বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২৪ নভেম্বর ২০১৮

গুন্টার গ্রাস

মানববন্দনাই ছিল যার রচনার শেষকথা


অংশগ্রহণ করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে। অকপটে স্বীকারও করেছিলেন সেকথা। মানুষ সীমাবদ্ধতাকে কটাক্ষ করেছিলেন বামন বলে। তবু মানুষের প্রতি তার ছিল গভীর মমত্ববোধ। ব্যঙ্গকবিতা রচনার রাজাধিরাজ ছিলেন তিনি। সবমিলিয়ে সমকালের এক মহান জার্মান লেখক ছিলেন গুন্টার গ্রাস।

জন্ম যদিও পশ্চিমে, তবু প্রাচ্য তাকে টেনেছিল গভীরভাবে। দেখেছিলেন দুই অসম পৃথিবীর দ্বৈরথ, যেখানে পশ্চিমের কেন্দ্রিকতার ধারণা আর স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের পৃথিবীটাকে বিষময় করে তুলছে। এ কারণেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে তীব্র বিবমিষা থেকে নিপীড়কদের জিভ দেখিয়েছিলেন তিনি। জিভ, জবান আর জনতন্ত্রকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গ্রাসের রচনাসমগ্র। সমকালীন পৃথিবীর প্রতি জিভ দিয়ে এভাবে ভেংচিকাটা তারই সাজে যিনি মানবায়নের ভাষ্য রচনায় আমৃত্যু নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু এই ভাষ্য যে কত বিচিত্র ধারায় প্রকাশিত আর প্রবাহিত হতে পারে, গ্রাসই তার অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন। কেননা শুধু কথাশিল্পী নন, তিনি ছিলেন কবি, চিত্রকর, ভাস্কর, স্টেজ ডিজাইনার, চিত্রনাট্যকার, নাট্যকার, জ্যাজ সঙ্গীতশিল্পী আর রাজনৈতিক বক্তা ও ভাষ্যকার। রাজনীতি আর শিল্পের সীমানাকে ঘুচিয়ে দিয়ে নান্দনিকতার নতুন কাঠামো দাঁড় করেছিলেন গ্রাস। লক্ষ্য ছিল, শিল্পসাহিত্যের প্রতিটি প্রান্তকে ছুঁয়ে-ছেনে জীবনকে দেখা।

টিন ড্রামের (১৯৫৮) সুবাদে গ্রাস ঔপন্যাসিক হিসেবেই সমাদৃত হয়েছেন, পরে জুটেছে নোবেল পুরস্কারও। টিন ড্রামের পিঠাপিঠি ‘বিড়াল ও ইঁদুর’ (১৯৬১) আর ‘কুকুরবছরগুলি’ (১৯৬৩) মিলিয়েই সৃষ্টি করেছেন দানজিগ ট্রিয়োলজি। গ্রাসের উত্থান তাই বেশ চমকপ্রদ। ততদিনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে গেছে। জার্মানি জুড়ে চলছে পরাজিত জনজাতির শূন্যপ্রহর। কিন্তু বৌদ্ধিক জাগৃতি তো থেমে থাকে না। অস্ত্রের ভাষাকে পাশ কাটিয়ে নিজেদের বিবেকী প্রবর্তনায় একদল লেখক গড়ে তুললেন ‘সাতচল্লিশ গোষ্ঠী’ (গ্রপ্পে ৪৭)। সময়ের সাহসী রূপকারদের অন্যতম প্রবক্তা হয়ে উঠলেন গ্রাস। পঞ্চাশের দশকেই জার্মানিতে একটা সঙ্কট দেখা দেয়, গণমাধ্যমের কাছে লেখকরা প্রান্তিক হতে থাকেন। সাতচল্লিশ গোষ্ঠী লেখকদের বুদ্ধিজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিল। সমকালের প্রখ্যাত জার্মান কবি হান্স মাগনুস এৎসেন্সবার্গার লেখকদের এই আত্মপ্রতিষ্ঠাকে উল্লেখ করেছেন ‘সচেতনতা সৃষ্টির কারখানা’ বলে।

গত শতকের ষাটের দশক থেকে রাজনৈতিক এই অভিপ্রায় থেকেই ওই ট্রিয়োলজির পর লিখলেন, ‘শামুকের দিনপঞ্জি থেকে’ (১৯৭৭), ‘তেলগেতে সাক্ষাৎ’ (১৯৭৯) শীর্ষক কয়েকটি উপন্যাস। এই উপন্যাসগুলোতেই রাজনীতি ও শিল্প পরম্পরিত হয়ে গড়ে তুলেছে গ্রাসের কথনবিশ্ব। বিশেষ করে প্রথম বইটি জীবজগতের প্রতি তার সহমর্মিতার নিদর্শন হয়ে আছে। আগে যে জীবজন্তুকে তিনি কিছুটা নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছিলেন তাই দুর্মর মমত্ববোধে সিক্ত হতে থাকে। এরপর তার এই ভাবনা ‘রাঘব বোয়াল’ (১৯৭৭) এবং ‘ইঁদুর’ (১৯৮৭) উপন্যাস অব্দি প্রসারিত হয়েছে। শিল্প ও জীবনের মেলবন্ধনকেই এরপর থেকে সারাজীবন আরাধ্য ভেবেছেন এই জার্মান লেখক।

শুধু শিল্পের সঙ্গে জীবন নয়, শিল্পের সঙ্গে শিল্পেরও যে সংযোগ আছে, এবং তা যে অনেক গভীর, একই রচনায় নানা মাধ্যমের বিমিশ্রণ ঘটিয়ে তিনি তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। উপন্যাসের মধ্যে কবিতার ব্যবহার অনেকটাই বেমানান। কিন্তু গ্রাস সেই সীমাও ভেঙে দিয়েছেন। উপন্যাস, তাতে জড়িয়ে গেছে ইতিহাস, রন্ধনপ্রণালির তথ্য অথবা লিরিক কবিতা। গ্রাস নিজেই বলেছেন, শুধু এরকম টুকরো কিছু অনুষঙ্গ নয়, ড্রইং, সংলাপ, উদ্ধৃতি, ভাষণ, চিঠিপত্তর এসবও অবলীলায় ব্যবহার করেছেন তিনি। একটি মাত্র মাধ্যম নয়, যেমন শুধু নয় ড্রইং আর শব্দ — এই দুই-ই হচ্ছে তার রচনার প্রাথমিক উপকরণ। শিল্পের মধ্যে একটা মাধ্যমের সঙ্গে আরেকটা মাধ্যমের এরকম দেওয়া-নেওয়ার সম্পর্ক থাকা জরুরি। যত দিন গেছে, এই ভাবনা গ্রাসকে আরো অভিভূত করেছে। ‘জিভ দেখানো’ (১৯৮৮) নামের উপন্যাসটি, কলকাতার পটভূমিতে যেটি লেখা, ড্রইং  প্রবলভাবে চেপে বসেছে। ড্রইং ছাড়া বইটি লেখা ছিল তার কাছে অকল্পনীয় ব্যাপার। কলকাতার নিদারুণ দারিদ্র্য, ভাষা দিয়ে অর্থাৎ শুধু শব্দ দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব হতো না বলে মনে করেছেন গ্রাস। ড্রইং আর শব্দ- একে অন্যের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে। গ্রাসের লেখার ভঙ্গি শুধু নয়, পদ্ধতিটিই ছিল একেবারে আলাদা। শিল্পনিষ্ঠার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন তিনি। কলকাতাকে নরকতুল্য মনে করতেন তিনি, কিন্তু মানবিকতার টানে চলে এসেছেন। সেই সুবাদে ঢাকাতেও এসেছিলেন তিনি। উদ্দেশ্য সেই একই। তৃতীয় বিশ্বের মানুষজনদের কাছে থেকে দেখা। গ্রাস মনে করতেন, কলকাতা বা ঢাকায় আলিশান বিল্ডিংয়ের পাশে যেসব বস্তি গড়ে উঠেছে সেসব মূলত আগ্রাসী পুঁজিবাদী অর্থনীতির অসম বিন্যাস আর সঙ্কটেরই ফল। পুঁজিবাদী দেশগুলো নগ্নভাবেই তাদের সঙ্কটকে এভাবেই ছড়িয়ে দিয়েছে তৃতীয় বিশ্বে। কলকাতার বাস্তবতাকে ধরবার জন্যে গদ্য বা পদ্য এককভাবে যথেষ্ট মনে হয়নি গ্রাসের। পদ্যের সাহায্যেই গদ্যকে খুঁজে পেয়েছেন। কিন্তু এই রচনা, অর্থাৎ ‘জিভ দেখানো’ উপন্যাসে ড্রইং, গদ্য এবং কবিতা ভিন্ন ভিন্নভাবে ব্যবহার করে ভিন্ন ভিন্ন দ্যোতনা সঞ্চারিত করেছেন। গ্রাসের উপন্যাস বা নন-ফিকশনের ভাষিক বুনট তাই বিচিত্র হয়েও লক্ষ্যচ্যুত হয়নি।

কবিতা, পরিশেষে কবিতা তাই গ্রাসের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ শিল্পমাধ্যম বলে বিবেচিত হয়েছে। মানুষের জন্যে তার যত ভালোবাসা, তীব্র অনুভব, সবই এসেছে কবিতার হাত ধরে। উপন্যাসের জন্মও হয় কবিতা দিয়ে। নিজেই বলেছেন, ‘আমি বলব না যে কবিতাই সব, কিন্তু এভাবে ছাড়া, কোনো উপন্যাসই আমার শুরু করা হয় না। কবিতাই হচ্ছে আমার সূচনাবিন্দু।’ কবি হিসেবেও গ্রাস তুলনাহীন। তার কবিতার বিষয়আশয়ও অভিনব। বলার ভঙ্গিটিও শুধু যে নিজস্ব তা-ই নয়, হেন বিষয় নেই যে তিনি কবিতা করে তুলতে পারেন না। সবচেয়ে অবাক লাগে একটা ব্যাপার লক্ষ করে, তার কাছে, যেসব বস্তুকে তিনি কবিতার মধ্যে নিয়ে আসেন, সবই ভীষণ জীবন্ত লাগে।  অর্থাৎ বস্তুজগৎটাই তার কাছে চলিষ্ণু, প্রাণবন্ত; অনেকটাই মানবায়িত। মানবসত্তার মতোই বস্তুবিশ্বেরও বুঝি ভিন্ন সত্তা আছে। দু-একটা পিক্ত তুলে দিই : ‘নিজের থলিটায় জেগে উঠল বাতাস।/ফুঁ দিয়ে সব বাগান থেকে টিউলিপ আর সুকুমারীদের দিল তাড়িয়ে’: ‘আমার ঘরটা হাওয়া-চুপ,/ধর্মনিষ্ঠ, একটা সিগারেট,/এতই ধর্মভীরু যে কারোরই সাহস হয় না/ভাড়া বাড়ায়।’

গ্রাসই তো বলেছিলেন, ছবি জোগান দেয় কবিতার শব্দ, আবার শব্দও সরবরাহ করে ছবি। শিল্পের এই পরস্পরিত যুগলবন্দি দেখা যাবে একটা কবিতার বইতে, বইটার নাম ‘অপড়ুয়াদের জন্য হূত রত্নোদ্ধার’ (১৯৯৭)। নিজের কবিতা নিজের ছবি— পরিপূরক আর পরম্পরিত, একে অন্যের সঙ্গে জড়িয়ে লেখা-আঁকা। কবিতার পাশেই একজোড়া জুতোর ছবি, এঁকেছেন গ্রাস। আঁকা জুতোজোড়া পুরো ক্যানভাস বা স্পেস জুড়ে আছে, আকারে তা-ই বড় দেখায়। জমাট গাঢ় রঙে আঁকা বলে জুতোজোড়ার জান্তব, স্পষ্ট, সর্বব্যাপ্ত অস্ত্তিত্ব পাঠকের অনুভূতিকে জুতোর সেই কর্মকাণ্ড, যে প্রেমিকার দিকেই ধাবিত হয়, সেই অনুভূতিকে জীবন্ত করে তুলেছে। গ্রাসের সব কবিতাই উপন্যাসের মতো মানবীয় এবং জীবজন্তুর নানা অনুষঙ্গে ও মমত্ববোধে উজ্জ্বল।

আগেই বলেছি, রাজনীতি তার রচনার কেন্দ্র। কিন্তু কোনো দলীয়তা নয়, মানবমুখিতাই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। ফলে নাৎসিদের ইহুদিনিধন আর হলোকাস্টের বীভৎসতার যেমন প্রতিবাদ করেছেন, তেমনি ইসরাইলের দ্বারা ফিলিস্তিনি নিধনের বিরুদ্ধেও ঝলছে উঠেছে তার কলম। পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে পূর্ব জার্মানিকে জুড়ে দেওয়ারও কঠোর সমালোচক ছিলেন তিনি। গ্রাস ভেবেছেন, এভাবে জুড়ে দেওয়ার ফলে পূর্ব জার্মানির নিজস্ব সংস্কৃতি ও জীবনযাপন রীতিকে পশ্চিম জার্মানির ছাঁচে ফেলে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে। মানবীয় অভিজ্ঞানের এই যে নির্মোহ, অনপেক্ষ বিভাব, গ্রাস ছাড়া আর কারো কাছেই আমরা, বহির্বিশ্বের মানুষেরা প্রত্যাশা করিনি। যথার্থ অর্থেই তিনি ছিলেন বিশ্বপথিক, বিশ্বলেখক। মানবিকতাই ছিল যার রচনা ও জীবনের শেষকথা। 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১