বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ০৩ মে ২০১৯

মানসম্পন্ন শিক্ষক নিয়োগে এনটিআরসিএ’র ভূমিকা


অন্তত আমাদের দেশে দেখা যায় যে, বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষিত চাকরিপ্রত্যাশী কখনোই পেশা হিসেবে শিক্ষকতাকে পছন্দের তালিকায় রাখেন না। পছন্দের তালিকায় শিক্ষকতা না থাকলেও  অনেকেই শেষ পর্যন্ত এই পেশায় আসতে বাধ্য হন জীবিকার তাগিদে। কেননা অন্যসব ক্ষেত্রে তারা অযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে অথবা তাদের মেধাকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি কোনো নিয়োগকর্তা। পাশাপাশি আরেকটি সমস্যা আছে, সেটি হলো দেশে বেকারদের তালিকাটি খুবই লম্বা।  বেকারদের বেশিরভাগ এই শিক্ষকতায় এসেছে; কারণ অন্য সব পেশার থেকে এই পেশায় আসা খুবই সহজ। ২০০৫ সালের আগে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) গঠন করার আগে স্নাতক/স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করা যে কাউকে ধরে নিয়ে এখানে চাকরি দেওয়া যেত বা স্কুল/কলেজ নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করত এবং একটি নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করত। কিন্তু দেখা যেত এই নিয়োগ পরীক্ষা ছিল শুধু লোকদেখানোর জন্যই। যাকে নেওয়া হবে তার সঙ্গে আগে থেকেই সব ঠিক হয়ে থাকত, পরীক্ষার প্রশ্নপত্র দিয়ে দেওয়া হতো। কোনো প্রার্থী প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পরে সুবিধা না করতে পারলেও তাকে যেভাবেই হোক ম্যানেজিং কমিটি নিয়ে নিত অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে, যদিও কিছু প্রতিষ্ঠান ঠিক যোগ্যদেরই নিয়োগ দিত। এরপর যখন এনটিআরসিএ গঠন করা হলেও তখনো দীর্ঘ সময় ধরে এ রীতিই চলতে ছিল। পার্থক্য ছিল শুধু একটি, আগের মতো স্নাতক/স্নাতক (সম্মান) সম্পন্ন করা যে কাউকে এনে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে অবশ্যই শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। নিবন্ধন পরীক্ষায় তাদেরই সনদ দেওয়া হয়, যারা ১০০ নম্বরের বহুনির্বাচনী প্রশ্ন আর বিষয়ভিত্তিক লিখিত পরীক্ষায় নির্দিষ্ট নম্বর পায় তাদের। আর এই নিবন্ধনধারীরাই কেবল বেসরকারি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়োগ পরীক্ষায় আবেদন করতে পারবেন। নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাজ যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নিজেদের কাছে ছিল তাই অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে অযোগ্যদের নিয়োগের বিষয়টি ছিলই। কিন্তু নিয়োগদানের জন্য এখন কেন্দ্রীয়ভাবে মনোনয়ন করা হয় মেধা তালিকা ও পছন্দক্রম পদ্ধতির মাধ্যমে যে কাজটি স্বয়ং এনটিআরসিএ করে থাকে।

এনটিআরসিএ’র সর্বশেষ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দ্বারা স্কুল-কলেজের নিয়োগ-বাণিজ্য বন্ধ হয়েছে কিন্তু এই কর্তৃপক্ষ কি বলতে পারবে যে, তারা মানসম্পন্ন শিক্ষক সরবরাহ করতে পারছে? আমার বেশ কিছু পরিচিতজন বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করছেন এনটিআরসিএ’র নিবন্ধন সনদ দিয়ে এবং তাদের মাসিক বেতনভুক্তও করা হয়েছে। কিন্তু শ্রেণিকক্ষে কীভাবে পড়াতে হয় সেটি তারা এখনো সঠিকভাবে জানেন না। আমার লেখাটি যারা এ মুহূর্তে পড়ছেন তারা নিশ্চয়ই একটি বিষয়ে অবগত আছেন, যে বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রচলিত সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে অনেকেই বলছেন এটি খুব ভালো পদ্ধতি না বরং শিক্ষার্থীদের চাপে ফেলছে। কিন্তু যারা একটু সচেতন তারা এ মন্তব্যের প্রতিবাদ করেই থাকেন এবং বলেন- সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি খুবই ভাোল এবং যুগোপযোগী পদ্ধতি কিন্তু রাষ্ট্র মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরি করতে পারছে না। আমি বরাবরই বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে শিক্ষাসংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলি। কয়েকদিন আগে ঢাকার অদূরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে কথা বলি তার মধ্যে একটি প্রশ্ন ছিল, ‘তোমাদেরকে সৃজনশীল প্রশ্ন কীভাবে পড়ানো হয়?’ উত্তর আসে, ‘সৃজনশীল প্রশ্ন আবার কীভাবে পড়াবে? এটি তো আমাদের স্যাররাও (শিক্ষক) জানেন না যে, কোন কোন জায়গা (টপিক) থেকে প্রশ্ন করা হবে। কিন্তু শিক্ষকরা আমাদেরকে গাইড বই থেকে কিছু প্রশ্ন ঠিক করে দেন ওগুলোই পড়ি’। শিক্ষার্থীরা আমাকে জানায়, ওদের মূল বই অর্থাৎ জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক কর্তৃক প্রণীত বই ওরা খুব একটা পড়ে না, পড়তেও হয় না; কিছু শিক্ষকও এমনটা বলেন যে, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না। সৃজনশীল ও বহুনির্বাচনী প্রশ্নের জন্য জন্য গাইড অনুসরণ করলেই হয়- এর মানে কী দাঁড়াল? এখানেও কি শিক্ষকদের অদক্ষতার বিষয়টি ফুটে ওঠেনি?

আমরা বাংলাদেশিরা ভালো শিক্ষক বলতে বুঝি, যারা ইংরেজি গ্রামার একটু ভালো বোঝাতে পারেন বা গণিতে বেছে বেছে কিছু অঙ্ক করান, যা প্রায় সময়েই পরীক্ষার প্রশ্নে থাকে। বেশ হাস্যকর একটি মাপকাঠি। আপনারা কোনো শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করলে জানতে পারবেন, বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গ্রামার পড়ানো হয়, কিন্তু দু-চারজন বাদে যা পড়ানো হলো তার ৫০ শতাংশও কোনো শিক্ষার্থী শিখতে পারে না বা শিক্ষক শেখাতে পারেন না। ইংরেজি, গণিত এবং নবম-দ্বাদশ শ্রেণির বিজ্ঞানের দু-একটি বিষয় বাদে অন্য সব বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কেবল রুটিনে আছে বলেই শিক্ষকরা ক্লাসে যান। আর যেসব বিষয় খুব ভালো করে পড়ানো হয় সেসবও যে খুব ভালো করে পড়ানো হয় সেটিও নয়। আমাদের মাধ্যমিক পর্যায়ের ইংরেজি শিক্ষকরা ভাবতেই পারেন না যে, শুধু গ্রামার পড়ানোর বাইরেও শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস অনুসরণ অনেক কিছু পড়ানোর আছে। যেমন প্যারাগ্রাফ বা কম্পোজিশনের কথাই ধরা যাক, এসবকে আমরা কেবল মুখস্থনির্ভর বলেই জানি; অবশ্য এমন করেই আমাদের ভাবতে বাধ্য করা হয়েছে প্রচলিত শিক্ষাপদ্ধতি কর্তৃক। কিন্তু এগুলোও যে সঠিকভাবে পাঠাদানের দ্বারা মুখস্থনির্ভরতা কমিয়ে আনা যায় এবং শিক্ষার্থীদের নিজস্ব মেধা ও মননের ওপর নির্ভরশীল করে তোলা যায়, সেটি আমরা জানি না। আমাদের দেশে স্কুল-কলেজে পাঠ শেখানো হয় না, পাঠ মুখস্থকরণে চাপ প্রয়োগ করা হয়; শিক্ষকদের জানতে হবে এটি ‘প্লেজিয়ারিজম’র আওতায় পড়ে।

আমাদের শিক্ষা ও শিক্ষক সমস্যা নিয়ে কথা বলে শেষ করা যাবে না। তবে আমরা যখনই কোনো সমস্যা নিয়ে কথা বলি তখনই চিন্তাবিদরা বলে ওঠেন বাংলাদেশ অনেক ছোট দেশ এবং আর্থিকভাবে এদেশ খুব সচ্ছল নয়, যে কারণে আমাদের ইচ্ছা হলেও অনেক কিছু করা যায় না। আমাদের একটি ধারণা জন্মেই গেছে আমাদের আর্থিক সামর্থ্যের দৌড় খুব বেশি না সে শিক্ষা ক্ষেত্রের উন্নতির জন্য হোক কিংবা সামরিক ক্ষেত্রে। এই খোঁড়া যুক্তি দিয়ে আর কতদিন চলবে? আমরা এখন আর আগের অবস্থানে নেই। দেশ এগিয়েছে, দেশের নীতিনির্ধারকদেরও ধারণাও বদলেছে, যা অনেকটাই যুগের সঙ্গে খাপ খাচ্ছে।  বিগত কয়েক বছরে এনটিআরসিএ বেশ সমালোচনার মুখেই আছে। কিন্তু তারা এমন কোনো পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত নিতে পারেনি, যার জন্য মানুষ তাদের পক্ষে কথা বলবে। শুধু বহুনির্বাচনী প্রশ্ন আর একটি লিখিত পরীক্ষা নিলেই কি একজন মানসম্পন্ন শিক্ষক খুঁজে পাওয়া যায়? অনেকেই তো অনেক কিছু জানেন কিন্তু নিজের জানা থেকে সঠিকভাবে অন্যকে জানানোর মতো সক্ষমতা আছে কজনের? দৈনিক ইত্তেফাকের জুলাই ৬, ২০১৭ তারিখে ‘সবাই কি শিক্ষক?’ শিরোনামে আমার একটি ছোট্ট নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, যেখানে আমি শিক্ষক হান্টিংয়ের কথা বলেছিলাম। কিন্তু আমি জানি না এটি কতটা বাস্তবসম্মত, তবে করা গেলে ভালো হবে।

এনটিআরসিএ’র এই সনদ প্রদান এবং নিয়োগে মনোনয়নদানের মাধ্যমে বেকারত্ব কমানোর দায়িত্ব হাতে না নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য মানসম্পন্ন শিক্ষক খুঁজে বের করুক- এটিই আমাদের প্রত্যাশা। আরেকটি বিষয় না ভাবলেই নয়, দেশে শিক্ষক প্রশিক্ষণ কলেজগুলোয় শিক্ষা ও গবেষণা বিষয়ে চার বছর মেয়াদি স্নাতক চালু করা আছে মাধ্যমিক স্তরের জন্য, মানসম্পন্ন শিক্ষক তৈরির জন্য। কিন্তু কতটা সফল এই সিদ্ধান্ত? বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ কতটা মানসম্পন্ন শিক্ষক দিতে পারছে, সেটি কখনো কেউ ভেবে দেখেছেন? অথচ এখন শিক্ষক নিয়োগের জন্য মনোনয়নের কাজটিও তাদের হাতে চলে যাওয়ায় নিজেদের পছন্দমতো কোনো ভালো মানের কেউকে নিয়োগ দিতে পারছে না অনেক প্রতিষ্ঠান।

লেখক : প্রাবন্ধিক


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১