Logo

মতামত

গণতন্ত্র কেন বারবার আস্থার সংকটে পড়ে

Icon

জাহিদ ইকবাল

প্রকাশ: ২৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:৫৬

গণতন্ত্র কেন বারবার আস্থার সংকটে পড়ে

বাংলাদেশ আবারও একটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মুখোমুখি। এই নির্বাচন কেবল একটি সাংবিধানিক আনুষ্ঠানিকতা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রচিন্তা, রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য নির্ধারণের এক গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। স্বাধীনতার এত বছর পরও যদি আমাদের বলতে হয়— আমরা সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব চাই— তাহলে স্বীকার করতেই হবে, রাষ্ট্র পরিচালনায় কোথাও গভীর ব্যর্থতা রয়ে গেছে। এই ব্যর্থতা শুধু কোনো একটি সরকারের নয়, এটি পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার, এবং সেই সঙ্গে আমাদের সামষ্টিক সিদ্ধান্তহীনতারও প্রতিফলন।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশ বারবার আশা দেখেছে, আবার হতাশ হয়েছে। শাসক বদলেছে, স্লোগান বদলেছে, কিন্তু সাধারণ মানুষের জীবনের মৌলিক সংকটগুলো প্রায় একই রয়ে গেছে। দুর্নীতি, বৈষম্য, জবাবদিহির অভাব এবং ক্ষমতার অপব্যবহার যেন এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্মে উত্তরাধিকারসূত্রে চলে এসেছে। জনগণ প্রত্যাশা করেছে দেশপ্রেমিক, সৎ ও মানবিক নেতৃত্ব; কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ সময়ই পেয়েছে ক্ষমতাকেন্দ্রিক ও আত্মস্বার্থে নিমগ্ন শাসনব্যবস্থা।

এই প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক জুলাই–আগস্টের আন্দোলন ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়। এটি কোনো হঠাৎ ক্ষোভের বিস্ফোরণ ছিল না, বরং দীর্ঘদিনের জমে থাকা হতাশা, বঞ্চনা ও অবিচারের বিরুদ্ধে মানুষের সম্মিলিত উচ্চারণ। রাজপথে নেমেছিল মূলত তরুণ প্রজন্ম— যারা দলীয় পরিচয়ের চেয়ে নিজেদের নাগরিক পরিচয়কে বড় করে দেখেছে। তারা চেয়েছে ভোটাধিকার, ন্যায়বিচার, মর্যাদা এবং একটি জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র। অনেকেই আহত হয়েছে, কেউ কেউ জীবন দিয়েছে। তারা কোনো ক্ষমতার অংশীদার হতে নয়, বরং একটি সুস্থ রাজনৈতিক ব্যবস্থার দাবি তুলতেই রাস্তায় নেমেছিল।

জুলাই–আগস্ট আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, ভোটাধিকার কোনো দয়া নয়, এটি নাগরিকের মৌলিক অধিকার। এই অধিকার যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন মানুষ নীরব থাকে না। ইতিহাস বলে, ভয় দেখিয়ে, প্রভাব খাটিয়ে বা প্রশাসনিক শক্তি ব্যবহার করে ভোট নিয়ন্ত্রণ করা যায় বটে, কিন্তু মানুষের বিশ্বাস দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না। যে রাষ্ট্র নাগরিকের ভোটের মর্যাদা নিশ্চিত করতে পারে না, সে রাষ্ট্র ধীরে ধীরে নৈতিক ভিত্তি হারাতে থাকে।

কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, আন্দোলনের পরও রাজনীতির পুরোনো চেহারা খুব একটা বদলাতে দেখা যায় না। আজও মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় যোগ্যতার চেয়ে অর্থ, প্রভাব এবং দলীয় আনুগত্য বড় হয়ে ওঠে। আজও বিতর্কিত ও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সহজেই রাজনীতির মূল স্রোতে জায়গা পায়। এতে করে সৎ ও মেধাবী মানুষের রাজনীতিতে আসার আগ্রহ কমে যায়, আর রাজনীতি ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।

রাজনীতির এই নৈতিক অবক্ষয়ের সরাসরি প্রভাব পড়ে রাষ্ট্র পরিচালনায়। দুর্নীতি তখন আর ব্যতিক্রম থাকে না, বরং ব্যবস্থার অংশ হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, বিচার— সবখানেই এর ছাপ পড়ে। সাধারণ মানুষকে প্রতিটি সেবার জন্য বাড়তি মূল্য দিতে হয়, কখনো ঘুষে, কখনো অবহেলায়, কখনো দীর্ঘসূত্রতায়। এই পরিস্থিতিতে উন্নয়নের বড় বড় গল্প সাধারণ মানুষের কাছে অর্থহীন শোনায়। কারণ উন্নয়ন যদি মানুষের কষ্ট কমাতে না পারে, বৈষম্য কমাতে না পারে, তাহলে তা কেবল পরিসংখ্যানেই সীমাবদ্ধ থাকে।

জুলাই–আগস্টের আন্দোলনকারীরা আসলে এই ব্যবস্থার পরিবর্তনই চেয়েছিল। তারা সরকার বদলের চেয়ে রাজনীতির চরিত্র বদলের কথা বলেছিল। তারা চেয়েছিল এমন একটি রাষ্ট্র, যেখানে তরুণরা চাকরি পাবে মেধার ভিত্তিতে, যেখানে হাসপাতালে চিকিৎসা পেতে ঘুষ দিতে হবে না, যেখানে বিচার পেতে রাজনৈতিক পরিচয় লাগবে না। এই প্রত্যাশা কোনো অযৌক্তিক স্বপ্ন নয়, এটি একটি সভ্য রাষ্ট্রের ন্যূনতম মানদণ্ড।

এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সিদ্ধান্তই ঠিক করবে, জুলাই–আগস্টের আত্মত্যাগ ইতিহাসে একটি অর্থবহ অধ্যায় হয়ে থাকবে, নাকি আরেকটি উপেক্ষিত স্মৃতি হয়ে যাবে। দলগুলোর উচিত সৎ সাহস দেখিয়ে দুর্নীতিবাজ ও অপরাধীদের রাজনীতি থেকে দূরে রাখা, নতুন ও যোগ্য মানুষকে সামনে আনা এবং দলের ভেতরে গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করা। এগুলো না করলে জনগণের আস্থা ফিরবে না, বরং রাজনীতি আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে সাধারণ মানুষের জীবন থেকে।

একই সঙ্গে জনগণের দায়িত্বও কম নয়। বারবার ভুল সিদ্ধান্তের দায় শুধু রাজনীতিবিদদের ওপর চাপিয়ে দিলে আত্মপ্রবঞ্চনা করা হবে। ভোট মানে শুধু একটি অধিকার নয়, এটি একটি দায়িত্ব। ভুল ভোট মানে পাঁচ বছরের কষ্ট, সঠিক ভোট মানে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ। দলীয় আবেগ, পরিচিত মুখ কিংবা সাময়িক সুবিধার বাইরে গিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে বিচার করার সময় এখনই।

এই নির্বাচন আমাদের জন্য একটি বড় পরীক্ষা। আমরা চাইলে এখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে পারি, আবার চাইলে একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে পারি। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একদিন প্রশ্ন করবেই— তোমরা সুযোগ পেয়েও কী করেছিলে? সেই প্রশ্নের সামনে যেন আমাদের মাথা নিচু করতে না হয়।

জুলাই–আগস্টের বিপ্লবীরা কোনো স্মৃতিস্তম্ভ হতে চায়নি। তারা চেয়েছিল একটি বদলে যাওয়া রাষ্ট্র, একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ। তাদের রক্ত ও ত্যাগের ঋণ শোধ করার একমাত্র পথ হলো সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব নির্বাচন করা, ভোটের মর্যাদা রক্ষা করা এবং রাষ্ট্রকে জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া।

 এই দেশ আমাদের, এই দেশের ভবিষ্যৎও আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল। তাই আসুন, আবেগ নয়, বিবেক দিয়ে সিদ্ধান্ত নিই এবং এমন একটি বাংলাদেশ গড়ি, যেখানে আগামী প্রজন্ম মাথা উঁচু করে বাঁচতে পারে।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সমাজকর্মী।

প্রাসঙ্গিক সংবাদ পড়তে নিচের ট্যাগে ক্লিক করুন

গণতন্ত্র

Logo
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি মোস্তফা কামাল মহীউদ্দীন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন প্রধান, ডিজিটাল সংস্করণ হাসনাত কাদীর