বাংলাদেশের খবর

আপডেট : ১৭ মে ২০১৯

দুঃসময়ের সাংবাদিকরা হয়ে উঠে অপরিচিত


নিহার সরকার অংকুর

 

মানুষের জীবনে এমন কিছু ঘটনা থাকে যা আবেগ তাড়িত করে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন অনেক কিছু দেখার সময়। আমিও দেখেছি, এখনও দেখছি। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সংকটকাল বা কালো দিন আমি দেখেছি যেটি খুব বাজে রূপ ধারণ করেছিলো। ১২ ব্যাচ পর্যন্ত অনেকেই হয়তো বুঝে গেছে আমি বেলতলি’র বাস ভাংচুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে ফিল্মি পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিলো তার কথা বলছি।

১৩মে রবিবার বিকাল ৪টা নাগাদ আমি রুমে শুয়ে আছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপে একটি পোষ্টে চোখে পড়লো যেখানে লিখা এলাকাবাসী শিক্ষকদের বাসে হামলা করেছে, শিক্ষক আহত এ জাতীয়।আমি প্রথমে দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছি। পরে পরিষ্কার হলাম এলাকাবাসী বলতে ঢাকা-ময়মনসিংহ  শহরের নিকটবর্তী সড়কের পাশের একটি গ্রাম বেলতলির মানুষদের কথা। ইতোমধ্যে ফোন আসে সহকারী প্রক্টর নজরুল ইসলাম ও আল-জাবির স্যার এর। প্রক্টোরিয়াল বডি ইতোমধ্যে রওনা দিয়েছে বেলতলির উদ্দেশ্যে। আমি সহ দুজন সংবাদকর্মী আমারা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিরো পয়েন্ট এর দিকে যাই। সেই সাংবাদিক সহকর্মী হলো সরকার আব্দুল্লাহ তুহিন। জিরো পয়েন্টে শিক্ষার্থীরা শান্তি পূর্ণভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়ি বন্ধ করে এমনটা দেখে আমরা রওনা দিলাম ঘটনার মূল জায়গা বেলতলির দিকে। সেখানে যাওয়াটা কষ্টকর কেননা বাস চলাচল বন্ধ । বারবার অটো চেঞ্জ করে এগোচ্ছিলাম। মাঝে ড্রাইভার অটো থামিয়ে দিয়ে বলে আর যাবো না গাড়ি ভাঙলে আমি শেষ। আমি আর তুহিন ভাই বললাম আপনি যান আমরা দেখবো। সাহস দিয়ে নিয়ে গেলাম। সেই জায়গার কাছাকাছি এসে ভাড়া দিয়ে দৌড় দিয়ে মূল স্পটে যাই দুজন। এতোই ভিড় যে দুজন আলাদা হয়ে যাই। গলায় কার্ড ঝুলিয়ে পুলিশের সাথে অভিযানে যাই। চারদিকে স্লোগান, বিক্ষোভ, আতংক বিরাজ করছিলো। বাড়ি বাড়ি চলে পুলিশি তল্লাশি। কয়েকজন ডোবায় পচা কুচুরিপানার নিচে দিয়ে পালিয়ে যায়। সন্দেহজনক দুইজনকে আটক করে পুলিশ। যার ফলে প্রাথমিক সান্তনা দিয়ে শিক্ষার্থীদের ঘরে ফেরানো হয়েছিলো। আবার জিরো পয়েন্টে বাস ভাংচুর করা হয়েছে এমন তথ্য প্রকাশ করে যমুনা টেলিভিশন।

পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত ভিন্ন ভিন্ন রূপ নিচ্ছিলো।  অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়  প্রশাসন পুলিশ প্রশাসন এর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছিলো । শিক্ষার্থীরা চলে যেতে শুরু করে যান চলাচল শুরু হয়। আমরা প্রক্টরিয়াল বডির সাথে বেলতলি থেকে গাড়িতে করে ক্যম্পাসে ফিরি।  প্রাইমারি নিউজ স্পটে থেকেই অফিসে পাঠিয়েছিলাম। সন্ধ্যার পর বিস্তারিত পাঠানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এমন সময় সঞ্জয় স্যার, নজরুল স্যার ও আল-জাবির স্যার তিন জনই পৃথক ভাবে ফোন দেন এবং মামলা করার জন্যে থানায় যাবার জন্যে বলেন। তখন আমি সহ ৪জন সংবাদকর্মী প্রক্টরিয়াল বডির সাথে যাই। যেখানে চারজন সহকারী প্রক্টর ও ৪ জন সংবাদকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন কর্মকর্তা যায়। ৪ জন শিক্ষকের মধ্যে ছিলেন সহকারী প্রক্টর নজরুল ইসলাম, আল- জাবির, সঞ্জয় মুখার্জী ও প্রণব স্যার। অন্যদিকে সংবাদ কর্মীদের মধ্যে আমি, সরকার আব্দুল্লাহ তুহিন, আরিফুল ইসলাম ও আজিজার রহমান ছিলাম। সারা রাত জেগে চলে থানায় মামলা দায়ের করা। সেখানেও ছিলো বিড়ম্বনা। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো পরেরদিনের জন্যে যা ফেইসবুক মেসেঞ্জার গ্রুপে আলোচনা হচ্ছিলো এবং সেটা পুলিশ প্রশাসন মনিটরিং করছিলো। আমদের সে বিষয়ে ব্রীফও দিয়েছিলেন সহঃ পুলিশ সুপার আল-আমিন ভাই।

আগেই বলেছিলাম পরিস্থিতি শান্ত করতে দুজনকে গ্রেফতার করেছিলো পুলিশ। যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিলো তারা মূলত শ্রমিক।  শ্রমিক নেতারা তাদের মুক্তির জন্যে এসেছিলো বারবার কিন্তু তাদের ছাড়া হয়নি। যার ফলে ঢাকা- ময়মনসিংহ মহাসড়ক শ্রমিকরা রাস্তা অবরোধ করে রাখে। আমরা ক্যম্পাসে ফেরার পথে পড়ি বিপাকে। একটা ভয় কাজ করছিলো। কেননা ততক্ষনে বিষয়টা আর এলাকাবাসী আর শিক্ষার্থীদের মধ্যে নেই সেটা চলে গেছে শ্রমিকের মধ্যেও। সব শেষে একটা চাপা আতংক নিয়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর দিয়ে কোন এক পাশ দিয়ে বৈলর এসে রাস্তায় উঠি।  ততক্ষনে সকাল হয়ে গেছে। আমরা ক্যম্পাসে নেমে নাস্তা করে রুমে গেলাম ফ্রেশ হয়ে শুলাম। ঘন্টা খানেক পর নজরুল স্যার এর ফোন আবার বেলতলিতে আন্দোলন শুরু হয়েছে। অবস্থা খারাপ। আবার চললাম তখন ও সঙ্গী সরকার আব্দুল্লাহ তুহিন, আরিফুল ইসলাম সাথে সজীব আহমেদ। বেলতলি পৌছালাম পরিবেশ উত্তপ্ত। হাজার খানেক শিক্ষার্থীর বিক্ষোভ। এটিএন নিউজ এর ময়মনসিংহ প্রতিনিধির সাথে পরিচয় জানতে চাওয়া নিয়ে বাধে তর্ক এক পর্যায়ে সেই সাংবাদিকের উপর আঘাত করা হয় সেসময় আমি ও লিজন ভাই তাকে উদ্ধার করি। যারা আঘাত করেছে তাদের চিনি না।  তখনই সন্দেহ হচ্ছিলো পরিস্থিতি খারাপ এর দিকে যাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে নিতে আসলেন উপাচার্য প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান। তার বক্তব্য ও পুলিশ প্রশাসনের আশ্বাসে পরিবেশ ঠান্ডা হচ্ছিলো এমন সময় একটি ট্রাক ভর্তি মানুষ এসে আবারো বিক্ষোভ শুরু করে। ততোক্ষনে এই ইস্যুও মোড় নিয়েছে ভিন্ন প্রবাহে। শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের মুখোমুখি অবস্থানে তখন এলাকাবাসী, শ্রমিক, সাংবাদিক। শিক্ষার্থীদের বুঝিয়ে  উপাচার্য যখন বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি ঘোষণা করলো পরিবেশ শান্ত হলো তখন ঘটলো আরেক বিপত্তি ।  ওইদিন ময়মনসিংহ প্রেসক্লাবের নিচে সাংবাদিকের উপর হামলার বিচার চেয়ে মানববন্ধন করে বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এর সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ। যা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার পেতেই পরিবেশ উত্তপ্ত হতে থাকে। তখন উপাচার্য প্রফেসর ড.এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ডীন, প্রক্টর, পরিবহন প্রশাসন ও সেই সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিয়াশীল সংবাদকর্মীদের পাঠান সাংবাদিক নেতৃত্বের সাথে আলোচনার জন্যে। যেখানে আমি, ওয়াহিদুল ইসলাম, সরকার আব্দুল্লাহ তুহিন, মেহেদি জামান ও সজীব আহম্মেদ উপস্থিত ছিলেন। সাংবাদিক নেতাদের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিদের দীর্ঘ সময় আলোচনা হয় যেখানে ঘটনার জন্যে প্রশাসন দুঃখ প্রকাশ করে।

এখনো স্পষ্ট মনে আছে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় এর সংবাদকর্মীরা সকলের বাইরে এসে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলাম।

সন্ধ্যায় খবর আসে শিক্ষার্থীদের নামে দুটি অজ্ঞাত মামলা করা হয়েছে। শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্দ হয়ে উঠে। বিশ্ববিদ্যালয় সকল সংবাদ পরিবেশন থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন সাংবাদিক নেতারা।

তার একদিন পর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংবাদ সম্মেলন এর আয়োজন করেন। যেখানে আয়োজন ছিলো অনেকের কিন্তু আসলো কেবল বিশ্ববিদ্যলয়ে কর্মরত সাংবাদিকরা। যা আমাদের জন্যে ছিলো বড় চ্যালেঞ্জ।

আমরা জানি কতোটা বেগ পোহাতে হয়েছিলো সে সময়ে সংবাদ প্রকাশের জন্যে । কিন্তু আমরা পেরেছিলাম। আমি স্পষ্ট করেই বলছি আমরা প্রশাসনের প্রত্যাশার বাইরে সংবাদ প্রকাশ করেছিলাম। যা প্রকাশের পর উপাচার্যের প্রতি শিক্ষার্থীদের আস্থা বেরেছিলো । যার মূলে ছিলো অনেক কথার ভিড়ে একটি কথা –‘ আমাকে রেখে আমার সন্তানদের কেউ গ্রেফতার করতে পারবে না’।

আমি দেখেছি উপাচার্যকে ভেঙ্গে পড়তে, আবার দেখেছি ঘুরে দাঁড়াতে। প্রফেসর ড. এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান স্যারকে বলবো বড় সংকট মুহুর্ত পার হয়েছেন। অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিলো আপনাকে। একবার ভাবুন কাদের মুখ গুলো দেখতে পেতেন। সতর্ক হোন । আমরা বিনা স্বার্থেই পাশে ছিলাম। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়র শিক্ষার্থীর প্রশ্নে আমরা শিক্ষার্থীর পক্ষে। সুসময়ে বন্ধু অনেকেই হয় কিন্তু অভাবটা হয় দুঃসময়ে । 

ছুটিতে চলে যায় বিশ্ববিদ্যালয়(ক্লাস পরীক্ষা কেবল বন্ধ হয়।দাপ্তরিক কাজ চলতে থাকে)। প্রশাসন স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় নেয় । কয়েকমাস বাদে সময়ের পরিবর্তন হয়। তুহিন,আরিফরা অপরিচিত মুখ হয়ে উঠে প্রশাসনে। হারিয়ে যেতে হয় বেলতলির ঘটনায় রাত জেগে থানায় বসে থাকা সংবাদকর্মীদের , হারিয়ে যায় দুঃসময়ে সংবাদ প্রকাশ করা মুখগুলো । আমাদের কিছু চাওয়া ছিলো না কেবল প্রত্যাশা ছিলো সুন্দরের পথে হাটার। এর বেশী কিছু নয় । চাওয়া নেই বলেই হয়তো কদর নেই। চাওয়ায় বুঝি ঢের কদর মিলে?

বেলতলি আমার জীবনের এক স্মরণীয় মাত্রা। সেসময় যাদের সংবাদ প্রকাশে সাথে পেয়েছিলাম, তুহিন ভাই,আরিফ ভাই, সজীব ভাই, আজিজার ভাই ও ওয়াহিদ ভাই। আর বেলতলির জন্ম না হোক এটাই প্রত্যাশা। ভালো থাকুক প্রাণের বিশ্ববিদ্যালয়। আমাদের কিছু চাওয়া ছিলো না ছিলো ভালো রাখার প্রত্যাশা ।

এই ঘটনাটি যারা নতুন এসেছে অনেকেই জানে না । জানানো উচিত মনে করেছি তাই ঘটনার বাইরে এসে গল্পই বলছি সংকটের সেই মুহুর্তকে।


বাংলাদেশের খবর

Plot-314/A, Road # 18, Block # E, Bashundhara R/A, Dhaka-1229, Bangladesh.

বার্তাবিভাগঃ newsbnel@gmail.com

অনলাইন বার্তাবিভাগঃ bk.online.bnel@gmail.com

ফোনঃ ৫৭১৬৪৬৮১