• শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪২৯

মহানগর

ফাঁকা ঢাকায় সতর্ক পুলিশ

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০২২

প্রতি বছরই লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছেড়ে গ্রামে যান আপনজনের সাথে ঈদ আনন্দ উদ্যাপন করতে। এ সময় রাজধানীর রাজপথসহ ফাঁকা হয়ে যায় অধিকাংশ পাড়া-মহল্লা। এই সুযোগটি নেয় দুর্বৃত্তরা। ফাঁকা বাসা-বাড়িতে ঘটে চুরির ঘটনা। ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া হয়ে উঠে ছিনতাইকারী। তাই ঈদের ছুটিতে রাজধানীর নিরাপত্তায় টহলসহ গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একইসাথে বাসা-বাড়ির নিরাপত্তায় রাজধানীবাসীকে বাড়তি সতর্কতা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ।

যদিও ঈদের ছুটিতে রাজধানীতে চুরি-ডাকাতি সুনিদিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান নেই পুলিশের কাছে। তারা মাসওয়ারি পরিসংখ্যান রাখলেও বিশেষ উৎসবের সময়ের কোনো পরিসংখ্যান সংরক্ষণ করেন না। তবে গত দুই বছরের সংবাদপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বছরের প্রথম চার মাসের তুলনায় ঢাকায় মে ও জুলাই মাসে বাসাবাড়িতে চুরি, ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের ঘটনায় তুলনামূলক বেশি মামলা বা সাধারণ ডায়রি দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে নগরবাসীকে ঈদের ছুটিতে নিজেদের নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলাম। সম্প্রতি নগরবাসীকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছেন, ঈদের সময় রাজধানী ফাঁকা থাকায় বাসাবাড়িতে চুরি ডাকাতি বেড়ে যায়। ফলে নগরবাসী যেন গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার আগে মূল্যবান জিনিসপত্র, স্বর্ণালঙ্কার আত্মীয়-স্বজনের বাসায় রেখে যান। সেরকম কোনো স্বজন না থাকলে প্রয়োজনে নিকটস্থ থানায় জমা রাখার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, নাগরিকদের সবরকমের নিরাপত্তা দেয়ার দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। একজন নাগরিককে তার মূল্যবান সম্পদের নিরাপত্তার জন্য অন্য কোথাও সরিয়ে রাখতে হবে, সেটা কোনো যুক্তি হতে পারে না।

তবে নাগরিকদেরও সতর্ক থাকতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবশ্যই তার পূর্ণাঙ্গ নিরাপত্তা দিতে হবে। সেখানে তাদের দাায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নেই। আমি মনে করি, এটা পারস্পরিক একটা বিষয়। এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নাগরিক- উভয়ে মিলেই সতর্কতা এবং প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। ডিএমপি’র মুখপাত্র উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলছেন, ছুটিতে বাসাবাড়ি ফাঁকা থাকলে অপরাধীরা সেই সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করে। যেহেতু ঈদের মতো বড় উৎসবে অনেকে গ্রামের বাড়িতে যান, এই সুযোগে চোররা ফাঁকা বাসায় চুরি করার চেষ্টা করতে পারে। এই সময় অতিরিক্ত সতর্কতা, প্রহরার ব্যবস্থা করি। সব থানাকে বাড়তি টহল দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু তারপরেও ঢাকা শহরের সব বাড়িঘর তো তো আর সবসময় পাহারা দিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই নাগরিকের কাছেও আমরা অনুরোধ করি, তারাও যেন নিজেরা সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।

পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, কয়েকটি নির্দিষ্ট গ্রুপই ঘুরেফিরে এ ধরনের চুরি ডাকাতিতে জড়িত থাকে। পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রতিবছর ঈদ বা বড় ছুটির সময় অনেক বাসা ফাঁকা হয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে চোররা আগে থেকে রেকি করে এসব বাসা চিহ্নিত করে। বিশেষ করে দোতলা বা তিনতলার বাসাগুলো টার্গেট করা হয় বেশি। তদন্তে দেখা গেছে, অনেক সময় বাড়ির নিরাপত্তা কর্মীরাও এসব চক্রের সঙ্গে যোগসাজশ করে থাকে। তবে অনেক ক্ষেত্রে বড় ধরনের চুরি না হলে ভুক্তভোগীরা থানায় মামলা করতে চান না। ফলে পুলিশও এসব ক্ষেত্রে কড়া ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী হয় না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান বলছেন, চুরি-ডাকাতির অপরাধগুলো কিন্তু জামিন যোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ এই অপরাধীরা গ্রেপ্তার হলেও তারা পরবর্তীতে আবার জামিনে বেরিয়ে এসে অপরাধ শুরু করে। কিন্তু আমাদের দেশে সমস্যা হলো, একবার অপরাধীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানোর পর আর তাদের ওপর নজরদারি বা ফলোআপ করা হয় না। ফলে সেই অপরাধী ঘুরেফিরে আবার অপরাধ করে, বারবার অপরাধ করার সুযোগ পেয়ে যায়। এ কারণে ক্রাইমটা পুরোপুরি বন্ধ হয় না। অধ্যাপক ফারজানা রহমান আরো বলেন, বাংলাদেশে জনসংখ্যার তুলনায় এখনো পুলিশের সংখ্যা কম। এক্ষেত্রে অপরাধ দমনে কমিউনিটি পুলিশিং গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজের নানা পেশার মানুষজনকে নিয়ে কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা তৈরি হলে, তারাই নিজেদের চারপাশের এলাকায় নজরদারির ব্যবস্থা করবেন। ফলে অপরাধীরা কোনো অপরাধ ঘটানোর সাহস পাবে না। সেখানে প্রয়োজনে নিয়মিত পুলিশ সদস্যরা তাদের সহায়তা করবেন। তিনি বলেন, এই ফোরামগুলোকে যদি স্ট্রং করতে পারি, তাহলে কিন্তু অনেকাংশেই অপরাধ কমে আসবে। তবে এসব ফোরামে সব শ্রেণি-পেশার মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে। সেখানে কোনো অপরাধের আভাস পেলেই তারা নিয়মিত পুলিশের সহায়তায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে।

জানা যায়, প্রতি বছরের মতো এবারও ঈদে ফাঁকা রাজধানীর নিরাপত্তায় অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হবে, বাড়ানো হবে চেকপোস্ট ও টহল। রাজধানীর নিরাপত্তায় ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে র‍্যাব ও পুলিশ। গুরুত্বপূর্ণ সরকারি স্থাপনাসহ সব জায়গায় বাড়ানো হবে গোয়েন্দা নজরদারি। গুলশান ও বারিধারার সব দূতাবাস এবং সংলগ্ন সড়কে থাকবে বাড়তি গোয়েন্দা নজরদারি।

প্রতিবছরের মতো এবারও রাজধানীর ঈদের জামাতকে ঘিরে নেয়া হবে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ঈদের ছুটিতে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড প্রতিরোধের লক্ষ্যে রাজধানীতে মোবাইল প্যাট্রোল, ফুট প্যাট্রোল ও চেকপোস্ট বসিয়ে নিরাপত্তা বলয় তৈরি করবে পুলিশ ও র্যাব। শহরের বাসাবাড়ি ফাঁকা পেয়ে চুরি-ডাকাতি যাতে বেড়ে না যায় তার জন্য নগর পুলিশের সবকটি ইউনিটকে প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রেও পোশাকে টহল পুলিশের পাশাপাশি সাদা পোশাকে পুলিশ মোতায়েন রেখে নগরের প্রতিটি এলাকায় নজরদারি বাড়ানোর জন্য নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

এদিকে ঈদের ছুটিতে বাসাবাড়ির নিরাপত্তার জন্য পুলিশের পক্ষ থেকে নাগরিকদের কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বাসা/অফিসে ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা ব্যবহার করা, বাসা/ফ্ল্যাটের মেইন গেটে অটো লক ব্যবহার করা, বাসা/বাড়ি ত্যাগের আগে রুমের দরজা-জানালা সঠিকভাবে তালাবন্ধ করা। যেসব দরজা-জানালা দুর্বল অবস্থায় আছে তা মেরামত করে যথাসম্ভব সুরক্ষিত করা। প্রয়োজনে একাধিক তালা ব্যবহার করা। রাতে বাসার চারপাশ আলোকিত রাখা। সিসিটিভিসহ অন্যান্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা সক্রিয় থাকার বিষয়টি নিয়মিত নিশ্চিত করুন

দরজায় নিরাপত্তা অ্যালার্মযুক্ত তালা ব্যবহার করা। মূল্যবান সামগ্রী ও দলিল নিরাপদ হেফাজতে রাখা এবং তালাবন্ধ করা। প্রয়োজনে ব্যাংক লকারের সহায়তা নেয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন তারা। এছাড়া বাসাবাড়ি ত্যাগের পূর্বে যে সমস্ত প্রতিবেশী/পাশের ফ্ল্যাটের অধিবাসী ঢাকায় অবস্থান করবেন তাদেরকে আপনার বাসার প্রতি লক্ষ্য রাখতে অনুরোধ করুন এবং ফোনে তাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন । ভাড়াটিয়াদের আগেই বাসার মালিককে ঈদ উপলক্ষে বাসা ত্যাগের বিষয়টি অবহিত করা। মহল্লা ও বাড়ির সামনে সন্দেহজনক কাউকে/দুষ্কৃতিকারীকে ঘোরাফেরা করতে দেখলে স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ি ও থানাকে অবহিত করা। ঈদে মহল্লা/বাসায় কোন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে থাকলে বা ঘটার সম্ভাবনা থাকলে তা স্থানীয় কমিউনিটি পুলিশ/থানা/ফাঁড়িকে অবহিত করা। বাসার গাড়ির গ্যারেজ সুরক্ষিত করা। বাসার জানালা/দরজার পাশে কোন গাছ থাকলে শাখা-প্রশাখা কেটে ফেলা, যাতে অপরাধীরা শাখা-প্রশাখা ব্যবহার করে বাসায় প্রবেশ করতে না পারে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স এর উপ-কমিশনার মো. ফারুক হোসেন বলেছেন, ঈদ উপলক্ষে রাজধানীর সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ডিএমপির পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা রয়েছে। সকল বিষয় মাথায় রেখে পুলিশের সকল ইউনিটের সদস্য সবখানে কঠোর নজরদারি রাখবে।

শুধু রাজধানীতেই নয় এবারের ঈদে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমনাবন্দরের নিরাপত্তাও নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। বিমানবন্দরটির নিরাপত্তায় অন্যান্য বাহিনীর পাশাপাশি থাকছে ৯ শতাধিক এপিবিএন সদস্য। প্রতিবারের মতো এবারও গুরুত্বপূর্ণ এই স্থাপনাকে ঘিরে বিশেষ পরিকল্পনাও নিয়েছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশের কর্মকর্তারা। ঈদের ছুটিকে ঘিরে কোনোভাবেই যেন নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হয় সে বিষয়টিকে মাথায় রেখে নেয়া হয়েছে নিরাপত্তা পরিকল্পনা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালে বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় মানুষের আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি সদস্যই সততা, নিষ্ঠা আর দায়িত্বশীলতা সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বিমানবন্দরের শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে। বন্ধ হয়েছে ছুরি, ছিনতাই। এমনকি হারিয়ে যাওয়া লাগেজও ফিরে পাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এছাড়াও বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান রোধেও কার্যকরী ভূমিকা রাখছে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ।

আর এই কারণে প্রতিবারের মতো এবারের ঈদেও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা হাতে নেয়া হয়েছে। ঈদের আগে যেমন নিরাপত্তা ছিল ঈদের দিন বা যে কদিন সরকারি ছুটি থাকবে সেই সময়টাতেও একই রকম নিরাপত্তা ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। ঈদের ছুটির কারণে নিরাপত্তা ঢিলেঢালার কোনো সুযোগ থাকবে না।

এদিকে, বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জিয়াউল হক পলাশ বলেন, আমাদের এখানকার যা জনবল তার ২০ শতাংশ ছুটি দেয়া হয়েছে। সেই হিসেবে প্রায় ৯ শতাধিক সদস্য দায়িত্ব পালন করবেন। সহকারী পুলিশ সুপার মর্যাদার কর্মকর্তারা তিন শিফটে আর সদস্যরা ৪ শিফটে দায়িত্ব পালন করে যাবেন। তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী এক ঈদে ছুটি কাটালে অন্য ঈদ অফিসে করতে হয়। কিন্তু আমরা সেই অনুপাতে ছুটি দিতে পারি না। এখানে জনবল সমস্যা রয়েছে। তারপরও আমরা সবাই যেন ঈদ উৎসব করতে পারে সেই ব্যবস্থা করে থাকি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ঈদের কারণে ছুটি থাকবে সেই হিসেবে এখানকার নিরাপত্তার কোনো ব্যাঘাত ঘটবে এমন হবে না। ঈদের আগেও যেমন ছিল ঈদের সময়ও একই রকম থাকবে। বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় কোনো ধরনের ব্যত্যয় ঘটবে না। বিমানবন্দর আর্মড পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, ঈদের মধ্যে প্রত্যেক সদস্যের জন্য উন্নত খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads