• বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪২৯
ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রাজধানী!

সংগৃহীত ছবি

মহানগর

ডেঙ্গুর উচ্চ ঝুঁকিতে রাজধানী!

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২২

বছরের শুরুতে মন্ত্রী ও দুই মেয়রের হাঁকডাকেও সামলানো যায়নি রাজধানীতে ডেঙ্গুর বিস্তার। মহানগরীর সব এলাকাতেই ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা। একই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। চলতি বছরে ১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৬ হাজার ৩৫৭ জন। তাদের মধ্যে মারা গেছেন ২২ জন। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রাজধানীতে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করা দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছে।

এর আগে গত ১৯ জুন সচিবালয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম ‘ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত কার্যক্রমের পর্যালোচনা এবং ডেঙ্গু ও অন্যান্য মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধ’ বিষয়ক এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা বলেছিলেন, এ বছর ডেঙ্গু সামলাতে আমরা প্রস্তুত। ডেঙ্গুর বিষয়ে ফেব্রুয়ারি-মার্চ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়। এবারো সেটি করা হয়েছে। আমাদের সব প্রস্তুতি উভয় মেয়র নিয়ে রেখেছেন। যেসব কীটনাশক, ওষুধ, যন্ত্রপাতি দরকার তা তাদের কাছে মজুত আছে।

এরপর ২০ জুন ডেঙ্গুবিরোধী সচেতনতামূলক প্রচার অভিযানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, ডেঙ্গুর প্রকোপ নির্মূলে অন্যন্যা বছরে তুলনায় এ বছর একটু বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। মশার প্রজননক্ষেত্র সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করতে নিয়মিত আমাদের কার্যক্রম চলমান। তাই আশাকরা যায় এ বছর এডিস মশা নির্মূল করা সম্ভব হবে।

অন্যদিকে ২০ জুলাই নিউমার্কেট-গাউসিয়া ফুটওভার ব্রিজ পরিদর্শন শেষে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, নগরীতে এখন পর্যন্ত এডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে আছে। এ ধারাবাহিকা ধরে রাখতে, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে এবং ডেঙ্গু রোগের বিস্তার রোধে, নগর ভবনে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে সরেজমিন সরাসরি তদারকি করা হচ্ছে।

তবে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ নিয়ে স্থানীয় সরকারমন্ত্রীসহ ঢাকার দুই মেয়রের পূর্বের হাঁকডাক কাজে আসেনি। বরং আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম নিয়মিত ডেঙ্গুবিষয়ক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বছরের শুরুর দিকে রাজধানীতে ডেঙ্গু কিছুটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। গত তিন মাস ধরে তা বেড়েই চলেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বর্ষাকালীন জরিপ বলছে, ঢাকা উত্তরের ১৩টি এবং দক্ষিণের ১৪টি ওয়ার্ড রয়েছে ডেঙ্গুর উচ্চমাত্রার ঝুঁকিতে। নগরের ১৩ শতাংশ বাড়িতে আছে এডিসের লার্ভা। বর্ষার আগে করা জরিপের চেয়ে এ সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। আর লার্ভার বেশির ভাগই মিলেছে গৃহস্থালি পণ্য আর নির্মাণাধীন ভবনে। সেক্ষেত্রে সচেতনতা বাড়ানোর পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়ার তাগিদ বিশেষজ্ঞদের।

নগরে এডিস মশার ঘনত্ব নির্ণয়ে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুম, এর আগে ও পরে তিন দফা জরিপ করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতি বছর বর্ষায় আগস্টে জরিপ করে কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি)। এ দফায় ঢাকার দুই সিটির ৯৮টি ওয়ার্ডে উত্তরে ১ হাজার ৩১৯টি বাড়িতে অভিযানে লার্ভা মিলেছে ১৭৭টি বাড়িতে। আর দক্ষিণে ১ হাজার ৮৩০টি বাড়িতে ২১৫টি বাড়িতে মিলেছে লার্ভার উপস্থিতি। ৩ হাজার ১৪৯টি বাড়িতে হয়েছে জরিপের কাজ। সে হিসাবে রাজধানীর ১৩ শতাংশ বাড়িতেই মিলেছে এডিসের লার্ভা। তারা বলছেন, যেসব জায়গায় লার্ভা মিলেছে, তার বেশির ভাগই বাড়ির ভেতর আর নির্মাণাধীন ভবনে।

জরিপে উঠে এসেছে গৃহস্থালি কাজে শেষে ফেলে দেওয়া কাপ-বাটি, চিপস কিংবা বিস্কিটের খোসা, ডাবের খোসা, ফুলের টব, পানি ধরে রাখার পাত্র, চৌবাচ্চা ইত্যাদি। পাশাপাশি নির্মাণাধীন ভবন এমনকি মেঝেতে জমে থাকা পানিতেও মিলেছে এডিসের লার্ভা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এডিসবাহী রোগ নির্ণয় কর্মসূচির ডিপিএম ডা. মো. ইকরামুল হক বলেন, বেশির ভাগ বিল্ডিংয়ের নিচে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। ওই পানির ভেতরে ৪০-৫০ হাজার মশা জন্ম নেয়। এক বাড়িতে এত মশা জন্ম নিলে পুরো কমিউনিটিকে কামড়ানোর জন্য যথেষ্ট।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে আগস্ট মাসে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৫২১ জন। মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। এর আগে জুনে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৫৭১। মারা যান একজন। জুলাই মাসে সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ জনে। তারপরও দুই সিটি করপোরেশনের সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, গত কয়েক বছরের তুলনায় চলতি বছরে তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে অনেকটাই সফল।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) উপ-প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লে. কর্নেল গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, আমরা সকাল-বিকেল মশা নিধনে কাজ করে যাচ্ছি। ওষুধ ছিঁটানোর পাশাপাশি ডোবা-নালাও পরিষ্কার করে যাচ্ছি। আমাদের কাজে গতি বাড়ানো হয়েছে। এর সুফলও মিলছে। মশা নিয়ন্ত্রণে গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আমরা অনেকটাই সফল। গত বছরও আগস্ট মাসে ডেঙ্গু রোগী ছিল প্রায় ৮ হাজার। এ বছর সংখ্যাটা সাড়ে ৩ হাজারের মতো। এতে বোঝা যায় আমরা এডিস মশা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি। তাছাড়া গত বছর ডেঙ্গু বিষয়ে আমাদের ব্যাপক প্রচারের কারণে মানুষের মাঝেও সচেতনতা বেড়েছে। তারাও নিজ নিজ বাসাবাড়ি পরিষ্কার-পরিছন্ন রাখছেন।

ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মো. জোবায়দুর রহমান বলেন, ড্রোনের মাধ্যমে আমরা ম্যাপিং করেছি। সেই সঙ্গে যেসব ছাদ-বাগানে পানি পাওয়া গেছে, তাদের ডেকে সতর্ক করা হয়েছে। তবে সচেতনতা বাড়লেও তা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় এসে পৌঁছায়নি। সেক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগের পাশাপাশি এ বিষয়টি নিয়ে আরো কাজ করার কথা ভাবা হচ্ছে।

ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে ছামসুল কবির বলেন, মশা নিধনে আমাদের নিয়মিত কর্মতৎপরতা আছে। আমরা সকালে লার্ভিসাইড ও বিকেলে ফগিং কার্যক্রম চালাচ্ছি। মশা নিধনে দক্ষিণ সিটিতে ১ হাজার ৫০ কর্মী নিয়োজিত আছেন। মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত উপকরণও আছে। গত বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটাই কম।

তিনি বলেন, ছাদবাগান ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বড় চ্যালেঞ্জ। ছাদবাগানে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সব ভবনের ছাদে যাওয়া আমাদের কর্মীদের পক্ষে সম্ভব নয়। বাড়ির মালিকদের সহযোগিতা পেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আমরা অনেকটাই এগিয়ে যাব।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, স্বল্পমেয়াদে এমন পদক্ষেপ কাজে দিলেও দীর্ঘমেয়াদে দরকার কীটতাত্ত্বিক সমাধান। জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধ্যাপক বেনজির আহমদ বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কীটতাত্ত্বিক যে সক্ষমতা, সেটা সারা দেশে বাড়াতে হবে। সেখানে অনেক গবেষককে নিতে হবে। প্রত্যেক জেলা থেকে পৌরসভা পর্যন্ত এ কার্যক্রম বাড়াতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads