• বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪২৮

মহানগর

কেমিক্যালের ঝাঁঝালো গন্ধে ক্ষুব্ধ পুরান ঢাকাবাসী

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ৩১ আগস্ট ২০২১

বিষাক্ত কেমিক্যাল ও প্রাণঘাতী রাসায়নিক ঝাঁঝালো গন্ধ মিডফোর্ড হাসপাতাল ও আশপাশের বাতাস। এর মধ্যেই বসবাস করছে লাখো মানুষ। হাসপাতালটির  মূল গেটেই মিডফোর্ড রোডে দুই পাশেই গড়ে উঠেছে বিশাল কেমিক্যাল নগরী। দোকান ও গোডাউনগুলোতে প্রতিনিয়ত বিষাক্ত কেমিক্যাল আনা-নেয়াসহ চলছে বেচাকেনার মহাউৎসব। ফলে স্থানীয় বেশ কয়েকটি হাসপাতালের চিকিৎসাধীন রোগী, বেশ কয়েটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোমলমতি শিশু ও স্থানীয় বাসিন্দারা রয়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার আশংকায়।

গত ৫ বছরে এই এলাকায় ছোট-বড় মিলিয়ে ৪০টিরও বেশি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এর মধ্যে সর্বশেষ এপ্রিলের অগ্নিকাণ্ডে ২ জন শিশু মারা যায়।

কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা জরিনা বেগম দুই বছরের শিশু মাছুমকে ভর্তি করেছেন মির্ডফোড হাসপাতালে শিশু ওয়ার্ডে। তিনি বলেন, প্রচণ্ড শ্বাসকষ্টের কারণে তাকে ভর্তি করেছি । কিন্তু এখানে এসে শ্বাসকষ্ট মনে হচ্ছে বেড়ে গেছে। কারণ হাসপাতালগুলো রয়েছে কেমিক্যাল মার্কেট ঘিরে। কেমিক্যালে ঝাঁঝালো গন্ধে এলাকায় থাকা কষ্টের । জানি না স্থানীয়রা কিভাবে বাস করেন। জানা যায়, মিটফোর্ড রোডে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালটি ছাড়া এই এলাকায় রয়েছে ছোট-বড় আরো দশটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। যেখানে মহানগর, ন্যাশনাল, সুমনা, মেডিলাইক, মুনলাইট ও শ্রমজীবী হাসপাতাল রয়েছে। শুধু মাত্র মিটফোর্ড হাসপাতালে রোগী ভর্তি থাকে প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার। যেখানে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রয়েছে এক হাজার থেকে দেড় হাজার রোগী। অন্যান্য হাসপাতালগুলোতেও রয়েছে কয়েক হাজার রোগী। এসব রোগীরা প্রতিনিয়ত এই কেমিক্যাল নগরীর বিষাক্ত বাতাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে।

এছাড়া এলাকায় রয়েছে আটটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার মধ্যে আহমেদ বাওয়ানী স্কুল এন্ড কলেজ, আহাম্মাদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, আরমানিটোলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, নিউ গর্ভেমেন্ট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়, আনন্দময়ী উচ্চ বিদ্যালয়। এসকল স্কুলে অধ্যায়নরত কোমলমতী শিক্ষার্থী রয়েছে অর্ধলক্ষ। কেমিক্যাল প্রভাবে প্রতিনিয়ত স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ আক্রান্ত হচ্ছে বিভিন্ন ব্যাধিতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষক বলেন, আবাসিক এলাকার মধ্যে কেমিক্যাল গোডাউন স্বাস্থ্যর জন্য অত্যান্ত ক্ষতিকর। কেমিক্যাল নীরব ঘাতক, বিশেষ করে শিশুদের এসব পরিবেশে বেড়ে উঠা ক্ষতিকর।

এখানেই শেষ নয় মুনলাইট হাসপাতাল ও মেডিলাইক হাসপাতালটির নিচের দুইটির তলায় রয়েছে কেমিক্যালের দোকান ও গোডাউন। প্রতিরাতে কেমিক্যাল মার্কেট ও আবাসিক ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল লোড-আনলোডিং হয়ে থাকে।

স্থানীয় আরমানী টোলার বাসিন্দা আব্দুস সালাম বলেন, কেমিক্যালের সঙ্গে আমাদের বসবাস। আমার বাসার নিচতলা ছাড়াও প্রত্যেকটি বাড়িতে রয়েছে দোকান, গোডাউন, ফ্যাক্টরি। কেমিক্যালের গ্যাস অত্যন্ত ঝাঁঝালো। বিশেষ করে আমাদের শিশু বাচ্চাদের শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়।

জানা যায়, এসব কেমিক্যাল গোডাউনে রয়েছে, গ্লিসারিন, সোডিয়াম ,অ্যানহাইড্রোস. সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন, পার অক্সাইড, মিহাইল, ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল, এসিডসহ ভয়ঙ্কর কেমিক্যাল ও রাসায়নিক পদার্থ। এসব কেমিক্যাল স্বাস্থ্যর জন্য হুমকিস্বরুপ। এছাড়া সামান্য আগুনের স্পর্শে ঘটতে পারে মারাত্মক দুর্ঘটনা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) এক গবেষণায় দেখা যায় পুরান ঢাকায় পঁচিশ হাজার কেমিক্যাল গোডাউন রয়েছে। এদের মধ্যে পনেরো হাজার রয়েছে বাসাবাড়িতে যেখানে  মাত্র আড়াই হাজার গোডাউনের অনুমোদন রয়েছে। বাইশ হাজারেরও অধিক কেমিক্যাল গোডাউন অবৈধ।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, কেমিক্যাল স্বাস্থ্যর জন্য যেমনি ক্ষতিকর তেমনি বিপজ্জনক। নিমতলীর অগ্নিকাণ্ড স্মরণকালের ভয়াবহতম ঘটনা। এই ঘটনার পরেও পুরান ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডজনিত প্রাণহানির ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের উদ্যেগে ফায়ার সার্ভিসসহ পাঁচটি সংস্থা কর্তৃক ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল গোডাউনের তালিকা তৈরিপূর্বক উচ্ছেদ অভিযান শুরু করলেও এখন পযর্ন্ত জোরালো উচ্ছেদ করতে পারেনি। ফলে  পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল মার্কেট ও গোডাউন সরিয়ে না নেওয়ায় চাপা ক্ষোভ রয়েছে স্থানীয়দের মধ্যে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, পুরান ঢাকার এসব কেমিক্যাল মার্কেট ও গোডাউন স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য রীতিমতো হুমকি। এই এলাকার রাস্তাগুলো অত্যন্ত সরু ও ঘিঞ্জিময়। অগ্নিকাণ্ডে এসব এলাকায় কাজ করাও কঠিন। সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযানই হতে পারে সমাধান। তিনি আরো বলেন, এ এলাকায় যত অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তার সবগুলোর জন্যই দায়ী এ কেমিক্যাল গোডাউন।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রধান নির্বাহী ফরিদ আহাম্মদ সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের অবৈধ কেমিক্যাল গোডাউনের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে। সুন্দর  নগরী গড়ে তোলাই আমাদের মূললক্ষ্য। ফায়ার সার্ভিস ও বিভিন্ন সংস্থাকে মিটফোর্ড এলাকা ও পুরান ঢাকার কেমিক্যাল গোডাউনের নতুন তালিকা করার জন্য বলা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে জোরালোভাবে উচ্ছেদ  অভিযানের মাধ্যেমে কেমিক্যালমুক্ত পুরান ঢাকা ঘোষণা করবো।

পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আশরাফ উদ্দিন বলেন, আমরা প্রায়ই এসকল এলাকায় অভিযান পরিচালনা করি। সম্প্রতি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে এসকল এলাকার কেমিক্যাল গোডাউন-ই দায়ী । অভিযান আরো জোরদার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে গত ৫ বছরে এ এলাকায় ছোটবড় মিলিয়ে প্রায় ৪০টি অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানান। এরমধ্যে গত এপ্রিলে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। এ ঘটনায় ২ জন মারা যায়। এর মধ্যে একজন শিশুও ছিল।

স্থানীয়রা বলছেন, অগ্নিকাণ্ড ঘটলে তারপরের কয়েকদিন অভিযান চলে। কিন্তু এরপর আবারো আগের মতো থেকে যায়। বিষাক্ত ও প্রাণঘাতী কেমিক্যালের গোডাউন সরাতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা চান স্থানীয় বাসিন্দারা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads