• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

ধানমন্ডি লেক

ইজারা পাচ্ছেন আওয়ামী লীগের সাত নেতা

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১১ জুলাই ২০২১

রাজধানীর ধানমন্ডি লেকের সাতটি শাখার ফুড কোর্ট, রেস্টুরেন্ট, পার্কিং, গণশৌচাগার ইজারা দিচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। গত ২৪ জুন ইজারায় সর্বোচ্চ দরদাতাদের তালিকা করে ডিএসসিসি। ঠিকাদারদের নামের এই তালিকা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, যে সাতজন ঠিকাদার সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন, তারা সবাই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনের নেতা। ইতোমধ্যে দরপত্র প্রায় চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি। শিগগির সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের কার্যাদেশ দেওয়া হবে। এদিকে কার্যাদেশ পাওয়ার আগেই এই সাতজন নিজ নিজ সেক্টর বাগিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। তারা নিজ প্রতিষ্ঠানের নামে টোকেন দিয়ে গণশৌচাগার, পার্কিংয়ে চাঁদা আদায় করছেন বলে স্থানীয়দের অভিযোগ। বিষয়টিকে নেতিবাচকভাবে দেখছেন নগর পরিকল্পনাবিদ এবং স্থানীয় বাসিন্দারা। তারা জানান, সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধানমন্ডি লেক তার সৌন্দর্য হারিয়েছে। আগের ঠিকাদাররা লেকের সৌন্দর্যের চেয়ে নিজেদের ব্যবসার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। এবার যারা ইজারা নিচ্ছেন, তারাও আগের ঠিকাদারদের মতোই বাণিজ্যকে বেশি প্রাধান্য দিলে লেক তার সৌন্দর্য-জৌলুস হারিয়ে ফেলবে। নগর পরিকল্পনাবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ এই নগরে মানুষের নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা কম। বেড়ানোর জায়গা নেই বললেই চলে। তাদের কথা মাথায় রেখেই ধানমন্ডি লেক তৈরি করা হয়েছিল। এখন এই লেকটি বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। লেকটি রক্ষায় নগর প্রশাসনকে আরো তৎপর হতে হবে।’

জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার তথ্য মতে, ‘১৯৫৬ সালে লেকসহ ২৪০ দশমিক ৭৪ হেক্টর জমিতে ধানমন্ডি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়। সমগ্র ধানমন্ডি এলাকার প্রায় ১৬ শতাংশজুড়ে রয়েছে এই লেক। ১৯৯৮-২০০১ সালে ধানমন্ডি লেক এলাকাটি সংস্কার করে বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।’ ধানমন্ডি লেকের ইজারার কাজটি সম্পন্ন করছে ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ। এই বিভাগ সূত্র জানায়, গত ২৪ মার্চ লেকের সাতটি সেক্টর ইজারায় দরপত্র আহ্বান করে ডিএসসিসি। ১৩ এপ্রিল দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়। পরে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্ধারণ করেন ডিএসসিসির সংশ্লিষ্টরা। তবে এক সেক্টরের বিপরীতে একাধিক আবেদন জমা পড়েনি।

ধানমন্ডি ২৭ নম্বর (নতুন ১৬) সড়ক থেকে ধানমন্ডি ৩২ (নতুন ১১) নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত এলাকাটি ১ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে ‘সাম্পান’ নামে একটি ফুড কোর্ট ও আটটি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। এই সেক্টর ইজারায় সরকারি মূল্য চাওয়া হয়েছিল ৩১ লাখ টাকা। পরে ৩০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন ফারভেন্ট ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী জাকির হোসেন স্বপন। তিনি ডিএসসিসির ১৫ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ওই ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর।

সাবেক কাউন্সিলর জাকির হোসেন স্বপন জানান, যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই তিনি ১ নম্বর সেক্টরের ইজারা নিয়েছেন। কার্যাদেশ পেলে ‘সাম্পান’র কার্যক্রম শুরু হবে। পাশাপাশি ওই সেক্টর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নও রাখা হবে।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সেতু থেকে মিরপুর রোডের শেখ রাসেল স্কোয়ার হয়ে শেখ রাসেল শিশু পার্কসহ কলাবাগান মাঠের উত্তর সীমানা পর্যন্ত এলাকাটি ২ নম্বর সেক্টর। এখানে ‘বাজরা’ নামে একটি ফুড কোর্ট, ৩০টি পার্কিংয়ের জায়গা, একটি গণশৌচাগার এবং শেখ রাসেল শিশু পার্ক রয়েছে। এই সেক্টর ইজারায় সরকারি মূল্য চাওয়া হয়েছিল ৩০ লাখ টাকা। ৫০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা হয়েছেন আনিকা ট্রেডিং অ্যান্ড কোম্পানির স্বত্বাধিকারী মোজাম্মেল হক ভূইয়া। তিনি ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর (নতুন ১১) সেতু থেকে ধানমন্ডি ১৬ (নতুন ১২-এ) নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত ৩ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে একটি ফুড কোর্ট, ২০টি ব্যক্তিগত গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা, দুইটি গণশৌচাগার, একটি স্কেটিং ক্লাব রয়েছে। এই সেক্টরের সরকারি মূল্য ছিল ২৪ লাখ টাকা। ২০ হাজার ১০০ টাকা বেশি দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন মেসার্স রাজ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী রাজিবুল ইসলাম। তিনি ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত থাকাবস্থায় রাজিবুল কীভাবে ঠিকাদারিতে জড়িয়ে পড়েন, তা নিয়ে ধানমন্ডিতে আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে।

ধানমন্ডি থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিবুল ইসলাম বলেন, ‘ওই ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের মালিক আমি নই। আমি ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মোজাম্মেল হক ভূইয়ার কাছ থেকে ওই সেক্টর ভাড়া নিয়েছি।’

ধানমন্ডি ১৬ নম্বর সড়কের (নতুন ১২-এ) লেকের পশ্চিম দিকের সংযুক্ত সড়ক থেকে ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের সেতু পর্যন্ত ৪ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে ‘ডিঙ্গি’ নামে একটি ফুড কোর্ট রয়েছে। এছাড়া একটি ওয়াটার বোর্ড ও ছয়টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। এই সেক্টর ইজারায় ডিএসসিসির সরকারি মূল্য ছিল ৬০ লাখ টাকা। মাত্র ১০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে ইজারার জন্য মনোনীত হয়েছেন গুডউইল এনার্জি লিমিটেডের চেয়ারম্যান তাপস দেবনাথ। তবে তাপস দেবনাথের নাম ব্যবহার করে ডিএসসিসির সংরক্ষিত-৭ নম্বর ওয়ার্ডের (সাধারণ ওয়ার্ড-১৪, ১৫ ও ১৮) নারী কাউন্সিলর শিরিন গাফ্ফারই মূলত এই সেক্টর ইজারা নিয়েছেন। জানতে চাইলে শিরিন গাফ্ফার জানান, ব্যবসায়িক সুবিধার্থে তিনি তাপস দেবনাথের নামে এই সেক্টরের ইজারা নিয়েছেন।

৫ নম্বর সেক্টরে ‘পানসি’ নামে একটি রেস্টুরেন্টসহ ২০টি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। ধানমন্ডি ৮ নম্বর সেতু থেকে কলাবাগান বাসস্ট্যান্ডের পেছনের প্রকল্প এলাকা পর্যন্ত এই সেক্টর। এটি ইজারায় ৩১ লাখ টাকা সরকারি মূল্য ছিল। ১০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে সর্বোচ্চ দরদাতা নির্বাচিত হয়েছেন ইন্টারট্রেড জেনারেল ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী কামাল আহমেদ দুলাল। তিনি ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামাল আহমেদ দুলাল বলেন, ‘যথাযথ নিয়মেই এই সেক্টর ইজারা নিয়েছি।’

ধানমন্ডি ৮ নম্বর সেতু থেকে ধানমন্ডি ৬ নম্বর সড়কের লেকের পূর্বঅংশ পর্যন্ত লেকের ৬ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরে ‘তরী’ নামে একটি ফুড কোর্ট, একটি গণশৌচাগার, ১২টি গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা রয়েছে। এই সেক্টরটি ইজারায় ১২ লাখ টাকা সরকারি মূল্য নির্ধারণ করেছিল ডিএসসিসি। পরে মাত্র ১০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে ইজারাদার নির্বাচিত হয়েছেন কে অ্যান্ড পি ইন্টারন্যাশনালের স্বত্বাধিকারী মজিবুল হক খোকন। তিনি ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের নেতা হিসেবে পরিচিত। গত ২৪ জুন তার প্রতিষ্ঠানের টোকেন দিয়ে পার্কিং থেকে চাঁদা আদায় করতে দেখা গেছে।

ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের সেতু থেকে সাত মসজিদ সড়কের দুইটি অংশ তথা সুগন্ধা কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীত পাশ পর্যন্ত এবং বিজিবি ফটক থেকে বিপরীত পাশ পর্যন্ত এলাকাটি ৭ নম্বর সেক্টর। এই সেক্টরের আয়তন অন্যান্য সেক্টর থেকে অনেক বড়। এখানে পাঁচটি ফুড ভ্যান, দুইটি ফুড কোর্ট, ৩২টি পার্কিংয়ের জায়গা ও একটি গণশৌচাগার রয়েছে। এই সেক্টর ইজারায় সরকারি মূল্য ছিল এক কোটি ২০ লাখ টাকা। এক লাখ টাকা বেশি দিয়ে এই সেক্টরের ইজারা নেন ফার আর ট্রিডিংয়ের স্বত্বাধিকারী ও ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক গোলাম রাব্বানি হিরু।

ডিএসসিসির প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন, ‘স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় ধানমন্ডি লেকের দরপত্রের কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। সর্বোচ্চ দরদাতারাই লেকের ইজারা পাবেন। তাদের কার্যাদেশ দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে। যারা লেকের ইজারা পাবেন তারাই নিজ নিজ সেক্টর সীমানা এলাকায় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত এবং অবকাঠামো ও স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণ করবেন। কার্যাদেশে এমন শর্তই উল্লেখ থাকবে।’

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads