ধরিত্রী ও মানবজাতিকে রক্ষায় করণীয় নিয়ে বিশ্বজুড়ে নিরন্তর আলোচনা হচ্ছে স্থানীয়, আঞ্চলিক, উপআঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ফোরামে। আলোচনায় বিশ্বের সাধারণ মানুষসহ নাগরিক সমাজের মধ্যে হতাশা লক্ষ্যণীয়। মূলত জীবাশ্ম জ্বালানী ও তেল সমৃদ্ধ দেশসমূহের নেতাদের উদ্দেশ্য প্রণোদিত নির্লিপ্ততায় এক অনিবার্য পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে মানুষ এবং ধরিত্রী। বিশেষ করে সদ্য সমাপ্ত কপ-৩০ এ জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল ও জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভরতা কমানোর মতো গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তে দৃশ্যমান অগ্রগতি অর্জিত না হওয়ায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সংস্থা বলছে, বড় নিঃসরণকারী দেশগুলোর চরম অনীহা ও বিরোধিতায় প্রত্যাশিত অর্জন সম্ভব হয়নি। এমনি অবস্থায় বিশেষজ্ঞদের সতর্কবার্তা ও বিলম্বিত অভিযোজন তহবিল এলডিসি দেশগুলোর জন্য বাড়তি হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে বলে মন্তব্য জলবায়ু বিশ্লেষকদের। শিল্প উন্নতদেশ সমূহ ডিকার্বনাইজেশন ত্বরান্বিত করার প্রতিশ্রুতি দিলেও জীবাশ্ম জ্বালানি পর্যায়ক্রমে বন্ধের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ এবং পূর্বানুমেয় অভিযোজন তহবিল নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে এই সম্মেলন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, অভিযোজন তহবিল সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত পিছিয়ে যাওয়ায় সর্বনিম্নোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) মারাত্মক ঝুঁকিতে পড়বে, কারণ এই দেশগুলো ইতোমধ্যেই তীব্র জলবায়ু ঝুঁকির মুখোমুখি।
বিশেষ করে অ্যাডাপ্টেশন ফান্ডের সুস্পষ্ট পুনঃপূর্ণায়ন পরিকল্পনা না থাকায় উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এই বিলম্ব ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর জলবায়ু সহনশীলতা তৈরির প্রচেষ্টাকে দুর্বল করবে এবং আগাম সতর্কীকরণ ব্যবস্থা, উপকূল সুরক্ষা, জলবায়ু-সহনশীল কৃষিকে এগিয়ে নেওয়াকে বাধাগ্রস্ত করছে। এলডিসি প্রতিনিধিরা বলেন, পর্যাপ্ত এবং সহজ-প্রাপ্ত অর্থায়ন না হলে অভিযোজন ঘাটতি আরও বাড়বে এবং ক্ষয়-ক্ষতির চাপে দেশগুলো আরও বিপর্যস্ত হবে। এবারের সম্মেলনে দেখা গেছে , স্বেচ্ছাধীন হারে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর আহ্বানকে মূল সংকটকে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাস্তবে, কার্বন নিঃসরন এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রিতে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য অর্জনের কার্যকর উপায় না থাকায় পৃথিবী এখন তিন ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধির দিকে এগোচ্ছে। তাছাড়া অভিযোজন অর্থায়ন তিনগুণ করার লক্ষ্যও ২০৩০ থেকে পিছিয়ে ২০৩৫-এ নেওয়া তাও আবার কোনো বেসলাইন ছাড়াই।
মূলত উন্নত দেশগুলোর দায় এড়ানোর কৌশল হিসেবে এটিকে দেখা হচ্ছে, ফলে বাংলাদেশসহ এলডিসি ও ক্ষুদ্র দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর অস্তিত্ব সংকট ঘনীভূত হচ্ছে। মূলত বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ-৩০ এ উন্নত দেশ থেকে কোনো আর্থিক প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি, ভবিষ্যতেও এ নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তা ছাড়া জলবায়ু অর্থায়ন মূলত ঋণনির্ভর। তাই ন্যায়ভিত্তিক জলবায়ু অর্থায়ন নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে জোরালো প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। জলবায়ু বিশেষজ্ঞদের পরার্মশ উন্নত দেশসমূহ থেকে আর্থিক সহায়তার আশাবাদ দিয়ে নিজেদের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে অভিযোজন সক্ষমতা বাড়াতে। এ নিয়ে বৈশ্বিক ফোরামে আলোচনার জন্য দক্ষ ও দায়িত্বশীল সরকারি প্রতিনিধি দরকার কিন্তু বাংলাদেশ এতে পিছিয়ে।
মনে রাখা দরকার জলবায়ু অর্থায়নের নিশ্চয়তা ছাড়া জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেই এখনো এনডিসি-০৩ জমা দেয়নি, অথচ তারাই মনিটরিং নিয়ে আলোচনা করছে- যা হাস্যকর। সুনির্দিষ্ট বেসলাইন না থাকায় অর্থায়ন-সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো অর্থহীন। অন্যদিকে এবার সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাসের আলোচনা প্রায় নিষিদ্ধ ছিল। জ্বালানি লবির প্রভাবে জলবায়ু আলোচনাগুলো এখন অধিকারভিত্তিক না হয়ে কর্পোরেটমুখী হয়ে পড়েছে এবং প্রক্রিয়াটি আমলাতান্ত্রিক হয়ে গেছে। তাই সময় এসেছে জলবায়ু ন্যায়ের ভিত্তিতে কপ প্রক্রিয়া পুনর্গঠনের। একই সঙ্গে জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের দাবি ও অধিকার ভিত্তিক ফ্রেমওয়ার্ক এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাসের দাবিকে অব্যাহত রাখতে হবে। পাশাপাশি নিজেদের জলবায়ু অর্থায়নে স্বচ্ছতা ও রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, অধিকাংশ জলবায়ু অর্থায়ন আসে ঋণের মাধ্যমে। গবেষণা অনুযায়ী, জলবায়ু অর্থায়নের প্রতিটি পাঁচ ডলারের বিপরীতে সাত ডলার পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জলবায়ু ঋণ ৮০ ডলার। তাই ঋণনির্ভর পরিকল্পনা পরিহার করে বাংলাদেশের ব্লু ইকোনমির সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব অর্থায়ন বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহারের জন্য বাধ্যতামূলক সময়সীমা নির্ধারণ। জলবায়ু অর্থায়নের স্বচ্ছতা ও প্রবাহ নিশ্চিত করা। এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর দাবি অন্তর্ভুক্ত করে আরও জবাবদিহিমূলক বৈশ্বিক কাঠামো গঠন করা দরকার। যদিও ব্রাজিলের বেলেমে এ অনুষ্ঠিত কপ-৩০ জলবায়ু সম্মেলনকে ঘিরে বিশ্বজুড়ে ছিল ব্যাপক আগ্রহ ও প্রত্যাশা।
বিশেষ করে অ্যামাজন অঞ্চলে প্রথমবারের মতো এমন উচ্চপর্যায়ের বৈশ্বিক জলবায়ু আলোচনা হওয়ায় আশা করা হয়েছিল, এই সম্মেলন বৈশ্বিক জলবায়ু প্রতিশ্রুতিকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাবে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখা গেল, বহু ক্ষেত্রে অগ্রগতির চেয়ে স্থবিরতা ও আপস-সমঝোতার ছায়াই বেশি ঘনীভূত। বড় বড় নিঃসরণকারী দেশগুলোর রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং ভবিষ্যৎ প্রতিশ্রুতিতে অনীহা সব মিলিয়ে কপ-৩০-এর অর্জনকে শূন্যে নিয়ে গেছে। নাগরিক সমাজ যারা জলবায়ু ন্যায়বিচার, দুর্যোগঝুঁকি হ্রাস, আদিবাসী অধিকার, জীববৈচিত্র্য ও মানবিক সুরক্ষায় কাজ করে তাদের চোখে কপ-৩০ এর এই ফলাফল শূন্য। তাদের মতে, এ সম্মেলন প্রমাণ করেছে বৈশ্বিক নেতৃত্বের অভাব নয়, বরং প্রভাবশালী লবিস্ট গ্রুপগুলোর চাপ এবং জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পের রাজনৈতিক প্রভাব আন্তর্জাতিক জলবায়ু প্রতিশ্রুতিকে দুর্বল করে দিচ্ছে।
অনেক দেশ, বিশেষ করে দ্রুত শিল্পায়নশীল রাষ্ট্র, জ্বালানি পরিবর্তনের প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার পক্ষে অবস্থান নেয়। ফলে পরিবেশবাদী ও ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার তুলনায় সিদ্ধান্ত খুবই দুর্বল। আগের কপগুলো বিশেষ করে কপ-২৭ ও কপ-২৮ এ উচ্চ-আয়ের দেশগুলো ১০০ বিলিয়ন ডলার বার্ষিক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তার বড় অংশই পূরণ হয়নি। কপ-৩০ এ এ ঘাটতি পূরণের বিশেষ কোনো নতুন কাঠামো গঠন হয়নি। নতুন করে আলোচনায় এসেছে গ্লোবাল গোল অন অ্যাডাপটেশনের আর্থিক কাঠামো; কিন্তু এর জন্য নির্দিষ্ট অর্থায়ন, সময়সীমা, স্বচ্ছতা বা পর্যাপ্ত জবাবদিহির বিষয়গুলো উপেক্ষিত থেকে যায়। অনুরূপ কপ-২৮ এ ঘোষিত লস অ্যান্ড ড্যামেজ ফান্ড বাস্তবায়নের জন্য প্রশাসনিক কাঠামো কপ-৩০ এ কিছুটা অগ্রসর হয়, তবে তহবিলে পর্যাপ্ত অর্থ জোগাড় হয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর প্রকৃত প্রয়োজন বছরে কমপক্ষে ৩০০ বিলিয়ন ডলার হলেও কপ-৩০ শেষে এই তহবিলে যোগ হয়েছে মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ, যা বছরের প্রয়োজনের তুলনায় সামান্য। অ্যামাজনের মতো বিশাল কার্বন সিঙ্ক অঞ্চলে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে প্রকৃতি-ভিত্তিক সমাধানের গুরুত্ব বাড়বে এ প্রত্যাশা ছিল। যদিও বন উজাড় বন্ধ, পুনরুদ্ধার কার্যক্রম এবং আদিবাসী ভূমি রক্ষার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে, কোনো বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক কাঠামো নির্ধারিত হয়নি।
বিশ্বের ৪০০-এর বেশি পরিবেশবান্ধব দল, মানবাধিকার সংগঠন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও আদিবাসী নেটওয়ার্ক যৌথ বিবৃতি দেয় কপ-৩০ নিয়ে। তারা বলে ছিল এটি একটি মিসড অপারচুনিটি। জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের স্পষ্ট সময়সীমা এবং ন্যায়সঙ্গত ট্রানজিশন রোডম্যাপ দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বড় দেশগুলো জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির চাপের কাছে নতি স্বীকার করেছে। অভিযোজন ও ক্ষতি-ক্ষতিপূরণ নিয়ে দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো আরও পিছিয়ে পড়েছে। সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় তাদের কণ্ঠ যথাযথভাবে প্রতিফলিত হয়নি। জমি দখল, বন উজাড় এবং পরিবেশ-বিরোধী প্রকল্পগুলোর বিরুদ্ধে প্রতিরোধকে আন্তর্জাতিকভাবে সুরক্ষিত করার কোনো সুস্পষ্ট নীতি নেওয়া হয়নি। অবশ্য বিশ্বের তরুণ জলবায়ু কর্মীরা কপ-৩০ কে জলবায়ু ন্যায়বিচারের দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যর্থ বলে আখ্যা দেয়। তাদের বক্তব্য- লক্ষ্যগুলো খুবই ধীর, অঙ্গীকার বিভ্রান্তিকর, আর বাস্তবায়ন প্রায় শূন্য। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের নিরাপত্তাকে বড় দেশগুলো বারবার উপেক্ষা করছে। কপ-৩০-এর দুর্বলতার কারণ হচ্ছে বড় নিঃসরণকারী দেশগুলোর অনীহা।
বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরবসহ কয়েকটি প্রধান কার্বন নিঃসরণকারী দেশের শক্ত অবস্থান জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের প্রস্তাবকে দুর্বল করেছে। জীবাশ্ম জ্বালানি কোম্পানির লবিং এবং প্রভাবে কপ-৩০ এ ও দৃশ্যমান ছিল। তদুপরি বহু উন্নত দেশ অর্থনৈতিক মন্দা ও রাজনৈতিক অস্থিরতার মুখে থাকায় জলবায়ু অর্থায়ন ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা কমেছে। রয়েছে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিভাজন বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র-চীন উত্তেজনা, ইউরোপের জ্বালানি বাজারের অনিশ্চয়তা এবং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা জলবায়ু কূটনীতিকে দুর্বল করেছে। অ্যামাজন রেইনফরেস্ট সুরক্ষায় আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন আলোচনা। অভিযোজন পরিকল্পনার মূল্যায়ন কাঠামো কিছুটা শক্তিশালী করা।
নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি, যদিও বাধ্যতামূলক নয়। কপ-৩০-এর ফলাফলের আলোকে নাগরিক সমাজ যে বিষয়গুলোকে পরবর্তী সময়ে অগ্রাধিকার দাবি হিসেবে তুলে ধরছে তা হলো- জীবাশ্ম জ্বালানির ‘সম্পূর্ণ পরিহার’-এর জন্য বাধ্যতামূলক বৈশ্বিক নীতি গ্রহণ। এ ক্ষেত্রে ‘ফেজ আউট’ শব্দটি বাধ্যতামূলক এবং সময়সীমাসহ প্রণয়ন করতে হবে। কয়লা, তেল, গ্যাসসহসব জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধের জন্য দেশভিত্তিক রোডম্যাপ প্রয়োজন। কার্বন ক্যাপচার বা অফসেটের মতো সমাধানকে ‘প্রধান সমাধান’ হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না, কেননা এটি বাস্তবে নিঃসরণ কমানোকে বিলম্বিত করে। ধনী দেশগুলোকে তাদের প্রতিশ্রুত ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে অন্তত ২০২৫-এর পর থেকে বছরে ৬০০-৭০০ বিলিয়ন ডলার তহবিলে দিতে হবে। অভিযোজন অর্থায়নকে দ্বিগুণ করতে হবে। সব তহবিল অনুদানভিত্তিক হওয়া উচিত, ঋণ নয়।
লেখক : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম (বিসিসিজেএফ)।
বিকেপি/এমবি

