বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৭ এপ্রিল ২০১৯

উৎকণ্ঠায় হাওরের কৃষক


নতুন বাংলা সনে নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠার প্রস্তুতি নিচ্ছে হাওরাঞ্চলের মানুষ। নবান্ন উৎসব মূলত হেমন্তের প্রধান পার্বণ হলেও দেশের হাওরখ্যাত সাতটি জেলা বাঙালির চিরায়ত অনুষঙ্গ বৈশাখের প্রথম দিনটিতেই নব অন্ন আস্বাদন কিংবা ফসল ঘরে তোলার অভিষেকে শামিল হয়। কিন্তু দুর্যোগে ঘনঘটা হাওরাঞ্চল দুশ্চিন্তার দুরূহ যন্ত্রণায় ভুগতে শুরু করেছে। সদ্য পর্দা ভেদ করে বের হওয়া ধান শীষের সবুজ গাঢ় হাওর সোনালি রঙ ধারণের মাতলামিতে দোল খেলেও ঝড়-বজ্র-শিলা বৃষ্টি হাওর এলাকায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও হতাশার জন্ম দিয়ে যাচ্ছে। ধানপাকা প্রখর রোদের বিপরীতে বজ্রশিলা-ঝড়ঝাপটার আতঙ্কিত পরিবেশ হাওরপারের কৃষককে দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।

বৈশাখ শুরু হওয়ার আগেই হবিগঞ্জের হাওরে দেখা দিয়েছে অকাল বন্যা। খবরে বলা হয়, গত দুই বছর এখানকার কৃষক সারা বছরের পরিশ্রমের ফসল ঘরে তুলতে পারেননি। এর মধ্যে এ বছর দেখা দিয়েছে আরো বড় বিপত্তি। কৃষকরা বলছেন, গত কয়েক দিন বৃষ্টিতে বিভিন্ন নদ-নদীর পানি বেড়ে চলেছে। কোথাও কোথাও ছোট ছোট বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। কৃষকদের তথ্যমতে, বানিয়াচং, নবীগঞ্জ ও আজমিরীগঞ্জ উপজেলার প্রায় কয়েক শ একর জমির কাঁচা ও আধাপাকা ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। আরো কয়েক হাজার একর জমির ধান গলা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই সেগুলো তলিয়ে যেতে পারে। [সূত্র : সমকাল, ১০.০৪.২০১৯]

হাওরপারের কৃষককে সুবিধা পাইয়ে দিতে সরকার ধান ও চালের যা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তাতেও শুভঙ্করের ফাঁকি থেকে যায়। এর মধ্যে রয়েছে ফড়িয়াবাজ চক্রের যন্ত্রণা। ফড়িয়াবাজরা বিভিন্নভাবে ধান কেনার মাধ্যমে কৃষকদের যেমন সরকারের নির্ধারিত মূল্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করছে তেমনি ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে অল্প দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন দেনাগ্রস্ত কৃষক। এ অবস্থায় সরকারের দেওয়া সুবিধায় কৃষক যতটা না উপকারভোগী হচ্ছে তার দ্বিগুণ ফায়দা লুটছে ফড়িয়াবাজসহ অন্য সুবিধাবাদীরা। এতে কৃষক সব ক্ষেত্রেই প্রতারিত হচ্ছেন। দিনরাত খাটুনি খেটে ও প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে কৃষক অবশেষে প্রাপ্যহীন সেই ভাগ্য বিড়ম্বিত বৃত্তে আটকা পড়ছেন। এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারছেন না কৃষক।

কৃষকদের নিয়ে অ্যাকশনএইড ও খাদ্য নিরাপত্তা নেটওয়ার্ক পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, ৮৩ শতাংশের বেশি কৃষকের আয় পরিবারের চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। এ কারণে ৬৫ শতাংশেরও বেশি কৃষক নানা সময় অন্য পেশায় চলে যেতে চায়। জরিপের তথ্য বলছে, ৬৫.৪৮ শতাংশ কৃষক কৃষিকাজ করলেও বিভিন্ন সময়ে অন্য পেশায় চলে যাওয়ার চেষ্টা করে। অনেক সময় অন্য পেশায় গিয়ে কিছু কাজও করে। কারণ কৃষিকাজ থেকে যে পরিমাণ আয় আসে, তা তার পারিবারিক চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। ৮৯৯ জন কৃষকের ওপর এই জরিপ পরিচালিত হয়েছে। এসব কৃষকের মধ্যে ৮৩.১৫ শতাংশই বলেছে তাদের খামারের আয় পারিবারিক চাহিদার তুলনায় যথেষ্ট নয়। জরিপের ফল বলছে, ৮৯৯ জন কৃষকের মধ্যে ১৯৩ জন কৃষকের ক্ষেতখামার থেকে মাসিক আয় মাত্র এক হাজার টাকা। ১০৫ জনের আয় এক হাজার এক থেকে চার হাজার টাকা, ১৫৫ জনের চার হাজার এক থেকে সাত হাজার টাকা, ১৫৪ জনের সাত হাজার এক থেকে ১০ হাজার টাকা, ৮০ জনের ১০ হাজার এক থেকে ২০ হাজার টাকা, ২১ জনের ২০ হাজার এক থেকে ৪০ হাজার টাকা এবং ২২ জন কৃষকের মাসিক আয় ৪০ হাজার টাকার বেশি। অর্থাৎ ৬০৭ জনের মাসিক আয় ১০ হাজার টাকার নিচে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে কৃষি খাতের অবদান কমে দাঁড়িয়েছে ১৪.২৩ শতাংশ, যদিও রাষ্ট্র কৃষি খাতকে খাদ্য উৎপাদনের প্রধান খাত হিসেবে দেখছে। বাংলাদেশের পারিবারিক কৃষির চলমান রূপ বোঝার তাগিদে সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ ১১টি জেলার ১৪টি উপজেলার ৪৪টি ইউনিয়নের ৮৬টি গ্রাম থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। এর ভেতর ১৮৪ জন নারী ও ৭১৫ জন পুরুষ। এর মধ্যে ৭৪৬ জন মনে করে, কৃষি একটি সামগ্রিক পারিবারিক কাজ; ৯১ জন মনে করে, এটি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাজের সমন্বয়। শুধু ৬২ জন মনে করে, কৃষিকাজ একটি ব্যক্তিগত কাজ। পারিবারিক কৃষিতে কিছু সঙ্কটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর মধ্যে কৃষকের আত্মপরিচয় সঙ্কট, মর্যাদাহীন পেশা, শুধু বাজার ও একক শস্যের উৎপাদনের হিসেবে বিবেচনা করা, কৃষি লাভজনক পেশা নয়, কৃষিজমির বিচারহীন বেদখল ও অকৃষি খাতে এর ব্যবহার, জমির মালিকানাজনিত জটিলতা ও নিরাপত্তাহীনতা, পারিবারিক কৃষির জন্য সহায়ক নীতি ও কর্মসূচির অভাব, কৃষি বিকাশে কৃষি সংস্কার, রাষ্ট্রীয় প্রণোদনা ও বাজেটের অভাব, কৃষক, উৎপাদক, ক্রেতা, বিক্রেতা ও ভোক্তার ভেতর পারস্পরিক আন্তনির্ভরশীল সম্পর্ক তৈরি না হওয়াসহ মোট ১৫টি সমস্যার কথা বলা হয়েছে। জরিপে পারিবারিক কৃষি জোরদার করতে কৃষিজমি সুরক্ষা ও কৃষিজমিতে কৃষকের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা, কৃষি প্রতিবেশভিত্তিক কৃষি সুরক্ষা করা, কৃষিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং ক্ষুদ্র কৃষকদের স্বার্থে শস্য বীমা, কৃষকদের জন্য পেনশন স্কিম, বীজ বীমা এবং অণুজীব ভর্তুকি প্রদানসহ ১০টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। [সূত্র : কালের কণ্ঠ, ১০.০৪.২০১৯] কৃষিতে কৃষকের আগ্রহ ফিরিয়ে আনতে গবেষণায় উঠে আসা সব সমস্যা নিরসনসহ অবহেলিত এই শ্রেণিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিলে হয়তো ভালো ফল পওয়া সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সরকারের যথেষ্ট আন্তরিকতা।

দেশের প্রধান খাদ্যশস্য ধান যাদের হাত ধরে উৎপাদিত হয় সেই সম্প্রদায় অর্থাৎ কৃষকই যদি অভুক্ত অবহেলার শিকার হয় তাহলে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনকারী বাংলাদেশ তলিয়ে যাবে অতীতের খাদ্য সঙ্কটাপন্ন গভীর অতলে। খবরে বলা হয়, আগাম ও স্বাভাবিক বন্যা মোকাবেলায় আসন্ন বাজেটে (২০১৯-২০) গুরুত্ব পাচ্ছে বিশেষ আর্থিক বরাদ্দ। বিশেষ করে ফসল ও জীবন রক্ষায় বাঁধ নির্মাণ, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে বেশি নজর দেওয়া হচ্ছে। এই সম্ভাব্য বাজেট বরাদ্দ যেন হাওর ও কৃষকের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয় হয় সেদিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। শুধু বরাদ্দ দিয়ে দিলেও চলবে না, কৃষক এর সুবিধা কতটুকু ভোগ করতে পারছে সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। নইলে বঞ্চিত কৃষক বঞ্চিতই থেকে যাবে।

 

বিশ্বজিত রায়

সাংবাদিক ও কলামিস্ট


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১