হাদিকে গুলি ‘হাসিনার রাষ্ট্রব্যবস্থা’ টিকিয়ে রাখার ফল : ফরহাদ মজহার
বাংলাদেশের প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৮
জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন ফরহাদ মজহার। ছবি : বাংলাদেশের খবর
জুলাই অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও ‘হাসিনার রাষ্ট্রব্যবস্থা’ এখনো টিকিয়ে রাখা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন কবি ও ভাবুক ফরহাদ মজহার। তিনি মনে করেন, ‘হাসিনার রাষ্ট্রব্যবস্থা’ টিকিয়ে রাখার দৃশ্যমান ফল হলো, ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদিকে গুলি করে হত্যাচেষ্টার ঘটনা।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘‘৮ অগাস্টের ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’ জনগণের গাঠনিক ক্ষমতাকে অস্বীকার করে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখে। ‘হাসিনাহীন হাসিনার শাসন’ টিকিয়ে রাখার শর্তই হলো সহিংসতা ও সন্ত্রাস। ওসমান হাদির ওপর গুলি চালানো সেই শর্তেরই দৃশ্যমান, রক্তাক্ত বহিঃপ্রকাশ। এটি কোনো ব্যতিক্রম নয়— এটি ‘হাসিনাহীন হাসিনার রাষ্ট্রব্যবস্থা’ অক্ষুণ্ণ ও টিকিয়ে রাখার স্বাভাবিক ফল, যেটিকে ‘সংবিধান রক্ষা’র নামে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।’’
সোমবার (১৫ ডিসেম্বর) সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের মাওলানা আকরম খাঁ হলে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন ফরহাদ মজহার। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়।
ফরহাদ মজহার বলেন, ‘‘বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য তিনটি স্তরে অনুধাবন করা জরুরি। প্রথমত, (শেখ হাসিনা সরকার পতনের পরে ২০২৪ সালের) ৮ আগস্টের সাংবিধানিক সিদ্ধান্তের প্রকৃতি; দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার শাসনামলে গড়ে ওঠা রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিক চরিত্র; তৃতীয়ত, সেই কাঠামোর ভেতরে সংঘাত ও সন্ত্রাস কীভাবে ‘স্বাভাবিক শাসন-পদ্ধতি’তে পরিণত হয়েছে।’’
তিনি বলেন, ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক ভাঙন তৈরি হয়েছিল, তা কেবল সরকার পরিবর্তনের নয়; বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বৈধতার উৎস নিয়ে একটি মৌলিক প্রশ্ন উত্থাপন করেছিল। জনগণের ক্ষমতা প্রয়োগের যে ঐতিহাসিক সুযোগ তখন তৈরি হয়েছিল, ৮ আগস্টের সাংবিধানিক সিদ্ধান্ত সেই সুযোগকে বন্ধ করে দেয়। এর মাধ্যমে পুরোনো সংবিধান, পুরোনো রাষ্ট্রযন্ত্র ও পুরোনো ক্ষমতা-বণ্টন অক্ষুণ্ণ রেখে ক্ষমতার ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা হয়।’ ফরহাদ মজহারের ভাষায়, এটাই ছিল একটি ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লব’।
তিনি আরও বলেন, ‘‘কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই নিরপেক্ষ নয়; তারা বিদ্যমান ক্ষমতা-বণ্টনের প্রতিফলন। যখন সেই ক্ষমতা-বণ্টন সংকটে পড়ে, তখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনী, আমলাতন্ত্র ও বিচারিক কাঠামো নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহিংসতা ও ভয়ভীতির পথে হাঁটে। ৮ আগস্টের পর শেখ হাসিনার আমলে গড়ে ওঠা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ‘সংবিধান রক্ষা’র নামে টিকিয়ে রাখা হয়েছে।’’
জুলাই অভ্যুত্থানের অন্যতম মুখ, ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক ও আসন্ন সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য প্রার্থী ওসমান হাদিকে গুলিবিদ্ধ করার ঘটনাকে বিচ্ছিন্ন অপরাধ হিসেবে দেখার সুযোগ নেই উল্লেখ করে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এটি রাষ্ট্রীয় সহিংসতার ধারাবাহিক প্রকাশ। ভিন্নমত, প্রতিবাদ কিংবা গণঅভ্যুত্থানের স্মৃতি বহনকারীদের শারীরিকভাবে নিস্তব্ধ করে দেওয়াই এই রাষ্ট্রব্যবস্থার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কৌশল। এটি ক্ষমতাবান গোষ্ঠীর ‘হোল্ডিং পাওয়ার’ প্রদর্শনের অংশ।’’
তিনি বলেন, ‘‘আততায়ী রাজনীতি কোনো নৈতিক বিচ্যুতি নয়; এটি ৮ আগস্টের ‘সাংবিধানিক প্রতিবিপ্লবের’ অনিবার্য ফল। যখন জনগণের সম্মতির বদলে অস্ত্র, প্রশাসন ও আইনি ফরমালিটির ওপর রাষ্ট্রের বৈধতা নির্ভর করে, তখন হত্যাচেষ্টা, গুম ও হামলাই হয়ে ওঠে রাষ্ট্র পরিচালনার ভাষা।’
এ প্রেক্ষাপটে জনগণের করণীয় প্রসঙ্গে ফরহাদ মজহার বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র ও আইন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি ন্যূনতম নৈতিক প্রতিক্রিয়া হলেও তা যথেষ্ট নয়। সমস্যাটি ব্যক্তির নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বিন্যাস ও দায়বদ্ধতার কাঠামোর।’
তিনি বলেন, ‘‘জনগণের কর্তব্য হলো সহিংস ঘটনাগুলোকে ‘বিচ্ছিন্ন অপরাধ’ হিসেবে মানতে অস্বীকার করা, দায় ব্যক্তিকরণের রাজনীতি এড়িয়ে রাষ্ট্রীয় নকশাগত ব্যর্থতাকে সামনে আনা এবং বিচার ও নির্বাহীর দায়হীন সম্পর্ককে রাজনৈতিক প্রশ্নে পরিণত করা। একই সঙ্গে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর যে গাঠনিক ক্ষমতার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল, সেটিকে আবার সামনে নিয়ে আসতে হবে।’’
ফরহাদ মজহারের মতে, রাষ্ট্র নতুনভাবে কীভাবে গঠিত হবে, কোন দায়বদ্ধতার ভিত্তিতে জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে— এই প্রশ্নগুলোই আজকের বাংলাদেশে দায়িত্বশীল গণরাজনীতির মূল বিষয়।
এমএস/এইচকে

