• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯
ফের বাড়ছে মশার দাপট

সংগৃহীত ছবি

মহানগর

ফের বাড়ছে মশার দাপট

  • ফেরদৌস মামুন
  • প্রকাশিত ০৯ মার্চ ২০২২

শীতের আমেজ কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন আগে। ধীরে ধীরে বাড়ছে গরমের তীব্রতা। সেইসাথে রাজধানীজুড়ে বাড়ছে মশার উপদ্রব। দিনের আলো যতো কমে মশার দাপট ততো বাড়ে। ঘরে-বাইরে, অফিস-আদালতে, বস্তি থেকে অভিজাত এলাকা, সবখানেই মশার আক্রমণ। এতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে নগরজীবন। বিশেষ করে গত এক সপ্তাহে মশার দাপটে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে রাজধানীবাসী।

রাজধানীর এ মশা নির্মূলে দায়িত্ব দুই সিটি করপোরেশনের। মশার দাপটে মানুষ অতিষ্ঠ হলেও তারা বলছে, মশা নিধনে চলছে নিয়মিত কার্যক্রম। কীটনাশকও মজুত আছে যথেষ্ট পরিমাণে। তবে এখনো শুরু হয়নি কোনো সাঁড়াশি অভিযান। আর দুটি সিটির স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দাবি, এখন পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণে আছে মশার সমস্যা।

অথচ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা জানানো হয়, গত বছরের ডিসেম্বর ও চলতি বছরের জানুয়ারির তুলনায় ফেব্রুয়ারিতে মশার ঘনত্ব বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। কীটতত্ত্ববিদরাও বলছেন, গত বছরের তুলনায় এবার মশার প্রকোপ বেশি। রাজধানীর সব এলাকায় মশার ব্যাপক  বিস্তার ঘটছে। সিটি করপোরেশন যেভাবে কার্যক্রম চালাচ্ছে তাতে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। তা না হলে এ মাসের শেষ দিকে মশার ঘনত্ব বেড়ে চরমে পৌঁছাবে। পরিস্থিতিও হতে পারে ২০১৯ সালের চিকনগুনিয়ার মতো।

ডিসেম্বর থেকে মার্চ মাস পযন্ত কিউলেক্স মশার প্রজনন মৌসুম। তাই প্রতি বছরের এ সময় মশার আধিক্য দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সিটি করপোরেশন মশার বিস্তার বেড়ে যাওয়ার দায় এড়াতে পারে না। সময়মতো কার্যকরী ওষুধ না ছিটানোয় মশা বেড়েছে। পাশাপাশি তারা যেসব ওষুধ দিচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ তারা যে ওষুধ ছিটায়, তাতে মশা নিধন হয় না; বরং বায়ুদূষণ হয়। মশককর্মীরা ওষুধ ছিটাতে অনীহা দেখান।

বিশেষজ্ঞরা জানান, বর্তমানে যেসব মশার কামড়ে নগরবাসী অতিষ্ঠ তার ৯৯ ভাগ কিউলেক্স মশা। আর মশার খাবার হিসেবে ব্যবহূত হয় ড্রেন, নর্দমার পচা পানি। যখন শীতের পরে তাপমাত্রা বাড়ে, মশার জীবচক্রের গতিশীলতা বেড়ে যায়। এই সময়ে মশা ডিম বেশি পাড়ে। পূর্ণাঙ্গ মশা এবং লার্ভা দমনে জরুরিভিত্তিতে ক্রাশ প্রোগ্রাম প্রয়োজন। পাশাপাশি নর্দমা ও খালা পরিষ্কার ও বাসাবাড়ির আশপাশে ওষুধ ছিটাতে হবে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, রাজধানীর চারপাশে নিচু অঞ্চলে মশার ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি। এসব অঞ্চলে নালা-নর্দমায় পচা পানিতে মশার বিস্তার বেশি হচ্ছে। বর্ষা না হওয়ায় ডেঙ্গুর প্রকোপ না থাকলেও কিউলেক্স মশার ঘনত্ব  বেশি। চলতি মাসে মশার দাপট আরো হবে।

তিনি বলেন, উপযুক্ত তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতার সঙ্গে পানিতে অর্গানিক মেটারের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে মশার ঘনত্ব বাড়ছে। মশা দমনে যেসব ড্রেন, নর্দমায় পচা পানি আছে তা পরিষ্কার করে ওষুধ ছিটাতে হবে। সাতদিন পর পর লার্ভিসাইডিং করলে মশার প্রকোপ কমে আসবে। দুই সিটি করপোরেশন এখনই পদক্ষেপ না নিলে দ্রুত মশা বাড়বে চারগুণ।

রাজধানীর আদাবরে থাকেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রহিম আব্বস। এই এলাকার আশপাশে রয়েছে কয়েকটি ডোবা-নালা। সেটি মশার প্রজননক্ষেত্র। ফলে বিকেল থেকেই শুরু হয় মশার উপদ্রব। তিনি বলেন, প্রায় ১৫ দিন ধরে মশার সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতে বাড়ে উপদ্রব। বাসার পাশে ডোবা-নালা পরিষ্কার না করার কারণে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে।

একই অবস্থা মিরপুর এলাকার,  সেখানকার বাসিন্দা আলাউদ্দিন মিয়া বলেন, জানালা খুলতে গেলে মশা ঢুকে যায়। কয়েকদিনের মধ্যে হুট করে মশার উপদ্রব বেড়েছে। সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় যন্ত্রণা। এই এলাকায় কীটনাশক ছিটাতে দেখা যায় না। যেখানে সেখানে ময়লা পড়ে থাকে।

মগবাজারের ব্যবসায়ী শরিফ আহমেদ জানান, গত কয়েকদিনে মশার কামড়ে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। দিনরাত কামড়াচ্ছে মশা। দরজা জানালা আটকেও নিস্তার মিলছে না। সব সময় বাসায় মশারি টানিয়ে রাখতে হয়। বিশেষ করে শিশুদের নিয়ে বিপাকে অভিভাবকেরা। কারণ শিশুদের বাসায় আটকে রাখা যায় না। বাসায় থাকলেও সারাক্ষণ হাত-পায়ে মশার কামড়ে চিৎকার  চেঁচামেচি করেন। বাইরেও একই অবস্থা। কোথাও দাঁড়ানো বা বসা যায় না।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা সারওয়ার জানালেন, যে পরিমাণ কীটনাশক মজুত আছে তা সাত-আট মাস চলবে। এ কীটনাশক শেষ হওয়ার আগেই আবার মজুত করা হবে।  তার মতে, এ মৌসুমে পানি কমে যায়। তাই পানির ঘনত্ব বেড়ে নোংরা হয় বেশি। কিউলেক্স মশা নোংরা পানিতে জন্মে। তাই এই সময় থেকে কিউলেক্স মশা বাড়ে। তিনি মনে করেন, গতবারের তুলনায় মশা এবার সহনশীল পর্যায়ে এবং অনেক কম।

এ কর্মকর্তা আরো জানান, কচুরিপানার যেখানে থাকে সেখানে কিউলেক্স মশা জন্মায়। রাজধানীর লেকে এখন আর আগের মতো কচুরিপানা নেই। কিছু লেকে অল্প পরিমাণে আছে। আমরা এবার জোর দিয়েছি লেক পরিষ্কারে। পাশাপাশি প্রতিদিন মশা নিধন কার্যক্রম চলছে। তার মতে, মশা নির্মূল সম্ভব না। তবে চেষ্টা করছি মশাকে সহনীয় পর্যায়ে রাখতে।

জানা গেছে, সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটিতে কিউলেক্স মশার মোট ৯২৫টি হটস্পট শনাক্ত করা হয়। এর মধ্যে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ সাঁতারকুল। এরপর রয়েছে মিরপুর। ডিএনসিসির ১০টি অঞ্চলে মশা নির্মূলে নিয়মিত কর্মীর সংখ্যা ৫৫০। পাশাপাশি আরো কিছু অনিয়মিত কর্মীসহ মোট মশককর্মী হিসেবে কাজ করছেন প্রায় একহাজার কর্মী।

অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও মনে করে রাজধানীর মশা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। সংস্থাটির ভারপ্রাপ্ত প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ফজলে শামসুল কবির বলেন, এ মৌসুমে কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে ছিল, এখনো আছে। যদি কোথাও মশা বাড়ে সেখানকার কর্মকর্তা ও সুপারভাইজার জরুরি ব্যবস্থা নিবেন।

তিনি জানালেন, মশা নিধনে সকালে লার্ভিসাইট করা হয়। বিকেলে অ্যাডাল্টিসাইট করা হয়। এ ছাড়া মশা যেসব জায়গায় জন্মায়; খাল, বিল, ডোবা, নালা, জলাশয় এসব স্থান নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। পাশাপাশি বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের জন্য জলাশয় পরিষ্কার করে মাছ, ব্যাঙ ছাড়ছি, যাতে মশার লার্ভা খেয়ে ফেলে। পুরো বছরের জন্য দুই ধরনের কীটনাশকই মজুত আছে। কীটনাশকের কোনো সমস্যা নেই। বর্তমানে উত্তর সিটির প্রতি ওয়ার্ডে ১৪ জন করে ৭৫টি ওয়ার্ডে মোট ১ হাজার ৫০ জন কর্মী লার্ভিসাইডিং, এডাল্টিসাইডিং ও সমন্বয় কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।

সর্বশেষ অর্থবছরে মশক নিধনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন প্রায় আট কোটি টাকা কমিয়ে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখে। তার আগের অর্থবছরে ৪৩ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। আর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সর্বশেষ অর্থ বছরের বাজেটে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০ কোটি টাকা। যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৮ কোটি টাকা।

এরআগে গত বৃহস্পতিবার সারা দেশে ডেঙ্গু ও মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সিটি করপোরেশন, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দপ্তর ও সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। সেখানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস জানান, দীর্ঘ মেয়াদে কীটনাশক ব্যবহার করা শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এজন্য ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে কদম গাছ লাগানোকে গুরুত্ব দেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads