বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা বাস্তবায়নে কয়েক বছর ধরে ব্যর্থ হচ্ছে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা ২০২৬ শিক্ষাবর্ষের প্রথম দিন নতুন বই হাতে পাবে। তবে মাধ্যমিকের চার শ্রেণির শিক্ষার্থীদের হাতে জানুয়ারিতে বই তুলে দেওয়া সম্ভব হবে না। মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া হতে পারে একটি বা দুটি বই। ফলে বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হওয়া ‘বই উৎসব’ তার মর্যাদা হারাবে বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) অধীনে ৬৭টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান এবার প্রাথমিকের বই ছাপার কাজ পেয়েছে। একাধিক মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরে কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
জানা গেছে, নিয়ম ভঙ্গ করে এনসিটিবি দরপত্রে উল্লিখিত নির্ধারিত মানের কাগজ, ছাপা ও বাঁধাই উপকরণ ব্যবহার না করে অনেক প্রতিষ্ঠান বই ছাপার কাজ করেছে। এনসিটিবি অভিযুক্তদের কিছু বই, ফর্মা ও কাভার বিনষ্ট করলেও এর বাইরে আরও কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান অনিয়ম করে পার পেয়ে যাচ্ছে।
এদিকে, নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরুর আর মাত্র ২৩ দিন বাকি রয়েছে। এর মধ্যে মাধ্যমিকের নবম শ্রেণির বই ছাপার কাজ শুরু হয়েছে। তবে ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেণির বই চাপার কাজ চলছে পুরোদমে। এগুলো ১৫-২৫ ডিসেম্বরের মধ্যে স্থানীয় পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন এনসিটিবির বিতরণ নিয়ন্ত্রণ (মাধ্যমিক) মো. মতিউর রহমান পাঠান। তিনি বলেন, ‘রাত-দিন ছাপাখানায় এখন কাজ চলছে। আমরা চাই যত দ্রত সম্ভব বইয়ের ছাপার কাজ শেষ করতে।’
এনসিটিবির অপর এক সূত্র জানায়, মাধ্যমিকের যে অবস্থা হয়তো জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে দুই-একটি বই দেওয়া সম্ভব হবে। সব বই পেতে হয়তো ফেব্রুয়ারি লেগে যাবে।
অন্যদিকে, চলতি শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই পৌঁছাতে প্রায় তিন মাস দেরি হয়েছিল। এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষতির মুখে পড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩০ ভাগ নি¤œমানের বই দিয়েছে কিছু মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে ২৯ প্রতিষ্ঠানকে নামমাত্র জরিমানা করা হলেও অধিকাংশ ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল।
চলতি বছর সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৭৫ হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে ৩০ কোটি ২ লাখ ৫৫ হাজার ১৫৪টি বই বিতরণের লক্ষ্য সরকারের। যেখানে বাজেট ধরা হয়েছে প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর শিক্ষার সব সেক্টরে পরিবর্তন এলেও ব্যতিক্রম শুধু এনসিটিবি। এখনো প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের বই ছাপায় অনিয়ম ও দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। এ বিভাগে আওয়ামীপন্থি কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেট ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করার কারণে চলতি শিক্ষাবর্ষেও নিম্নমানের বই ছাপার অভিযোগ রয়েছে।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক শাখা সূত্রে জানা গেছে, এনসিটিবি ইতোমধ্যে নিম্নমানের কারণে ৩০টি প্রতিষ্ঠানের ৬০ হাজার বই, ২ লাখ ৩৫ হাজার বইয়ের ফর্মা বিনষ্ট করেছে। এ ছাড়া দশটি প্রতিষ্ঠানকে শোকজ নোটিশ দিয়েছে। অস্পষ্ট ছাপা ও মুদ্রণের মারাত্মক ত্রæটির কারণে স¤প্রতি ১৪টি প্রতিষ্ঠানের বই নষ্ট করা হয়।
এনসিটিবি সূত্র আরও জানায়, আগামী শিক্ষাবর্ষে প্রাথমিক স্তরে ৮ কোটি ৫৯ লাখ ২৫ হাজার ৩৭৯টি বই শিক্ষার্থীদের বিতরণ করা হবে।
এনসিটিবির উৎপাদন নিয়ন্ত্রক (প্রাথমিক) আবু নাসের টুকু বলেন, প্রাথমিকের মোট বইয়ের প্রায় ৯৫ শতাংশ ছাপার কাজ শেষ হয়েছে। ইবতেদায়ির প্রায় ৩ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৩৪৭টি বইয়ের ছাপার কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২৫ ডিসেম্বরের মধ্যেই স্থানীয় পর্যায়ে চলে যাবে।
প্রেস মালিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইয়ের ৭০ শতাংশ বইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। অষ্টম শ্রেণিরও শুরু হয়েছে। আর নবম শ্রেণির ৫ কোটি ৭০ লাখ ৬৮ হাজার ২৮টি বইয়ের মুদ্রণ ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণির ১২ কোটি ৫৪ লাখ ৭৫ হাজার ৯৭১ কপি বই ছাপতে হবে।
বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল আহমেদ খান বলেন, কাজের অর্ডার পাওয়ার পর ব্যাংক লোন পাই। এরপর কাজ শুরু হয়। তবে যারা কাজ পেয়েছে তারা তাদের সাধ্যমতো কাজ করছে। যাতে করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়। সময়মতো কাজ শুরু না হলে শেষ সময়ে তাড়াহুড়া করা হয় বই ছাপাতে। সে সময় বইয়ের গুণগত মান ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। সরকারের পক্ষ থেকেও থাকে তাগাদা।
বছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের হাতে বিনা মূল্যের পাঠ্যবই পৌঁছে দেওয়ার ঘোষণা বাস্তবায়নে কয়েক বছর ধরেই ব্যর্থ হচ্ছে এনসিটিবি।
এদিকে গত ২১ সেপ্টেম্বর আগামী শিক্ষাবর্ষের নবম ও দশম শ্রেণির পাঠ্যবইয়ের বিষয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হলেও দরপত্র প্রক্রিয়ায় অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের কারণে অনুমোদন দেয়নি সরকার।
পরে তা আরও যাচাই-বাছাই করার নির্দেশনা দেয় ক্রয় কমিটি। এ নিয়ে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে গত মঙ্গলবার মাধ্যমিক (বাংলা ও ইংরেজি ভার্সন) নবম শ্রেণি, দাখিল নবম শ্রেণি, এসএসসি ও দাখিল (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণি এবং কারিগরি ট্রেড নবম ও দশম শ্রেণির বিনা মূল্যের ৫ কোটি ৫৪ লাখ ৯০ হাজার ৮৬৯টি পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণের অনুমোদন দেয় সরকার। যদিও সেদিন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে বইয়ের আলোচ্য বিষয়টি নথিভুক্ত করেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়। একটা বিশেষ মহলকে সুবিধা দিতে এই ধরনের কৌশল অবলম্বন করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব রেহানা বলেন, আশা করছি, যথাসময়ে শিক্ষার্থীরা পাঠ্যবই হাতে পাবে। যদি কোনো কারণে কিছু বই পেতে দেরি হয়, সেটার ঘাটতি পূরণে অবশ্যই মন্ত্রণালয় ও মাউশি ব্যবস্থা নেবে।
বিকেপি/এমবি

