পথেঘাটে মলমূত্র ত্যাগ, শাস্তির আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ নেই
মাসুম আহম্মেদ
প্রকাশ: ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৪৪
রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন অলিগলি, রাজপথ ও জনসমাগমস্থলে দিন-দুপুরে কিংবা গভীর রাতে নির্বিচারে মল-মূত্র ত্যাগ এখন নিত্যচিত্রে পরিণত হয়েছে। রাজধানীর জনবহুল অনেক এলাকাতেই দেখা যায়- রাস্তার মোড়, গলি, দেয়ালের পাশে কিংবা কোনো অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে মানুষ নির্বিঘ্নে মূত্রত্যাগ করছে। মলমূত্রের দুর্গন্ধ, নোংরা পরিবেশ ও বর্জ্যরে স্তূপ পথচারীদের দৈনন্দিন চলাফেরাকে চরমভাবে ব্যাহত করছে। এ পরিস্থিতি নাগরিক স্বাস্থ্যঝুঁকি নয়- শহরের পরিচ্ছন্নতা ও সৌন্দর্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
এদিকে নগরবাসীর অভিযোগ- ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি ও ডিএসসিসি) বর্জ্য অপসারণে গাফিলতি করছে, আর গণশৌচাগারের ঘাটতি সমস্যাটিকে আরও প্রকট করছে। সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোর উদাসীনতার কারণেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার কোটিরও বেশি মানুষের তুলনায় পাবলিক টয়লেটের সংখ্যা অপ্রতুল। অনেক এলাকায় তো কোনো গণশৌচাগারই নেই। যেগুলো রয়েছে, তার বেশিরভাগই অযত্নে পড়ে আছে, কিংবা নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ না হওয়ায় ব্যবহার অনুপযোগী। রাজধানীতে রাস্তার ওপর মূত্রত্যাগের জন্য আইন অনুযায়ী জরিমানার বিধান থাকলেও জরিমানা কার্যকরের নজির প্রায় নেই। গণশৌচাগারের ঘাটতি এবং তদারকির অভাবে মানুষ বাধ্য হয়ে খোলা জায়গা ব্যবহার করছে- যা শহরের সার্বিক স্যানিটেশন পরিস্থিতিকে বিপর্যস্ত করছে।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, খোলা স্থানে মানব মলমূত্র পড়ে থাকার ফলে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস ও পরজীবী দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এতে ডায়রিয়া, আমাশয়, চর্মরোগসহ নানা সংক্রমণের জুঁকি বাড়ে। অনেক এলাকায় জমে থাকা বর্জ্য থেকে উৎপন্ন দুর্গন্ধ ও দূষিত পানি ড্রেন দিয়ে ছড়িয়ে পড়ায় পরিবেশও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খোলা স্থানে মলমূত্র ত্যাগের কারণে রাজধানীতে নানা সংক্রামক রোগের ঝুঁকি প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
ডিএনসিসি ও ডিএসসিসির আইন অনুযায়ী, রাস্তা, গলি, ডাস্টবিন, ড্রেন, উরিন্যাল ও গণশৌচাগার পরিষ্কার রাখা সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্ব। ঢাকা সিটি কর্পোরেশন অর্ডিন্যান্স, ১৯৮৩- এর ৭৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, সিটি কর্পোরেশনকে নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা এবং ডাস্টবিন স্থাপনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায়- অনেক এলাকায় নিয়মিত বর্জ্য তোলা হয় না। ডাস্টবিনের সংখ্যা কম, আবার যেগুলো আছে সেগুলোও প্রায়ই ভরা থাকে। এতে বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ে আশপাশে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণায় বলা হয়- পর্যাপ্ত অবকাঠামো, জনবল ও সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় চরম অকার্যকারিতা দেখা যায়; যার ফলে শহরে অপরিষ্কার পরিবেশ তৈরি হচ্ছে।
আইন আছে, প্রয়োগ নেই : Local Government (City Corporation) Act, 2009-এর ৯২ ধারা অনুযায়ী পাবলিক স্থানে মল-মূত্র ত্যাগ করলে সর্বোচ্চ ৫,০০ টাকা জরিমানা করা যায়। বারবার করলে প্রতিদিন অতিরিক্ত ৫০০ টাকা জরিমানার বিধান আছে। তবে আইন প্রয়োগ না হওয়ায় এখনো পর্যন্ত খুব কম মানুষই শাস্তির মুখোমুখি হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে অনেকেই মনে করেন- কেউ দেখছে না, জরিমানা হয় না এমন ধারণায় মানুষ খোলা জায়গায় মূত্রত্যাগের মতো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, ঢাকার মতো একটি বিশ্বমেগাসিটিতে স্যানিটেশন ব্যবস্থার এমন অবস্থা ‘অগ্রহণযোগ্য’। তাদের মতে, সিটি কর্পোরেশনকে অবশ্যই গণশৌচাগার সংখ্যা বাড়াতে হবে, নিয়মিত পরিষ্কার কার্যক্রম জোরদার করতে হবে এবং জরিমানার মাধ্যমে আইন কার্যকর করতে হবে। এছাড়া, জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ না নিলে স্যানিটেশন সংকট আরও ঘনীভূত হবে।
রাজধানী ঢাকার অলিগলি ও রাজপথে মলমূত্র ত্যাগের ঘটনা শুধু ব্যক্তিগত অসচেতনতা নয় বরং সিস্টেম বা ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার স্পষ্ট প্রতিফলন। ঢাকার স্যানিটেশন ব্যবস্থা যদি দ্রুত ও পরিকল্পিতভাবে সংস্কার না করা হয়, তাহলে জনস্বাস্থ্য ও নগর পরিবেশ আরও বিপর্যস্ত হবে- যার মূল্য দিতে হবে পুরো নগরবাসীকেই।
বিকেপি/এমবি

