বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বাঙালির মুক্তি সনদ, ছয় দফা ও বঙ্গবন্ধু


পাকিস্তানের সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরের সর্বদলীয় কনফারেন্সের সাবজেক্ট কমিটির সভায় শেখ মুজিব সর্বপ্রথম ৬ দফার দাবিনামা ঘোষণা করেন। রাজনীতির সঙ্গে জড়িত মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফাকে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রথম পাঠ বলে স্বীকার করেন। ৬ দফার হাত ধরে স্বাধীন বাংলাদেশের ভিত্তিভূমি গড়ে উঠেছিল এবং পরবর্তীকালে তারই সফল পরিণতি হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুর ওপর নেমে আসে অত্যাচার, জুলুম ও নির্যাতন।

৬ দফার প্রথম দফায় বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশন হিসেবে গড়তে হবে। সব নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে এবং আইনসভাগুলোর সার্বভৌমত্ব থাকবে। দ্বিতীয় দফায় প্রস্তাব করা হয়েছে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ারে কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এ দুটি বিষয় থাকবে। অবশিষ্ট সব বিষয় স্টেসগুলোর হাতে থাকবে। তৃতীয় দফায় মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। এ ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সি কেন্দ্রের হাতে থাকবে না। সেটি আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে। দ্বিতীয়টি হলো দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকতে হবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হতে না পারে। এই বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। এ ছাড়াও দুই অঞ্চলে দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। চতুর্থ দফায় প্রস্তাব করা হয়েছে, সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকবে না।

আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভেনিউর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে আপনা থেকেই জমা হয়ে যাবে। এই মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকগুলোর ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকবে। এভাবেই জমাকৃত টাকা ফেডারেল সরকারের তহবিলে থাকবে। পঞ্চম দফায় বৈদেশিক ব্যাপারে দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব থাকবে। পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে। ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা দুই অঞ্চল থেকে সমানভাবে আদায় করতে হবে। দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রফতানি চলবে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রফতানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে। সর্বশেষ ষষ্ঠ দফায় পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি বাহিনী গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা অচিরেই ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করতে দেখে তৎকালীন আইয়ুব সরকার প্রমাদ গুনলেন। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ একটি আপত্তিজনক বক্তৃতা দিয়েছেন- এই অজুহাতে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার প্রতিরক্ষা আইনে শেখ মুজিবকে ৮ মে গ্রেফতার করেন এবং ১৯৬৭ সালের এপ্রিল মাসে অপরাধী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড প্রদান করেন। ১৯৬৬ সালের ৮ মে থেকে ১৯৬৯-এর ২২ ফেব্রুয়ারি অর্থাৎ একটানা ৩৩ মাস কারাবন্দি ছিলেন শেখ মুজিব। বঙ্গবন্ধুর ১৪ বছরের কারাজীবনে এটাই ছিল দীর্ঘ কারাবাস।

৬ দফাকে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের একটি মহৎ সিদ্ধান্ত হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তারই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ দফাকে একজন বিশুদ্ধ রাজনীতিকের দেশপ্রেম, সততা, বিশ্বাস আর সুদূরপ্রসারী ধ্যান-ধারণার প্রতিচ্ছবি হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। ছাত্ররা ৬ দফাকে ১১ দফায় অন্তর্ভুক্ত করে আন্দোলনে নামেন। মওলানা ভাসানীও সেই আন্দোলনে পূর্ণ সমর্থন দেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে আইয়ুব খান বিদায় নেন।

১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সব রাজবন্দির মুক্তির পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিলাভ করেন। অতঃপর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ১০ লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতিতে মুক্ত মানব শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান করা হয়।

৬ দফা দাবি ক্রমে ক্রমে বাঙালি জাতির মুক্তির সনদে রূপান্তরিত হয়ে ওঠে। ১ মার্চ ১৯৭১ পাকিস্তানের সামরিক সরকার জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্বনির্ধারিত জাতীয় পরিষদ সভা স্থগিত করলে বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। ৬ দফার দাবি পরিণত হয় ১ দফার দাবিতে। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বঙ্গবন্ধু অসীম সাহসের সঙ্গে অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষের শ্রেষ্ঠ কবিতা শোনালেন- ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

ইতিহাসবিদরা ঐতিহাসিক ৬ দফাকে বাংলাদেশ সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। ঐতিহাসিক ৬ দফার বীজমন্ত্রের ভেতরই লুকিয়ে ছিল বাঙালির সত্তা ও স্বাধীনতা। বাঙালির আত্মমর্যাদার গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। শেখ মুজিব সারা জীবন যে রাজনীতি লালন করেছেন, তার মধ্যে ঐতিহাসিক ৬ দফা ছিল অন্যতম। ৬ দফার হাত ধরেই স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ।

৬ দফার স্বপ্নদ্রষ্টা, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তির পথপ্রদর্শক। প্রতিটি বাঙালির হূদয়ের মণিকোঠায় তিনি চিরকাল ভাস্বর হয়ে থাকবেন।

 

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা

লববিষৎিরঃবৎ৫৩—মসধরষ.পড়স

 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১