দেশে বজ্রপাতের ঘটনায় গত ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজার মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। আহত হয়েছেন এক হাজার ৩০০ জনের বেশি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বজ্রপাতজনিত ঝুঁকি দ্রুত বাড়লেও আগাম সতর্কতা ও কমিউনিটি প্রস্তুতি এখনো অত্যন্ত সীমিত। ‘ব্রিজিং সায়েন্স উইদ কমিউনিটিজ: ডেভেলপিং অ্যা কমিউনিটি-বেজড লাইটনিং আর্লি ওয়ার্নিং সিস্টেম ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর (বিএমডি) ও প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ যৌথভাবে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। গতকাল রাজধানীর একটি হেটেলে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বজ্রপাতে প্রায় দুই হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে, আহত হয়েছেন এক হাজার ৩০০ জনের বেশি। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন গ্রামীণ কৃষক ও জেলে কমিউনিটি, বিশেষ করে সুনামগঞ্জসহ হাওর অঞ্চলের মানুষ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব আশরাফ উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর বজ্রপাতে গড়ে প্রায় ৩০০ মানুষের মৃত্যু হয়। অথচ দীর্ঘদিন ধরে এটি আমাদের দুর্যোগঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি। এই গবেষণা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে কম ডিসক্লোসড, কমিউনিটি-কেন্দ্রিক ও জীবনরক্ষাকারী পদক্ষেপে রূপান্তরের দিক-নির্দেশনা দিয়েছে।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক ও ডব্লিউএমও-তে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোমেনুল ইসলাম বলেন, বিএমডির বৈজ্ঞানিক তথ্য বজ্রপাতের উচ্চঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো চিহ্নিত করতে সক্ষম হলেও শুধু বিজ্ঞান যথেষ্ট নয়। কমিউনিটির আস্থা, সহজবোধ্য যোগাযোগ ও শক্তিশালী সমন্বয় ছাড়া হতাহতের সংখ্যা কমানো সম্ভব নয়।
সতর্কবার্তাগুলো যেন সময়মতো মাঠপর্যায়ে কার্যকর হয়, সেজন্য আন্তঃসংস্থা সমন্বয় জোরদারের ওপর গুরুত্ব দেন তিনি। প্রাথমিক সতর্কবার্তাগুলো যেন সবার কাছে বোধগম্য ও কার্যকর হয়-সে লক্ষ্যে প্রযুক্তি ও অংশীদারত্ব জোরদারে বিএমডি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
গবেষণায় আরও উঠে এসেছে, বজ্রপাতকে বিপজ্জনক ঝুঁকি হিসেবে স্বীকৃতি থাকলেও কমিউনিটি পর্যায়ে প্রস্তুতির মাত্রা অত্যন্ত কম। জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারের অর্ধেকের বেশি বজ্রপাতজনিত মৃত্যু বা আঘাতের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন। প্রায় ৭৭ শতাংশ উত্তরদাতা সতর্কতার লিড টাইম সম্পর্কে কিছুই জানেন না, আর ৯৬ শতাংশ কখনো বজ্রপাত বিষয়ক মহড়ায় অংশ নেননি। এর ফলে নারী, যুবক, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও স্বল্পশিক্ষিত জনগোষ্ঠী তুলনামূলকভাবে বেশি ঝুঁকির মুখে পড়ছেন বলে গবেষণায় উল্লেখ করা হয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত এইচ ই. হ্যাকন অ্যারাল্ড গুলব্র্যান্ডসেন বলেন, জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা একটি যৌথ দায়িত্ব। জাতীয় নেতৃত্ব, কমিউনিটির অংশগ্রহণ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারত্ব ছাড়া এটি সম্ভব নয়। উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষে ইউরোপীয় সিভিল প্রোটেকশন অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান এইড অপারেশনসের (ইকো) প্রতিনিধি মোকিত বিল্লাহ বলেন, কার্যকর আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে টেকসই বিনিয়োগ ও ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর প্রতি অটল মনোযোগ প্রয়োজন।
অনুষ্ঠানে প্যানেল আলোচনায় বজ্রপাত বিষয়ে প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে আসে স্বল্প পূর্বাভাস সময় (অনেক ক্ষেত্রে এক ঘণ্টারও কম), সীমিত রাডার কাভারেজ, দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা, আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব এবং প্রযুক্তিগত পূর্বাভাসকে সময়োপযোগী সতর্কবার্তায় রূপান্তরের ঘাটতি।
আলোচনায় জোর দেওয়া হয়, কার্যকর সমাধান হতে হবে কমিউনিটি-কেন্দ্রিক, যেখানে মোবাইলনির্ভরতার পাশাপাশি টিভি, রেডিও, লাউডস্পিকার, সাইরেন, স্কুলভিত্তিক সতর্কতা ও বাজারকেন্দ্রিক বার্তা ব্যবহারের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হবে। ২০১৬ সালে বজ্রপাতকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও পূর্বাভাসের নির্ভুলতা, সতর্কবার্তা প্রচার ও কমিউনিটি প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এখনো বড় ধরনের ঘাটতি রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে গবেষণাটি একটি কমিউনিটিভিত্তিক বজ্রপাত আগাম সতর্কতা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানিয়েছে, যা বৈজ্ঞানিক পূর্বাভাসকে স্থানীয় জ্ঞান ও বিশ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করবে।
বিকেপি/এমবি

