বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০১৯

খালেদা জিয়ার মুক্তি কোন পথে

খালেদা জিয়ার মুক্তি কোন পথে ছবি : সংগৃহীত


গত ৫ এপ্রিল বাংলাদেশের খবরে ‘তারেকের পথে খালেদা’ শিরোনামে বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল— আন্দোলনের মধ্য দিয়ে নেত্রীকে মুক্ত করা ও নির্বাচিত ছয় এমপি’র শপথ না নেওয়ার অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করেছে বিএনপি। বিদেশে উন্নত চিকিৎসার জন্য দলের চেয়ারপারসনের মুক্তি মিললে বিএনপির ছয় সংসদ সদস্য শপথ নিতে পারেন— এমন আভাস দিয়ে বলা হয়েছিল, এরকমই একটি সমঝোতার দিকে হাঁটতে শুরু করেছে সরকার ও বিএনপি। কিন্তু কারাবন্দি খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাসপাতালে বিএনপি নেতাদের সাক্ষাতের পর দৃশ্যপট পাল্টে গেছে। প্যারোল কিংবা শপথের বিনিময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তির সম্ভাবনা এখন একেবারেই ক্ষীণ।  অলৌকিক কিছু না ঘটলে এ প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়ার মুক্তির আর কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে করছেন না রাজনীতিসচেতন মহল।

বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কারান্তরীণ আছেন এক বছর তিন মাস হতে চলল। এখন পর্যন্ত তার দল তাকে মুক্ত করতে পারেনি। ২০১৮ সালে যখন জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার রায়ের তারিখ ঘোষণা করা হয়, তখন বিএনপি নেতারা বলেছিলেন, নেত্রীকে তারা জেলে যেতে দেবেন না। এরপর যখন ওই বছরের ৮ ফেব্রুয়ারি রায় ঘোষণা করে বেগম জিয়াকে কারাগারে প্রেরণ করা হলো, তখন তারা বললেন, দুই-চার দিনের মধ্যেই নেত্রীকে মুক্ত করে ফেলবেন। কিন্তু সে দুই-চার দিন আর আসেনি। এই সোয়া বছরব্যাপী বেগম জিয়াকে মুক্ত করার প্রত্যয়ে বিএনপি নেতাদের কঠোর আন্দোলনের কথাই শুধু শোনা গেছে। বিএনপি নেতারা প্রথমে বলেছিলেন, আদালতে আইনি প্রক্রিয়ায় তারা নেত্রীকে মুক্ত করবেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা হতাশার সুরেই বললেন, আইনি প্রক্রিয়ায় বেগম জিয়াকে মুক্ত করা সম্ভব নয়, এজন্য রাজপথে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। তবে নির্মম বাস্তবতা হলো, সে ‘কঠোর আন্দোলন’ এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান হয়নি। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, অনেকে সন্দেহ করতে শুরু করেছেন, বিএনপি পরিচালনাকারী নেতারা বেগম জিয়ার মুক্তি আসলেই চান কি-না।

খালেদা জিয়ার মুক্তি প্রশ্নে সরকারের সঙ্গে বিএনপির  সমঝোতার গুজব বাতাসে ভেসে বেড়াতে শুরু করেছিল। যদিও সরকার বা বিএনপি কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। তবে প্যারোলের বিষয়টি অনেকটাই নড়বড়ে হয়ে গেছে গত ১৫ এপ্রিল মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের একটি মন্তব্যে। জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের নবগঠিত কমিটির নেতারাসহ শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদনের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘প্যারোলের বিষয়টি সম্পূর্ণ চেয়ারপারসন এবং তার পরিবারের সিদ্ধান্তের ব্যাপার। এক্ষেত্রে দলের কিছু করার নেই।’ বিএনপি মহাসচিবের এ মন্তব্যের পর রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলে আলোচনা এই যে, সম্ভবত বেগম জিয়া প্যারোলে মুক্তি নিতে রাজি হননি। কারণ, এর একদিন আগে বাংলা নববর্ষের দিন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির দুই সদস্য নজরুল ইসলাম খান ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় দেখা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে। সেখান থেকে বেরিয়ে মির্জা আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘প্যারোল নিয়ে তার সঙ্গে তেমন কোনো কথা হয়নি।’ অনুসন্ধিৎসু ব্যক্তিরা এর মধ্যেই রহস্যের সন্ধান করছেন। তাহলে কি প্যারোলের কথা বলে তারা বেগম জিয়ার কাছ থেকে নেতিবাচক জবাব পেয়েছেন, যেজন্য এখন বিষয়টি ছেড়ে দিচ্ছেন তার ও পরিবারের ওপর?

বস্তুত বেগম জিয়াকে যারা জানেন, তারা এটা মেনে নিতে নারাজ যে, তিনি সরকারের কাছ থেকে প্যারোল চেয়ে মুক্ত হবেন। তাছাড়া প্যারোলে মুক্তি একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য মর্যাদাকরও নয়। কেননা প্যারোল প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারের অনুকম্পার বিষয়টি জড়িত। বেগম খালেদা জিয়া তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী সরকারের কাছে আবেদন করে শর্তসাপেক্ষে মুক্ত হবেন-এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ভেতরের খবর হলো, হাসপাতালে তিন নেতা প্যারোলে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার উদ্দেশ্যে বিদেশে যাওয়ার বিষয়ে বেগম জিয়াকে বোঝাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ওই ধরনের কোনো প্রক্রিয়ায় মুক্ত হতে চান না বলে তার সহকর্মীদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। তিনি নাকি এও বলেছেন, হয় তিনি আইনি প্রক্রিয়ায় মুক্ত হবেন, না হয় কর্মীরা রাজপথে আন্দোলন করে তাকে মুক্ত করবে। অন্যথায় তিনি জেলেই থাকবেন। তাছাড়া নেতারা ছয়জনের শপথ নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেও ইতিবাচক কোনো সাড়া পাননি তার কাছ থেকে। এ সবই অনুমাননির্ভর কথা। কারণ, হাসপাতালের প্রিজন সেলে তার সঙ্গে নেতাদের কী কথা হয়েছে তা শুধু তারাই জানেন। তারা প্রকাশ্যে যেটা বলেছেন, সেটাকেই ‘ঘটিত’ বলে ধরে নিতে হচ্ছে। তবে গত ১৬ এপ্রিলের সমকালে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে— ‘হাসপাতালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী আলোচনার সময় নেতারা তার স্বাস্থ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে আকারে-ইঙ্গিতে প্যারোলের প্রসঙ্গটি সামনে নিয়ে আসেন। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে ওই প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তিনি নেতাদের জানান, তার বিরুদ্ধে যেসব মামলা করা হয়েছে, সেগুলোর প্রতিটিই মিথ্যা। আদালতে সুবিচার পেলে তিনি এতদিনে সব মামলা থেকে রেহাই পেতেন। সরকার সেটা করতে দিচ্ছে না। এখন তাকে প্যারোলে মুক্তির নামে আরেক দফা নির্যাতন করতে চাইছেন।’ বেগম জিয়ার এ বক্তব্য থেকে পরিষ্কার যে, তিনি প্যারোলে মুক্ত হতে চান না। তিনি ওই মুক্তিকে নির্যাতনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। কেননা, প্যারোল কোনো স্থায়ী মুক্তি নয়। বিশেষ কারণে যে কোনো আসামি সরকারের ইচ্ছা সাপেক্ষে প্যারোলে মুক্ত হতে পারে। তবে তা সাময়িক। ওই কারণ মিটে গেলে প্যারোলে মুক্ত ব্যক্তিকে পুনরায় কারাগারে ফিরে যেতে হয়। তাছাড়া বেগম খালেদা জিয়ার মতো একজন নেত্রী, যিনি তিনবার দেশের প্রধানমন্ত্রী, দুইবার জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন, প্যারোলে মুক্তি তার জন্য সম্মানজনকও নয়। আর তাই বেগম জিয়া যে প্যারোলে মুক্তি নিতে রাজি হবেন না, তা অনেকেই অনুমান করতে পেরেছিলেন।

এদিকে নেত্রীর মুক্তি আন্দোলন গড়তে ব্যর্থতা, সাংগঠনিক বিপর্যয়, দলের অভ্যন্তরে কোটারি স্বার্থভিত্তিক গ্রুপিং ইত্যাদি কারণে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে ক্ষোভ ক্রমেই বাড়ছে। তারা দলের এ পরিণতির জন্য শীর্ষ নেতাদের ভুল সিদ্ধান্তকেই দায়ী করছেন। তাদের কথা হলো, বিএনপির দাবি ছিল বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ সাত দফা দাবি মেনে নিলে তারা নির্বাচনে যাবেন। কিন্তু সরকার একটি দাবিও মানেনি। তা সত্ত্বেও ড. কামাল হোসেনের প্ররোচনায় তারা ওই অসম নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সে নির্বাচনে গিয়ে বিএনপির এক কানাকড়িও লাভ হয়নি। সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি যে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে গেছে তা এখন তারা উপলব্ধি করতে পারছেন। সব না হোক অন্তত চেয়ারপারসনকে জামিনে মুক্ত করে নির্বাচনে গেলেও একটি কাজ হতো। অথচ তখন নেতারা বলেছিলেন, চেয়ারপারসনের মুক্তি আন্দোলনের অংশ হিসেবেই তারা নির্বাচনে যাচ্ছেন। কিন্তু সে মুক্তি আন্দোলনের স্বরূপ যা দেখা গেছে, তাতে দলটির তৃণমূল নেতাকর্মীদের মধ্যে শুধু হতাশাই বাড়েনি, ধূমায়িত হচ্ছে ক্ষোভের আগুনও। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত ২৪ মার্চ দলটির সাবেক মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমানের স্মরণসভায়। সেখানে নেতাকর্মীরা জাতীয় ঐক্যফ্রন্টে বিএনপির যোগদানের বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছেন মহাসচিব মির্জা আলমগীরের কাছে। কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন এ সময় কর্মীদের পক্ষ নিয়ে তার বক্তৃতায় ড. কামাল হোসেনকে নেতা মেনে নির্বাচনে যাওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।  

অন্যদিকে দল থেকে নির্বাচিতদের সংসদে যোগ দেওয়ার আগ্রহকেও তৃণমূল কর্মীরা ভালো চোখে দেখছেন না। শপথের বিনিময়ে নেত্রীর মুক্তির কথা যারা বলছেন, তাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে কর্মীদের মনে। তারা আদৌ নেত্রীর মুক্তি চান, নাকি এর বাতাবরণে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের চেষ্টায় রত হয়েছেন— সে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এ বিষয়ে চেয়ারপারসনের অবস্থান জানিয়ে দেওয়ার জন্যই দল থেকে নির্বাচিত ছয় প্রার্থীকে ১৫ এপ্রিল রাতে গুলশান কার্যালয়ে ডাকা হয়েছিল। পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, হাসপাতালে খালেদা জিয়া নেতাদের বলেছেন, ‘এই সংসদে গিয়ে কী হবে? সংসদের বাইরেও অনেক ভূমিকা পালন করা যায়।’ এই ‘ভূমিকা’ বলতে তিনি যে আন্দোলনকেই বুঝিয়েছেন সেটা ব্যাখ্যা করে বলার দরকার পড়ে না। কিন্তু নেতাকর্মীদের কাছ থেকে তার মুক্তি দাবিতে যে ধরনের আন্দোলনের প্রত্যাশা বেগম জিয়া করছেন, তা তারা গড়ে তুলতে পারবেন এমন কোনো সম্ভাবনা এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। বিএনপি নেতাদের মধ্যে ঢাকাকেন্দ্রিক ঘরোয়া আন্দোলনের যে প্রবণতা সৃষ্টি হয়েছে, তা তাদের নেত্রীকে কখনো মুক্ত করতে পারবে, এটা কেউ বিশ্বাস করেন না। বরং দলের নির্বাচিত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনই সংসদে যোগ দিতে আগ্রহী— এ খবর তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে নির্বাচিত দলের যুগ্ম-মহাসচিব হারুন উর রশিদ পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘কিছুদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে তাদের শপথ গ্রহণ নিয়ে নানা সংবাদ প্রচার হয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে তাদের সবাইকে ডেকে সতর্ক করা হয়েছে-যাতে তারা বিভ্রান্ত না হন এবং দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে না যান।’ ফলে এটা একরকম স্পষ্ট যে, সরকারের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে বেগম জিয়ার মুক্তির বিনিময়ে ছয় এমপির শপথ নেওয়া হচ্ছে না। উল্লেখ্য, আগামী ৩০ এপ্রিল তাদের শপথ নেওয়ার সময়সীমা শেষ হয়ে যাবে। এরপর তাহলে বিএনপি তাদের নেত্রীকে মুক্ত করতে কোন পথ অবলম্বন করবে? প্যারোল এবং সমঝোতায় জামিনের সম্ভাবনা বাতিল হওয়ার পর একটিমাত্র পথ আছে, তা হলো আন্দোলন। কিন্তু বিএনপির গত এক বছরের পারফরম্যান্সে এটা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই যে, এ ইস্যুতে তারা কার্যকর কোনো আন্দোলন সহসাই গড়ে তুলতে পারবেন। তাহলে কি খালেদা জিয়াকে অনির্দিষ্টকাল কারাগারেই থাকতে হবে? তার দলের নেতাকর্মীরা কি তাকে মুক্ত করতে এগিয়ে আসবে না? এমন অজস্র প্রশ্ন আছে জনমনে। এসবের উত্তর ভবিষ্যতের ঘটনাবলি থেকেই বোধকরি পাওয়া যেতে পারে।

 

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক 


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১