• বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪২৯
রাজধানীতে গতি কমছে যানবাহনের

সংগৃহীত ছবি

মহানগর

রাজধানীতে গতি কমছে যানবাহনের

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২১

রাজধানীতে দিন দিন তীব্র হচ্ছে যানজট পরিস্থিতি। ফলে কমছে যানবাহন চলাচলের গতি। যানজটে দীর্ঘ সময় আটকে থাকায় অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও বাড়ছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ বড় বড় উদ্যোগ নিলেও বিশেষজ্ঞদের মতে, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। 

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের ‘নগর পরিস্থিতি-২০১৬ : ঢাকা মহানগরে যানজট, শাসনব্যবস্থার পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, ২০০৪ সালে ঢাকার রাস্তায় প্রতি ঘণ্টায় গাড়ির গতিসীমা গড়ে ছিল ২১ দশমিক ২ কিলোমিটার। ২০০৯ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৮ কিলোমিটারে এসে দাঁড়ায়। যানবাহনের পরিমাণ যদি একই হারে বাড়তে থাকে এবং নিরসনের কোনো উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ২০২৫ সালে এই শহরে যানবাহনের গতি হবে ঘণ্টায় চার কিলোমিটার, যা মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কম। উল্লেখ্য মানুষের হাঁটার গতি ঘণ্টায় গড়ে ৫ কিলোমিটার।

এদিকে রাজধানীর সড়কে সারা বছর ধরে লেগে থাকা যানজট সমস্যার সমাধান খোঁজার লক্ষ্যে আগামী দুই মাসের মধ্যে একটি জরিপ শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এআরআই) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ (ডিএমপি) এই জরিপ পরিচালনা করবে।

জানা যায়, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এবং ঢাকা সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা অতীতে এরকম বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও রাজধানীর যানজট নিরসনের সমাধান খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে।

এপ্রসঙ্গে এআরআই-এর পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান জানান, জরিপ কোনো সমাধান নয়। তবে রাজধানীর যানজট সমস্যা কীভাবে মোকাবিলা করা যায় তা খুঁজে বের করার জন্য এটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। সড়কে কি পরিমাণ ব্যক্তিগত গাড়ি, গণপরিবহন এবং অটোরিকশা চলাচলের সক্ষমতা রয়েছে সে সম্পর্কে ধারণা ছাড়া যানজট সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া অসম্ভব বলে জানান তিনি।

অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান আরো বলেন, সিঙ্গাপুর এবং ব্যাংককের মতো অনেক শহরে ৮ থেকে ১২% সড়ক নেটওয়ার্ক কভারেজ আছে, কিন্তু তাদের পরিবহনব্যবস্থা তুলনামূলক মসৃণভাবে চলে। ঢাকায় ৮% সড়ক নেটওয়ার্ক কভারেজ আছে, কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনার ফলে এখানে প্রচণ্ড পরিমাণে যানজট সৃষ্টি হয়।

এআরআই-এর পরিচালক বলেন, জরিপের বিস্তারিত পরিকল্পনাসহ প্রস্তাবটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হবে। আর ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমান জানিয়েছেন, এআরআই কর্তৃক বিস্তারিত পরিকল্পনা চূড়ান্ত হওয়ার পর দুই মাসের মধ্যেই ঢাকায় এই জরিপটি শুরু হবে।

যানজটের কারণে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে বলে উঠে এসেছে বিভিন্ন প্রতিবেদনে। ২০১৭ সালের বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় যানজট প্রতিদিন প্রায় ৩.২ মিলিয়ন কর্মঘণ্টা নষ্ট হয় এবং ভিড়ের সময় গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৭ কিলোমিটার।

যানজট নিয়ে বেসরকারি পর্যায়ের আরকেটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ঢাকায় যানজটের কারণে পিক আওয়ারে গণপরিবহনের গতিবেগ ঘণ্টায় ৫ কিলোমিটারে নেমে এসেছে, যেখানে হেঁটে চলার গড় গতিও ৫ কিলোমিটার। ফলে প্রতিদিন ৫০ লাখ কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে। ১২ বছর আগেও এই গতি ছিল ঘণ্টায় ২১ কিলোমিটার।

২০১১ সালে রাজধানীতে যানজটের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) জানায়, ক্ষতির পরিমাণ বছরে ২০ হাজার কোটি টাকা। ২০১২ সালে যানজটের আর্থিক ক্ষতি নিরূপণ করে ইউএনডিপি। তাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩১ হাজার কোটি টাকার মতো। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ বিনিয়োগ বোর্ড (বিওআই) জানায়,  রাজধানীতে যানজটের কারণে বছরে অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে প্রায় এক লাখ কোটি টাকার, যা মোট জিডিপির ৭ শতাংশের সমান।

সর্বশেষ ২০১৮ সালে ‘ঢাকা মহানগরীর যানজট : আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছিল বাংলাদেশ এআরআই। ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, যানজটের কারণে ২০ হাজার থেকে ৫৫ হাজার কোটি টাকার বার্ষিক ক্ষতি হচ্ছে। এ থেকে বলা যায়, যানজটের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ বছরে গড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা। তবে সড়ক খাতে বিনিয়োগ, যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ ও যানজট নিরসনে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে এই ক্ষতি অন্তত ৬০ শতাংশ, বা ২২ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করা যেত বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, করোনার কারণে পরিস্থিতি এখন বুঝার উপায় নেই। অনেক কিছু বন্ধ ছিল। আর পরিস্থিতি ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই। পরিস্থিতি উন্নতি করার জন্য বাস সিস্টেম উন্নত করা, পথচারী সিস্টেম ইমপ্রুভ করা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থা ইমপ্রুভ করার কথা ছিল, সেটিও হয়নি। সুতরাং, অবস্থা ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই। তিনি আরো বলেন, আমাদের দৈনিক যে কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়, সেখান থেকেই এই আর্থিক ক্ষতির হিসাবটা এসেছে। একজন মানুষ প্রতিঘণ্টায় ন্যূনতম যে আয় করেন, সেই হারের সঙ্গে কর্মঘণ্টার হিসাব করে যে অঙ্কটি পাওয়া যায়, সেটি হচ্ছে এই ৩৭ হাজার কোটি টাকা আর্থিক ক্ষতি।

তবে এই আর্থিক ক্ষতি পৃথিবীর কোনো দেশ শতভাগ পুষিয়ে নিতে পারবে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, শহর থাকবে, মানুষ থাকবে, জ্যাম কিছু পরিমাণ থাকবেই। তবে এটাকে কত শতাংশ কমানো সম্ভব সেটাই বিষয়। পরিস্থিতি উন্নতি করতে দেশে ২২ হাজার কোটি টাকার মেট্রোরেল হচ্ছে, কিন্তু সেটা তো এখনও চালু হয়নি। আরএটি হচ্ছে ১০টি উপায়ের একটি, বাকি যে ৯টি উপায় আছে, সেগুলোর ক্ষেত্রেও কিছু বিনিয়োগের প্রয়োজন আছে। সেটা করা হয়নি এবং সেখানে অল্প টাকার বিনিয়োগ। ট্রাফিক সিস্টেম ও বাস ম্যানেজমেন্ট এগুলোতে কিন্তু অল্প টাকার বিনিয়োগ। ১-২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের বাস সিস্টেমে কাজ করা অত্যন্ত জরুরি। সেখানে হাত দেওয়া হয়নি এখনো।

-

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads