর সরকারি নথি বা তথ্য পাওয়ার বিষয়টি আইনি কাঠামোর আওতায় আসে। এই আইনে যেকোনো সরকারি দপ্তর, সংবিধিবদ্ধ সংস্থা বা বৈদেশিক সহায়তাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান থেকে তথ্য পাওয়ার সুযোগ আছে নাগরিকের। তবে আইনটির ৩২ ধারা কিছু ব্যতিক্রমও রেখেছে- বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্ক বা বৈদেশিক নীতির ক্ষতি হতে পারে এমন তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে। এর ফলে অনেক বৈদেশিক চুক্তির খসড়া বা সংবেদনশীল ধারাগুলো প্রকাশের আওতা থেকে বাদ পড়ে।
আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তথ্য অধিকার আইনের আওতায় মোট চুক্তি গোপন রাখা নয়; বরং যে চুক্তি বা তথ্য প্রকাশ করলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে, শুধু সে অংশগুলো সীমিত রাখা যায়। অনেক ক্ষেত্রেই চুক্তির মূল কাঠামো প্রকাশ করা সম্ভব হলেও তা বাস্তবে নিয়মিত হয় না। অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশে বৈদেশিক চুক্তি সংসদে অনুমোদনের বিধান রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সিনেট দুই-তৃতীয়াংশ ভোটে চুক্তি অনুমোদন করে। ভারতেও সামরিক বা গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক চুক্তি সংসদে আলোচনার জন্য পেশ করার প্রথা আছে। বাংলাদেশে পরিস্থিতি ভিন্ন। সংবিধানে বৈদেশিক চুক্তি সংসদে উপস্থাপনের বাধ্যতামূলক বিধান নেই। ফলে নির্বাহী বিভাগই চুক্তি সম্পাদন এবং তা বাস্তবায়নের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ধরে রাখে। সংসদ চাইলে প্রশ্নোত্তর পর্ব বা আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি তুলতে পারে, কিন্তু সরকারকে চুক্তি উন্মুক্তভাবে উপস্থাপন করতে বাধ্য করতে পারে না। সাবেক কূটনৈতিকরা মনে করেন, এই কাঠামো সরকারের জন্য দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে। তবে স্বচ্ছতার দিক থেকে এটি জনগণের জানার অধিকার সীমিত করে দেয়।
স্বচ্ছতা বনাম জাতীয় নিরাপত্তা- সরকারি যুক্তি :
সরকারি নীতি নির্ধারকরা প্রায়ই বলেন, অনেক চুক্তিতে গোপনীয়তা আন্তর্জাতিক নিয়ম। সামরিক সহযোগিতা, নিরাপত্তা, গোয়েন্দা তথ্য বিনিময়, কৌশলগত বিনিয়োগ বা প্রতিযোগিতামূলক অর্থনৈতিক প্রকল্পে আগাম ধারা প্রকাশ করলে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ফলে এসব ক্ষেত্রে গোপনীয়তা প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে নাগরিক সমাজ ও গবেষকরা যুক্তি দেন- চুক্তির পুরোটা গোপন রাখার প্রয়োজন নেই। সাধারণত নীতিগত কাঠামো, আর্থিক দায়, শর্ত ও মেয়াদ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করা সম্ভব। অনেক দেশ আংশিক বা সম্পূর্ণ প্রকাশ্য চুক্তির মাধ্যমে গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা বাড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড কী বলে? :
জনগণের তথ্য জানার অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের International Covenant on Civil and Political Rights (ICCPR)- এর ১৯ অনুচ্ছেদে তথ্য অনুসন্ধান ও গ্রহণের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ এই চুক্তির সদস্য, ফলে আন্তর্জাতিকভাবে তথ্য জানার অধিকার রক্ষার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
বিভিন্ন দেশ ÒOpen Government PartnershipÓ -এর অধীনে সরকারি চুক্তি, বিশেষ করে বড় বিনিয়োগ বা ঋণ চুক্তি প্রকাশ করে থাকে। এর ফলে দুর্নীতি কমে ও নীতি সিদ্ধান্তে জনগণের আস্থা বাড়ে। বাংলাদেশ এই উদ্যোগের অংশ না হলেও আন্তর্জাতিক গণতান্ত্রিক মানদণ্ড স্পষ্টভাবে স্বচ্ছতার পক্ষে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অবকাঠামো, জ্বালানি, প্রতিরক্ষা ও বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে দেশে আলোচনার ঝড় উঠেছে। গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের দাবি- অনেক চুক্তি জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয় না, আর্থিক দায়বদ্ধতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না, সংসদীয় আলোচনা হয় না, তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চেয়েও প্রায়ই কাঙ্খিত ফল পাওয়া যায় না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সরকারি কর্মকর্তারা বলেন, চুক্তি প্রকাশে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা, দেশিয় নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক সংবেদনশীলতার ভারসাম্য রক্ষা করা জরুরি। তাদের মতে, বিদেশি পক্ষগুলো অনেক সময় চুক্তির কিছু অংশ প্রকাশ না করার শর্ত আরোপ করে, যা অমান্য করা সম্ভব নয়।
কোন চুক্তি প্রকাশযোগ্য, কোনটি নয়? :
বিশ্লেষকদের মতে, বৈদেশিক চুক্তিগুলো তিন ভাগে দেখা যায়- সম্পূর্ণ প্রকাশযোগ্য চুক্তি। যেমন- শিক্ষা ও সংস্কৃতি সহযোগিতা, পরিবেশ, জলবায়ু ও উন্নয়ন সহায়তা, সাধারণ প্রযুক্তিগত সহযোগিতা। এসব চুক্তিতে গোপনীয়তা প্রয়োজন হয় না এবং অধিকাংশ দেশ এগুলো প্রকাশ করে।
আংশিক প্রকাশযোগ্য :
যেমন- বিদেশি ঋণ, বড় অবকাঠামো বা বিদ্যুৎ প্রকল্প, বাণিজ্যিক ট্যারিফ বা কর-সম্পর্কিত সমঝোতা। এ ক্ষেত্রে চুক্তির মূল কাঠামো প্রকাশযোগ্য হলেও আর্থিক সূচক বা ব্যবসায়িক গোপনীয়তা সীমিত রাখা হতে পারে। সংবেদনশীল চুক্তি যেমন- প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা তথ্য, কৌশলগত অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব, এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার কারণে অনেক তথ্য গোপন রাখা হয়।
স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে কী করা যেতে পারে :
গবেষকদের প্রস্তাব- সরকারি ওয়েবসাইটে চূড়ান্ত চুক্তি প্রকাশ বাধ্যতামূলক করা সংসদে বৈদেশিক চুক্তি উপস্থাপন ও আলোচনার বিধান আইন করে চালু করা। তথ্য অধিকার আইন বাস্তবে প্রয়োগ করা, অযথা “গোপনীয়তা” ধারা ব্যবহার না করা।গণমাধ্যম ও নাগরিক সমাজের অনুসন্ধানী ভূমিকা বাড়ানো। আন্তর্জাতিক সেরা অনুশীলন অনুসরণ করে স্বচ্ছতা নীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক করা। সংবিধান ও আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের জনগণের বৈদেশিক চুক্তি সম্পর্কে জানার অধিকার রয়েছে- এটি গণতান্ত্রিক নীতির অংশ। তবে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা, কূটনৈতিক সংবেদনশীলতা এবং আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার কারণে কিছু চুক্তি বা ধারায় সীমাবদ্ধতা থাকতে পারে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো সরকার স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তার মধ্যে সুষম ভারসাম্য রক্ষা করবে এবং জনগণের ওপর প্রভাব ফেলা বড় ধরনের বৈদেশিক চুক্তি সম্পর্কে যথাসম্ভব তথ্য উন্মুক্ত করবে।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জনগণের জানার অধিকার রক্ষা করা হলে নীতি সিদ্ধান্তে আস্থা বাড়ে, এবং রাষ্ট্র ও জনগণের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হয়।
আইএইচ/

